১.
এককালের বিশ্বনন্দিত (নাকি নিন্দিত!) তারকা ব্যাটসম্যান হার্শেল গিবসের কথা মনে আছে? দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সেরা ওপেনারদের একজন তিনি, ভয়ডরহীন আক্রমণাত্মক ক্রিকেটই ছিল যার ব্যাটিংয়ের মূল দর্শন। যিনি ক্রিকেটটা খেলতেন স্রেফ বিনোদনের জন্য; ইনিংসের প্রথম বল থেকেই চড়াও হতেন বোলারদের ওপর।
২.
স্যার ভিভ রিচার্ডসকে আদর্শ মেনে চলা গিবস ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দারুণ প্রতিভাবান। স্কুল দলের হয়ে রাগবি, ফুটবল আর ক্রিকেট তিনটি খেলাই খেলেছেন চুটিয়ে। একবার রাগবি খেলতে গিয়ে বাঁ-হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে ক্রিকেটই তাঁর ধ্যানজ্ঞান, ক্রিকেটেই গড়েন বসতি।
গিবসের আগ্রাসী, খুনে মেজাজের ব্যাটিং প্রোটিয়া দলটিকে সব সময়ই একটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ এনে দিত। নিজের দিনে বিশ্বের যেকোন বোলিং আক্রমণকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন তিনি। ছন্দে থাকা গিবস ঠিক কতটা ভয়ংকর রূদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারেন, সেটা তাঁর খেলা যারা দেখেছেন একমাত্র তারাই ভাল বলতে পারবেন।
টপ অর্ডারে বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি গিবস ছিলেন একজন বিশ্বমানের ফিল্ডার; জন্টি রোডসের যোগ্য উত্তরসূরি। জন্টির অবসরের পর তাঁর প্রিয় ‘ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট’ পজিশনে ফিল্ডিং উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে প্রোটিয়াদের ভাবতে হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও।
বলা হয়ে থাকে, আধুনিক ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ের সর্বোচ্চ মানদণ্ডটা জন্টির হাতেই গড়া। আর জন্টি রোডসের পর দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের ‘অবিসংবাদিত’ সেরা ফিল্ডার হার্শেল গিবস।
৩.
১৯৯৬ সালের অক্টোবরে নাইরোবিতে আয়োজিত চার জাতি টুর্নামেন্টে স্বাগতিক কেনিয়ার বিপক্ষে খেলেছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। অভিষেক ম্যাচে গিবস করেছিলেন মাত্র ১৭ রান।
এরপর ভারত সফরে গিয়ে টেস্ট অভিষেকটাও একই বছর, কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। ওয়ানডের মত টেস্ট অভিষেকেও মনে রাখার মত কিছু করতে পারেননি গিবস। দুই ইনিংসে করেছিলেন মাত্র ৩১ ও ৯ রান।
৪.
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পেতে সময় লেগেছে বেশ খানিকটা। ১৯৯৬ সালে অভিষেক কিন্তু প্রথম শতকের দেখা পান ১৯৯৯ সালে।
১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে পোর্ট এলিজাবেথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি (১২৫)। এর মাত্র মাস দেড়েকের মধ্যেই ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। এবং তা ছিল একেবারে ডাবল সেঞ্চুরি (২১১*)। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে ঠিক তার পরের টেস্টেই পেয়ে যান আরও একটি সেঞ্চুরি (১২০)। ওই সিরিজের চার ইনিংস থেকে ১২১.৬৭ গড়ে গিবসের সংগ্রহ ছিল ৩৬৫ রান।
৫.
১৯৯৯ বিশ্বকাপের প্রোটিয়া দলটা ছিল বেশ শক্তিশালী ও দারুণ ভারসাম্যপূর্ন। সেই দলের অপরিহার্য অংশ ছিলেন হার্শেল গিবস। টুর্নামেন্টের ৯ ম্যাচে ১ সেঞ্চুরি আর ২ ফিফটিতে তিনি সংগ্রহ করেন ৩৪১ রান।
ওপেনিং জুটিতে গিবসের সঙ্গী ছিলেন বাঁ-হাতি গ্যারি কার্স্টেন। লেফট হ্যান্ড-রাইট হ্যান্ড কম্বিনেশনে দারুণ জমেছিল দুজনের কেমিস্ট্রি। হার্ডহিটার গিবসের ‘মারমার কাটকাট’ ব্যাটিং স্টাইলের সাথে চমৎকার মানিয়ে গিয়েছিল কার্স্টেনের শান্ত সৌম্য ধীরস্থির খেলার ধরন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই দলকে দারুণ সূচনা এনে দিতেন তাঁরা।
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে একটি বিশেষ কারণে সমালোচিতও হয়েছিলেন গিবস। হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুপার সিক্সের গুরুত্বপূর্ন এক ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে ‘সহজতম সুযোগ’ হাতছাড়া করেছিলেন গিবস। ল্যান্স ক্লুজনারের বলে স্টিভ ওয়াহর ‘ইনসাইড এজ’ থেকে ওঠা ‘লোপ্পা’ ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন মিড উইকেটে দাঁড়ানো ফিল্ডার হার্শেল গিবস। কথিত আছে, গিবসের হাতে জীবন ফিরে পেয়ে স্টিভ নাকি বলেছিলেন, ‘বাছা, তুমি তো বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে!’ পরে অবশ্য জানা গেছে ওটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়।
বলাবাহুল্য, ব্যক্তিগত ৫৬ রানে পাওয়া সেই ‘জীবন’ কাজে লাগিয়ে সেঞ্চুরি করেছিলেন স্টিভ এবং ম্যাচটাও জিতেছিল তাঁর দলই। গিবসের ‘শিশুতোষ’ ভুলের মাশুল গোটা দলকেই গুনতে হয়েছিল বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ার মধ্য দিয়ে! কেননা ওই ম্যাচ না জিতলে অস্ট্রেলিয়ার সেমিতে ওঠাই হত না! সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার সাথে নাটকীয়ভাবে ম্যাচ ‘টাই’ করে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল খালি হাতে।
৬.
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ড্রেসিংরুমে মাদক সেবনের ‘গুরুতর’ অভিযোগ ওঠে গিবসের বিরুদ্ধে। আরও কয়েকজন সতীর্থের সাথে মিলে নিষিদ্ধ নেশা জাতীয় দ্রব্য ‘মারিজুয়ানা’ সেবনের দায়ে অভিযুক্ত গিবসকে আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছিল। তবে গিবসের বিরুদ্ধে সবচাইতে ভয়ংকর অভিযোগটা উঠেছিল পাতানো খেলা নিয়ে।
অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের সাথে ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে গিবসের নামটাও জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে ক্রিকেট দুনিয়ায়। অভিযোগের শুনানিতে গিবস অবশ্য নিজে মুখে স্বীকার করেছিলেন সবকিছু। ক্রনিয়ের প্রস্তাবেই ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে একটি ওয়ানডেতে ১৫ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে অল্প রানে (২০ রানের কমে) নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসতে রাজি হয়েছিলেন গিবস!
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, তিনি খেলার সময় সেই অনৈতিক চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে যান এবং অল্প রানে আউট হওয়ার বদলে করে বসেন ৭২ রান! যে কারণে তিনি কোন টাকাও পাননি। তবে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা (সিএসএ) মোটেই হালকাভাবে নেয়নি বিষয়টা। ছয় মাসের জন্য গিবসকে সব রকমের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল তারা।
ছয় মাসের বিরতি শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিবস ফিরে আসেন একজন ধারাবাহিক রান সংগ্রাহকের ভূমিকায়। দলে নিজের হারানো জায়গাটা ফিরে পেতে খুব বেশি সময় লাগে নি তাঁর।
৭.
২০০২ সালে ওয়ানডেতে টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়ে রেকর্ডবুকে নাম লেখান জহির আব্বাস ও সাইদ আনোয়ারের পাশে। তবে বড় আক্ষেপ ছিল, অল্পের জন্য টানা চার ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে না পারাটা।
প্রথম দুটো সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে কেনিয়া (১১৬) ও ভারতের (১১৬*) বিপক্ষে; এরপর দেশে ফিরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই সেঞ্চুরি (১৫৩)। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে অপরাজিত ছিলেন ৯৬ রানে। দলের জয়ের জন্য যখন লাগে আর মাত্র ৪ রান, ঠিক তখনই ইচ্ছে করে ওয়াইডসহ ৫ রান দিয়ে দেন অলক কাপালি। ফলে সেঞ্চুরির সুযোগটাই আর থাকে না। তাতে বাংলাদেশের কোন লাভ না হলেও, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা চার ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির সুবর্ণ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন গিবস।
৮.
টেস্ট ক্রিকেটে গ্রায়েম স্মিথের সাথে মোট ‘তিনটি’ তিন শতাধিক রানের ওপেনিং জুটির অংশীদার হলেন হার্শেল গিবস।
- ২০০৩ সালে কেপটাউনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৬৮
– ওই টেস্টেই নিজের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নেন গিবস; খেলেন ২৪০ বলে ২২৮ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস (২৯ চার ও ৭ ছয়)।
- ২০০৩ সালে এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৩৮
– ওই ইনিংসেই টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন গ্রায়েম স্মিথ (২৭৭)। গিবসের ব্যাট থেকে আসে ১৭৯ রান।
- ২০০৪ সালে সেঞ্চুরিয়নে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩০১
– অল্পের জন্য ক্যারিয়ারের তৃতীয় দ্বিশতক হাতছাড়া করেছিলেন হার্শেল গিবস। ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ থেকে মাত্র ৮ রান দূরে থাকতে আউট হয়ে যান তিনি।
৯.
২০০৩ সালে ইংল্যান্ড সফরে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ২ সেঞ্চুরিসহ ৫৩.১১ গড়ে গিবস করেছিলেন ৪৭৮ রান।
কেনিংটন ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টে গিবস খেলেছিলেন ২৫৮ বলে ১৮৩ রানের অনবদ্য একটি ইনিংস যার ১৪৬ রানই (৭৯.৭৮ শতাংশ) এসেছিল বাউন্ডারি থেকে (৩৫টি চার ও ১টি ছক্কা)। গিবসের নিজস্ব অভিমত অনুযায়ী, এটাই তাঁর ক্যারিয়ার সেরা টেস্ট ইনিংস।
২০০৩ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার হতাশাজনক বিদায়েও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলেন গিবস। ৬ ম্যাচে ১ সেঞ্চুরি আর ২ ফিফটিতে ৯৬.০০ গড়ে করেছিলেন ৩৮৪ রান। সর্বোচ্চ ১৪৩ রানের ইনিংসটা এসেছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।
১০.
২০০৫ সালে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২ সেঞ্চুরিতে ৭১.২ গড়ে গিবস করেছিলেন ৩৫৬ রান।
তবে গিবসকে টপকে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ হয়েছিলেন ১৫১.৩ গড়ে ৪৫৪ রান করা ইংল্যান্ডের কেভিন পিটারসেন।
১১.
২০০৬ সালে জোহানেসবার্গে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক রান চেজের কথা কোনদিন ভোলা সম্ভব নয়। অস্ট্রেলিয়ার করা ৪৩৪ রান তাড়া করতে নেমে অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের (৫৫ বলে ৯০) সঙ্গে তৃতীয় উইকেট জুটিতে মাত্র ২০ ওভারে তুলেছিলেন ১৮৭ রান! চোখ জুড়ানো অপূর্ব সব স্ট্রোকের পসরা সাজিয়ে ২১ চার ও ৭ ছক্কায় গিবস খেলেছিলেন ১১১ বলে ১৭৫ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস। অসম্ভব এক লক্ষ্যকেও সেদিন সম্ভব মনে করাতে বাধ্য করিয়েছিল যে ইনিংস!
সেদিন গিবসের ভয়ংকর রুদ্রমূর্তির সামনে বড্ড দিশেহারা লাগছিল অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের। উইকেটের চারপাশে অনায়াসে খেলছিলেন অবিশ্বাস্য সব শট! সবাই ভেবেছিল ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটা বুঝি সেদিনই করে ফেলবেন গিবস! কিন্তু ডাবল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ২৫ রান দূরে থাকতে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের বলে ব্রেট লির হাতে ধরা পড়লেন তিনি।
অথচ ইনিংস শেষ হতে তখনো বাকি প্রায় ১৮ ওভার! ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে গিবসের খেলা অসাধারণ এই ইনিংসটি নিঃসন্দেহে ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ইনিংসগুলোর একটি।
১২.
