টানা দ্বিতীয়বারের মত ফাইনালে উঠে এসেছে ফ্রান্স; ফরাসিদের এমন সাফল্যের রূপকারদের কথা বললে সবার আগে নাম আসবে কিলিয়ান এমবাপ্পের, কেউ হয়তো স্মরণ করবে অলিভার জিরুদ, অরেলিয়েন শুয়েমেনিকে। কিন্তু ফ্রান্সের এমন সাফল্যের নেপথ্যে থাকা একজনের নাম কেন যেন আড়ালেই পড়ে থাকে; তিনি আঁতোয়ান গ্রিজম্যান।
পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই দুর্দান্ত ছন্দে আছেন আঁতোয়ান গ্রিজম্যান। প্রতিপক্ষের রক্ষণে আঘাত করার মূল কাজটা তিনিই করেন; বলা যায়, ফরাসিদের আক্রমণভাগের সুতো গ্রিজম্যানের হাতে রয়েছে। অনেকটা পুতুল নাচের মতোই আড়ালে থেকেই দলের আক্রমণভাগকে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।
ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের সবসময়ই বিশ্বাস করতেন আঁতোয়ান গ্রিজম্যান মিডফিল্ডার হিসেবে সবচেয়ে কার্যকরী। তাই বিশ্বকাপে কিছুটা নেমে এসে প্লে-মেকিং করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এই ফুটবলারকে। কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল হয়নি তাঁর; প্রায় প্রতি ম্যাচেই প্রতিপক্ষের রক্ষণে ত্রাস সৃষ্টি করেছেন তিনি।
সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ক্রেইগ ফস্টার মনে করেন, ‘আঁতোয়ান গ্রিজম্যান এবারের বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার। টুর্নামেন্টের সিলভার বলটা গ্রিজম্যানের প্রাপ্য, কেননা গোল্ডেন বল ইতোমধ্যে লিওনেল মেসি তাঁর পারফরম্যান্স দিয়ে জিতে নিয়েছেন।’
এই অজি ফুটবলার আরো বলেন, ‘শুধু আক্রমণের ক্ষেত্রেই নয়, প্রেসিং এবং ডিফেন্ডিংয়ের ক্ষেত্রেও গ্রিজম্যান বেশ পরিশ্রম করেন। এমবাপ্পে ট্র্যাক ব্যাক না করায় যে বাড়তি চাপ পড়ে অন্যদের উপর সেটি ভালভাবেই সামলেছেন তিনি।’
বিশ্বকাপ শুরুর আগে আঁতোয়ান গ্রিজম্যানের ফর্ম ছিল হতাশাজনক। অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদে সুযোগ পাওয়াই তখন কঠিন হয়ে পড়েছিল তাঁর জন্য। কিন্তু জাতীয় দলে দেখা গিয়েছে নতুন এক গ্রিজম্যানকে। কোচ দেশমের অধীনে আত্মবিশ্বাসী, পারফর্মার গ্রিজিকেই দেখেছে ভক্ত-সমর্থকরা। তাঁর এমন ইতিবাচক পরিবর্তনে নি:সন্দেহে কোচের প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল।
আঁতোয়ান গ্রিজম্যানের গুরুত্ব মেনে নিতে দ্বিধা করেননি গুরু দিদিয়ের দেশম। তিনি বলেন, ‘সে (গ্রিজম্যান) এমন একজন খেলোয়াড় যে সবসময় নিজের চেয়ে দলকে বেশি প্রাধান্য দেয়। সে খুবই পরিশ্রমী ফুটবলার, সম্ভবত বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবলারদের চেয়ে বেশি। গত এক দশক ধরেই সেরা তারকাদের মাঝে রয়েছে গ্রিজম্যান।’
২০১৭ সালের পর থেকে দিদিয়ের দেশমের অধীনে টানা ৭২ ম্যাচ খেলেছেন আঁতোয়ান গ্রিজম্যান। এবং কাতার বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স কোচের সেই বিশ্বাস আর ভরসাকে আরো সুসংহত করেছে। বিশেষ করে সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে গোল না করেও প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ জিতে নিয়েছেন গ্রিজম্যান, আর এটিই বিশ্বকাপে তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের হাইলাইটস হয়ে আছে।
ডিফেন্স লাইনের মাঝে স্পেস খুঁজে বের করা এবং সতীর্থদের জন্য গোল করার সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রে আঁতোয়ান গ্রিজম্যান অনন্য। এবারের বিশ্বকাপ আসরে ইতোমধ্যে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশের বেশি গোল করার সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। ক্লাবের জার্সিতে সময়টা ভাল না গেলেও এই তারকার দৃঢ় মানসিকতা তাঁকে ছন্দে ফিরতে সাহায্য করেছে।
গ্রিজম্যান তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে দেখিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। দেখিয়েছেন দলে যখন তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। ম্যাচের সবচেয়ে কঠিন মুহুর্তে তিনিই পারেন দলকে টেনে তুলতে। এবং এসমস্ত গুণাবলী পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই মাঠে প্রমাণ করেছেন গ্রিজম্যান। প্রতিপক্ষের প্রতিরোধ ব্যূহ ভাঙ্গার জন্য ফরাসিদের চাবি তিনি। এমবাপ্পে, জিরুদ, ডেম্বেলের সমন্বয়ে তৈরি ফ্রান্সের ভয়ঙ্কর আক্রমণের নেতৃত্বভারও তাঁর কাঁধে।
ইতালি এবং ব্রাজিলের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে টানা দুইটি বিশ্বকাপ জেতার সুযোগ এখন ফ্রান্সের সামনে। যদি ফরাসিরা আবার বিশ্বকাপ জিততে চায়, যদি তারা লিওনেল মেসিকে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ স্বপ্নকে অপূর্ণ রাখতে চায়, তবে ফাইনালের মঞ্চে নিজেদের সেরাটা নিংড়ে দিতে হবে তাদেট৷ এক্ষেত্রে নিজস্ব প্লেমেকার আঁতোয়ান গ্রিজম্যানকে অনেক প্রয়োজন বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের।