এবারের ইউরোতে প্রবেশ করার আগে সামনে বড় একটা রেকর্ডের হাতছানি নিয়ে শুরু করেছিল তারা। টানা ২৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলতে না পারার গ্লানি রবার্তো ম্যানচিনি ঘুচিয়েছিলেন ক্রমাগত জয় দিয়ে। ম্যানচিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আর হারের দেখা পায়নি তারা। সেই যাত্রা শেষ করেছে তারা শীর্ষে থেকেই। ইউরোতে টানা ৭ ম্যাচ অপরাজিত থেকে সেই রেকর্ড এখন ৩৪-এ।
রাই বলে ভাববেন না সর্বোচ্চ জায়গাটা ছুঁয়ে ফেলেছেন তারা, তাদের আগেও হেভিওয়েট নাম আছে বৈকি। আন্তর্জাতিকে সর্বোচ্চ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডে নাম আছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন, ফ্রান্সের।
- ইতালি – ৩০ ম্যাচ
১৯৩৫ সালের অক্টোবরে চেকোস্লোভাকিয়াকে ২-০ গোলে হারিয়ে শুরু হয় আরুজ্জিদের যাত্রা। এরপর টানা ৩০-ম্যাচ অপরাজিত ছিল তারা। এর মধ্যে ছিল দুই বিশ্বকাপ শিরোপা। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপ শিরোপাও তারা জিতেছিল এই অপরাজিত থাকার দৌড়ের মাঝেই। শুধু বিশ্বকাপ নয় ১৯৩৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হওয়া অলিম্পিকে স্বর্ণ জয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল এতে।
যদিও এর সাথে ভাগ্যের ছোঁয়া ছিল ইতালির সাথে। ১৯৩৭ সালে অস্ট্রিয়ার এক ম্যাচে ২-০ গোলে পিছিয়ে ছিল ইতালি। ম্যাচের মাত্র ১৬ মিনিট বাকি থাকতে এক সংঘর্ষে পণ্ড হয়ে যায় ম্যাচ। যে কারণে পিছিয়ে থেকেও ফলাফল আসেনি সে ম্যাচে। যার দরুণ তৈরি হয় এই রেকর্ড শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালে এসে সুইজারল্যান্ডের কাছে হেরে শেষ হয় তাদের যাত্রা।
- ফ্রান্স – ৩০ ম্যাচ
তালিকার এই দলটার নাম একটু অন্যভাবে বলতে হবে। বলতে পারেন ২ বারের বিশ্বজয়ী দলকে কেন অন্যভাবে বলতে হবে আমাকে? কারণ এই দলটার অবস্থান এই তালিকার অন্য সকল দল থেকে আলাদা। ফ্রান্সই এই তালিকার একমাত্র দল যারা অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না জিতে।
লেস ব্লুজদের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে। টানা দুই বিশ্বকাপ খেলতে না পারার হ্লানি ছিল সকল খেলোয়াড়দের মধ্যেই, তাই নতুন করে রিবিল্ড করা দলকে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল ছিল তারা। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতালিকে ১—০ গোলে হারিয়ে শুরু হয় তাদের যাত্রা। নতুন করে গড়া দলে ছিলেন সকলে, দেশমের অধীনে জিদান, থুরাম, বার্গক্যাম্প সকলেই। সেই থেকে ১৯৯৬ ইউরোর সেমি পর্যন্ত মোট ৩০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অপরাজিত থাকে ফ্রান্স।তাদের যাত্রা শেষ হয় সেমিতে চেক রিপাবলিকের কাছে হেরে। কোন ট্রফি ছাড়াই অপরাজিত থাকার রেকর্ড শেষ করে ফ্রান্স!