পরের বছর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে গিবস ঘটিয়ে ফেলেন এক অবিশ্বাস্য কীর্তি! ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়েন এক ওভারে ছয় ছক্কা হাঁকানোর বিশ্বরেকর্ড! ‘অসহায়’ ডাচ লেগ স্পিনার ডান ফন বুঙ্গের করা একে একে ছয়টি ডেলিভারিকেই নির্দয়ভাবে সীমানা ছাড়া করেছিলেন গিবস!
২০০৭ বিশ্বকাপে চার ফিফটিতে ৫৭ গড়ে গিবসের সংগ্রহ ছিল ৩৪২ রান। অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে আরও একবার প্রোটিয়াদের বিদায় নিতে হয়েছিল সেমিফাইনাল থেকেই।
১৩.
২০০৭ সালে ঘরের মাঠে আয়োজিত আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-২০-র উদ্বোধনী আসরের প্রথম ম্যাচেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছিলেন গিবস। গেইলের করা ১১৭ রানের ঝোড়ো সেঞ্চুরির উপর ভর করে রানের পাহাড় গড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০৬ রানের বিশাল টার্গেটে খেলতে নেমে ১৪ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো গিবসের ৫৪ বলে ৯০ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংসের সৌজন্যেই ৮ উইকেটের সহজ জয় পায় প্রোটিয়ারা।
১৪.
২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকেই দিকে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের আত্মবিশ্বাস ও ফর্ম দুটোই হারাতে থাকেন গিবস। রান খরায় ভুগতে থাকা গিবস এক সময় বাদই পড়ে যান দল থেকে। ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ডারবানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেলা ম্যাচটিই হয়ে আছে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। সর্বশেষ টেস্ট ইনিংসে গিবস করেছিলেন ৪ বাউন্ডারিতে ২৭ রান।
টেস্ট দলে ঢোকার দরজাটা গিবসের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলেও ওয়ানডে ফরম্যাটে আরো বেশ কিছুদিন খেলা চালিয়ে গেছেন তিনি। তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ২০০৯ সালে বাজে ফর্মের কারণে ওয়ানডে দল থেকেও ছেঁটে ফেলা হয় তাঁকে।
২০১০ সালে ক্যারিয়ারে শেষ বারের মত একটা কামব্যাক করার চেষ্টা করেছিলেন বটে তবে সেটাও ছিল ক্ষণিকের জন্য। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচে তিনি করেছিলেন যথাক্রমে ২৭ ও ৮ রান। আহমেদাবাদে শেষ ওয়ানডেতে আর ব্যাটিংয়ের সুযোগই পান নি।
২০১১ বিশ্বকাপটা খেলতে চেয়েছিলেন খুব করে; কিন্তু বোর্ডের আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে নি।
১৫.
১৪ বছরের বর্নাঢ্য ক্যারিয়ারে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিলিয়ে গিবস রান করেছেন ১৪০০০ এর উপরে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। এছাড়া দুর্দান্ত ফিল্ডার হিসেবে আলাদা ‘খ্যাতি’ অর্জন করা গিবসের ঝুলিতে রয়েছে ২১০ টি ক্যাচও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টপ অর্ডার (মূলত ওপেনার) ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন ৯০ টেস্ট এবং ২৪৮ ওয়ানডে। টেস্টে ১৫৪ ইনিংসে ৪১.৯৫ গড়ে তিনি রান করেছেন ৬১৬৭। ২৬টি ফিফটির পাশাপাশি সেঞ্চুরি করেছেন ১৪টি যার মধ্যে ডাবল সেঞ্চুরি আছে দুটি। সর্বোচ্চ স্কোর ২২৮ পাকিস্তানের বিপক্ষে।
আর ওয়ানডেতে ২৪০ ইনিংসে ৩৬.১৩ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ৮০৯৪ রান; স্ট্রাইক রেট ৮৩.৭৬। সেঞ্চুরি করেছেন ২১টি, ফিফটি আছে ৩৭টি। সর্বোচ্চ রান ১৭৫ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
এছাড়া ২৩ ম্যাচের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৩ ফিফটিসহ ১২৫.৮ স্ট্রাইক রেটে গিবসের অর্জন ৪০০ রান।
১৬.
