হিথ স্ট্রিক, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের চিরসবুজ এক চরিত্র

নন্দিত পথযাত্রায় শেষটায় একটু নিন্দার ছায়া। কিন্তু তাতে কি! জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে অমরত্বের আসন নির্দ্বিধায় পেয়ে যাবেন হিথ স্ট্রিক। কিংবদন্তি এ পেসারের মৃত্যু নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি। ২৩ আগস্ট হঠাতই খবর ছড়িয়ে পড়লো, হিথ স্ট্রিক আর নেই।

তবে পরক্ষণে জানা গেল, দিব্যি বেঁচে আছেন তিনি। অবশ্য তাঁর সেই বেঁচে থাকাটা সত্য হয়ে রইল মাত্র দিন দশেকের জন্য। মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে গত দুই বছর লড়াই করার পর গত ৩ সেপ্টেম্বরে জীবন নদীর ওপারে চলে যান হিথ স্ট্রিক।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসে এখন হিথ স্ট্রিক শুধুই কি একটা স্মৃতির নাম? মোটেই নয়। এক যুগের ক্যারিয়ারে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকে যেভাবে এগিয়ে নিয়েছেন, তাতে তাঁর নামটা জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে অনুমিতভাবেই ‘চিরায়ত’ হওয়ার কথা। শুধু তাই নয়, জীবনের ইনিংসে মাত্র ৪৯-এই থেমে যাওয়া হিথ স্ট্রিককে নিয়ে আক্ষেপের গল্প হতে পারে অনেক। জিম্বাবুয়ের সোনালি সময়ের অনেক গল্পের স্রষ্টা যে ছিলেন তিনিই।

বাবা ডেনিস স্ট্রিক খেলেছিলেন রোডেশিয়ানদের হয়ে। আর ছেলে হিথ স্ট্রিক ছিলেন জিম্বাবুয়ের সোনালি সময়ের অভিযাত্রী ছিলেন। নব্বই দশকে জিম্বাবুয়ের পেস বোলিং আক্রমণ তাঁর নেতৃত্বেই বেড়ে উঠেছিল। জিম্বাবুয়ের হয়ে ৬৫ টেস্ট ও ১৮৯টি ওয়ানডে খেলেছেন হিথ স্ট্রিক। টেস্টে তাঁর উইকেটসংখ্যা ২১৬ টি, আর ওয়ানডেতে ২৩৯ টি।

১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচিতে হিথ স্ট্রিকের টেস্ট অভিষেক। অভিষেকটা রাঙাতে পারেননি। তবে জাতটা চিনিয়েছিলেন ঠিক তার পরের ম্যাচেই। রাওয়ালপিন্ডিতে পরের ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। তবে হিথ স্ট্রিকের বোলিং আগ্রাসনেও সে ম্যাচটা জিততে পারেনি জিম্বাবুয়ে। জয়ের খুব কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৫২ রানে হারে জিম্বাবুয়ে।

জিম্বাবুয়ের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়ের সাথে জড়িয়ে আছে হিথ স্ট্রিকের নাম। ১৯৯৫ সালে জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয়টা এসেছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক হারারেতে হওয়া সে টেস্টে জিম্বাবুয়ে জিতেছিল এক ইনিংস এবং ৬৪ রানে।

অবিস্মরণীয় এই জয়ে বল হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হিথ স্ট্রিক। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। যদিও ম্যাচসেরার পুরস্কার আর পাননি হিথ। অবশ্য টেস্ট ক্যারিয়ারে কখনোই ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতা হয়নি হিথ স্ট্রিকের। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, টেস্ট ক্রিকেটে কখনোই ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার না জেতা হিথ স্ট্রিক সিরিজ সেরা পুরস্কার জিতেছেন তিনবার!

হিথ স্ট্রিক মূলত বোলার হলেও লোয়ার মিডল অর্ডারে তিনি দারুণ ব্যাটিং করতেন। টেস্টে ১৯৯০ আর ওয়ানডেতে ২৯৪৩ রান সেটিই প্রমাণ করে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর একটি শতকও রয়েছে। টেস্টে ১টি সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছেন ১১টি ফিফটি। ক্যারিয়ার সেরা অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংসটা এসেছিল ২০০৩ সালে হারারেতে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। এছাড়া ওয়ানডেতে হাঁকিয়েছেন ১৩ টা ফিফটি।

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে হিট স্ট্রিকের একটি কীর্তি এখনও অক্ষর। তিনিই জিম্বাবুয়ের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র পেসার, যার দুই ফরম্যাটেই দুই শতাধিক উইকেটের কীর্তি রয়েছে।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে একটা লম্বা সময়ে পর্যন্ত নেতৃত্বও দিয়েছেন হিথ স্ট্রিক। জিম্বাবুয়ের হয়ে সর্বমোট ২১ টি টেস্ট ও ৬৮ টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে জিতেছেন মাত্র ৪ টি টেস্ট এবং ১৮ টি ওয়ানডেতে। ২০০০ সাল থেকে প্রায় ৪ বছর অধিনায়কত্ব করার পর ২০০৪ সালে বোর্ডের সাথে ঝামেলার জেরে তিনি অধিনায়কত্ব সরে দাঁড়ান। এর ১ বছর বাদের মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।

বাইশ গজকে বিদায় বলার পর কোচিংয়ে মনোনিবেশ করেন হিথ স্ট্রিক। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি বাংলাদেশ, কলকাতা নাইট রাইডার্স, সমারসেটের বোলিং কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বোলিং হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হিথের সান্নিধ্যেই পেস বোলিংয়ে দারুণ উন্নতি ঘটে বাংলাদেশি পেসারদের।

এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের বোলিং কোচের পদ ছেড়ে জিম্বাবুয়ের প্রধান কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত জিম্বাবুয়ের কোচের দায়িত্ব পালন করা স্ট্রিক অবশ্য এ যাত্রায় ব্যর্থ ছিলেন।

জিম্বাবুয়ে ২০১৯ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় তাই তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। অবশ্য বরখাস্ত হওয়ার কিছুদিন না গড়াতেই  ২০১৮ সালের আইপিএলে তিনি কলকাতা নাইট রাইডার্সের বোলিং কোচের দায়িত্ব পান।

অবশ্য এর কিছু বছর পরেই হিথ স্ট্রিকের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় কলঙ্কের দাগ লাগে। আইসিসি দুর্নীতিবিরোধী বিধির বেশ কয়েকটি ধারা ভঙ্গের কারণে ২০২১ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে তাঁকে ৮ বছরের নিষিদ্ধ করে আইসিসি।

এরপর থেকেই মূলত ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যান হিথ স্ট্রিক। আর মরণব্যাধি ক্যান্সারও ক্রমশ দানা বাঁধে তাঁর শরীরে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে পৌঁছে যান ক্যান্সারের চতুর্থ স্তরে। এরপর আর শরীর পেরে ওঠেনি। ক্যান্সারের কাছে হার মানতে হয় তাঁকে।

ফিক্সিং কাণ্ডে কোচিং ক্যারিয়ারে একটা দাগ লেগেছিল বটে। সেই দাগ আচ্ছন্ন করেছিল হিথ স্ট্রিকের গোটা ক্যারিয়ারকে। এই আক্ষেপ, আফসোসটা সঙ্গী করে শেষ জীবনে বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন হিথ স্ট্রিক। তবে তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার তো আর মিথ্যে হতে পারে না, কিংবা কীর্তিগুলো তো মুছে যেতে পারে না। হিথ স্ট্রিক বেঁচে থাকবেন সেই সব কীর্তিতে আর অর্জনে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link