- আর্জেন্টিনা – ৩১ ম্যাচ
তালিকার তৃতীয়তে আছে আর্জেন্টিনা দল। সেটা তাদের শেষ শিরোপা জেতার সময়ে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ২ বছরে মোট ৩১ ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার অধীনের সেই দলকে বলা যায় আর্জেন্টিনা ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল।
তাদের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে। পশ্চিম জার্মানির কাছে শিরোপা হারানোই ছিল তাদের শেষ হার। আর এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের অপরাজিত যাত্রা। হাঙ্গেরির বিপক্ষে ২-০ গোলে জয় দিয়ে শুরু হয় তাদের যাত্রা। ১৯৯১, ১৯৯৩ কোপা আমেরিকাও নিজেদের করে নেয় সেই সুবাদে। পুরো সময়টা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও অপরাজিত ছিল আর্জেন্টিনা। ২ বছরের জন্য সবচেয়ে বেশিদিন অপরাজিত থাকার রেকর্ডটাও ছিল তাঁদের।
- ইতালি – ৩৪ ম্যাচ
তালিকাত তৃতীয় নামটা হচ্ছে ইতালির। রবার্তো ম্যানচিনির অধীনে তাদের এই উত্থান তো সকলেরই দেখা। ২০১৮ বিশ্বকাপে উঠতে না পারা ছিল ইতালির ইতিহাসের অন্যতম বাজে সময়। মুখের ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না সে লজ্জা। সেই লজ্জা থেকে বাঁচতে রবার্তো ম্যানচিনির হাতে দায়িত্ব তুলে দেয় ইতালি বোর্ড।
ইতালির ডিফেন্সিভ ফুটবলকে আপাদমস্তক পাল্টে ফেলেন তিনি। পুরোপুরি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা শুরু করেন এই ইরালিকে নিয়ে। প্রথমদিকে নিন্দুকেরাই সমালোচনা শুরু করেছিল, কিন্তু যেই না ফলাফল আসতে শুরু করলো সেখান থেকেই বন্ধ সকলের কথা। তারা নিজেদের শেষ হার দেখেছিল পর্তুগালের কাছে ২০১৮ সালের ন্যাশনস লিগে। এরপর থেকে আর কোনো ম্যাচেই হারতে হয়নি আরুজ্জিদের। সেখান থেকে অবিস্মরণীয় এক ইউরো জয় সম্পন্ন করেছে ম্যানচিনির শিষ্যরা।
- স্পেন – ৩৫ ম্যাচ
স্পেন বললেই প্রথমে মনে পরে তাদের স্বর্ণযুগের কথা। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ফুটবল বিশ্বে যে তান্ডব চালিয়েছে স্পেন, তার কোন তুলনাই হয় না। লুইস অ্যারাগোনেস এরপর ভিসেন্তে দেল বস্কের অধীনে চালিয়ে গিয়েছে সেই রাজত্ব।
কে ছিলেন না সেই দলে। দলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই ছিল তারকায় ভরপুর। কিন্তু তাদের এই ৩৫ ম্যাচ জয়ের রেকর্ড সে সময়টায় আসেনি, এসেছে তার শুরুতে। ২০০৭ সাল থেকে শুরু হয় তাদের জয়যাত্রা, জার্মানিতে ১-০ গোলে হারিয়ে। ইনেয়স্তার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল ছিল সেটি। এরপর থেকে পুরো ইউরো কাঁটায় কোনো হার ছাড়াই। ২০১০ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বও অপরাজিত থেকে কাঁটায় স্পেন। কিন্তু তাদের পা কাটে পচা শামুকে। ২০০৯ কনফেডেরেশান কাপের সেমিফাইনালে আমেরিকার সাথে হেরে অবসান ঘটে তাদের রাজত্ব্যের।
হেরে গেলেও তাদের আধিপত্য শেষ হয়নি। এরপরেও টানা বিশ্বকাপ-ইউরো জিতে নেয় স্পেন। মাত্র একটি ম্যাচের জন্য রেকর্ডটি এককভাবে তাদের হয়নি।
- ব্রাজিল – ৩৫ ম্যাচ
আন্তর্জাতিক ফুটবল ইতিহাসে এখনও সর্বোচ্চ জায়গাটি দখল করে রেখেছে ব্রাজিল। ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত ছিল তারা। মারিও জাগালোর অধীনে সেই ব্রাজিলকে ধরা হয় ইতিহাসের অন্যরম শোক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে। টানা ৩ বছর কোনো হারের মুখ না দেখা সেই দলে ছিলেন সময়ের সেরা তারকারা। দুঙ্গার নেতৃত্বে খেলতেন রোমারিও, বেবেতোরা। মাঠে নামার আগেই যেন হাত স্বীকার করে নিতো প্রতিপক্ষ দল। যাত্রা শুরু হয় বিশ্বকাপের প্রস্যুতি ম্যাচ থেকে। ১৯৯৩ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানির বিপক্ষে ২-১ গোলে হারে ব্রাজিল। সেই থেকে শুরু।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ জিতে কোনো ম্যাচ না হেরেই। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের পর ১১ ম্যাচের মধ্যে ১০টিতেই জয় তুলে আনে তারা। এর মধ্যে ছিল ১৯৯৫ কোপা আমেরিকা শিরোপাও। শেষ পর্যন্ত তাদের পা কাটে পচা শামুকে। ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙ্গে যায় মেক্সিকোর কাছে এসে। ১৯৯৬ সালে গোল্ড কাপের ম্যাচে মেক্সিকোর সাথে ২-০ গোলে হেরে নিজেদের রেকর্ড বিসর্জন দিতে হয় তাদের।
ইতালির সামনে ইউরোতে আর ম্যাচ আছে ৪ টি। ইতোমধ্যে শীর্ষ পাঁচে জায়গা হয়ে গিয়েছে তাদের। এখন শুরু দেখার অপেক্ষা এই তালিকার শীর্ষে উঠতে পারবে কি তারা? নাকি ফ্রান্সের মতন শিরোপা ছাড়াই এই তালিকাতে নাম লেখাতে হবে তাদের। সে প্রশ্নের উত্তর দিবে সময়ই।