ক্রিকেট বিশ্বে একই সাথে ‘নন্দিত’ ও ‘নিন্দিত’ প্রোটিয়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান এই ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারটা শেষ হয়েছে অতৃপ্তি নিয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেয়ার সুযোগটাও পাননি তিনি। অবশ্য এর জন্য অনেকাংশে তিনি নিজেই দায়ী। বেপরোয়া অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত গিবসের ক্যারিয়ারজুড়ে নিত্যসঙ্গী হিসেবে পিছু লেগে থাকা বিতর্কই ছিল প্রধান কারণ।
২০১০ সালের নভেম্বরে বিতর্কিত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘টু দ্য পয়েন্ট: দ্য নো-হোল্ডস-বেয়ার্ড অটোবায়োগ্রাফি’ প্রকাশ করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন গিবস। বিস্ফোরক এই বইয়ের মাধ্যমে উঠে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের অন্ধকার জগতের কথা। সতীর্থ কয়েকজন ক্রিকেটার সম্পর্কেও আপত্তিকর ও বেফাঁস তথ্যের উল্লেখ ছিল বইটিতে। এছাড়া তাঁর বিতর্কিত লাইফস্টাইল, মদ্যপান, যৌনতা, মাদকসহ বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও ছিল খোলামেলা আলোচনা।
মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে বিক্রি হয়ে হয়েছিল বইটির ১৫,০০০ কপি!
বিতর্কিত এই আত্মজীবনী সম্পর্কে গিবসের বক্তব্য ছিল, ‘আমি এমন করেছি কারণ ভিন্ন ধরণের পাঠকরা এটা পড়তে আগ্রহবোধ করেন। আমি অনেককে বলতে শুনেছি যে তাঁর আন্দ্রে আগাসি পড়েছেন স্রেফ তাঁর খোলামেলা বক্তব্যের জন্য, আমিও ঠিক তাই করেছি।’
এ ঘটনায় বোর্ড কর্মকর্তা ও সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর এক প্রকার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বইটি প্রকাশের পরপরই সিএসএ গিবসের সঙ্গে তাদের কেন্দ্রীয় চুক্তি বাতিল করেছিল; এবং সেটা মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার আগেই। পরে অবশ্য এ নিয়ে গিবসের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তাঁরা।
১৭.
ইএসপিএন ক্রিকইনফোতে প্রকাশিত এক সাক্ষাতকারে গিবস কথা বলেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে কঠিন বোলার সম্পর্কে। তিনি হলেন পাকিস্তানের সাবেক গতি তারকা শোয়েব আখতার।
গিবসের ভাষ্যমতে, ‘যদিও আমি ফাস্ট বোলারদের স্বাচ্ছন্দেই মোকাবেলা করতাম, তবে ওর (শোয়েব আখতার) অ্যাকশ আমাকে বিভ্রান্ত করত। এটা কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। বাতাসের ভেতর ওর বলগুলো ছিল তুখোড়। আর ওর চেয়ে গতিশীল তো হওয়া সম্ভবও নয়।’
১৮.
হার্শেল গিবসের ‘উঁচু কলারের’ রহস্য কী জানেন? ছোটবেলায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তী স্ট্রাইকার এরিক ক্যান্টোনার দারুণ ভক্ত ছিলেন গিবস। সাবেক এই ফরাসি ফুটবল তারকার অনুকরণেই ক্রিকেট মাঠে জার্সির কলারটা উঁচু করে রাখতেন সব সময়।
১৯.
ক্রিকেটের বাইরে গিবসের সবচেয়ে পছন্দের খেলা হচ্ছে গলফ। অবসর পেলেই ছুটে যান গলফ কোর্সে। তাঁর পছন্দের সেরা তিনজন ক্রীড়াব্যক্তিত্বকে নিয়ে একটি প্রীতি গলফ ম্যাচ খেলার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন একবার। এরা হলেন টাইগার উডস, স্যার ভিভ রিচার্ডস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
২০.
শেষ করব একটি মজার ঘটনা দিয়ে। সতীর্থরা আদর করে গিবসকে ডাকতেন ‘স্কুটার’ নামে। এই নামটা অবশ্য তাঁকে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক কোচ এরিক সিমন্স।
গিবস প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার বয়স তখনও হয়নি। গাড়ি চালাতেও জানতেন না। কিন্তু গিবসের খুব শখ ছিল গাড়ি । তো একদিন কোচ তাঁর ছাত্রদের উদ্দেশ্যে মজা করে বলেছিলেন, ‘ওকে (গিবসকে) বরং একটা স্কুটার কিনে দাও।’
এরপর থেকে সবাই মজা করে এই নামেই ডাকত তাঁকে।