সভ্যদের ‘ভব্যতা’ বিসর্জন

১৯৬৬ বিশ্বকাপ দিয়ে যেন ইংল্যান্ড তার শত বছরের অর্জিত ‘সভ্য’ নামটি ধুলোয় মিশে যেতে দিল শুধুমাত্র বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেওয়ার জন্যে। লাতিন আমেরিকার প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশ তাদের পত্রিকায় এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখতে থাকে। ইংল্যান্ড এগুলো সরাসরি তেমন কোনো প্রতিবাদও করে নি, কেবল নিজেদের মিডিয়ার মাধ্যমে একচেটিয়া নিজ গুণগান গেয়ে গেছে। হয়ত ভেবেছিল সময়ের সাথে মানুষ তা ভুলে যাবে। কিন্তু ইতিহাস কখনো কোনো কিছু ভুলে না। কোনো না কোনো সময় একটি ছোট ঘটনা আবারও সব সামনে নিয়ে আসে।

আরো একবার ওয়েম্বলি। আরো একটি ফাইনাল। আরো একবার ইংল্যান্ড। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালও ছিল এই ভেন্যুতে, এবারের ইউরোর ফাইনালও সেই একই ভেন্যুতে। কেমন ছিল সেই বিশ্বকাপ?

১৯৬৬ বিশ্বকাপ সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিশ্বকাপগুলোর একটি। বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়াটাই ইংল্যান্ডের জন্যে মূল কথা ছিল না। কুটনৈতিক দিক দিয়েও এই আসরটি ইংল্যান্ড এর জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান প্রভাব কমে যাওয়ার কারণেও ইংল্যান্ড এর কাছে এই আসরটি সফল আয়োজন ও যেকোনোভাবে শিরোপা জেতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বেই পুরো বিশ্ব এক মস্তবড় ধাক্কা খায়। গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় আগের দুই বারের চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই পেলে কে খুবই বাজেভাবে ট্যাকল করা হয়, পরের ম্যাচে শক্তিশালী হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তিনি নামতেই পারেননি, সে ম্যাচ এ ব্রাজিল এর দুটি গোল বাতিলও হয়। তৃতীয় ম্যাচেও পর্তুগালের বাজে ট্যাকলের শিকার হন পেলে।

তাছাড়া ব্রাজিল দল কেই যেন প্র্যাকটিস মাঠ থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বকাপে এমনভাবে বিভিন্ন অসুবিধায় ফেলা হচ্ছিল যেন শুধু তাদের আটকালেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতে যাবে। দেশে ফিরে পেলে ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ও তোলেন।

এই বিশ্বকাপে অনেক কিছুই প্রথম ছিল। সাদাকালো থেকে প্রথম রঙিনপর্দার বিশ্বকাপ, প্রথম মাসকট এর ব্যবহার, অনেক প্রথমের জন্ম দিয়েছিল এই বিশ্বকাপ। তবে তারপরেও বিশ্ব কেন যেন এই বিশ্বকাপকে ইংল্যান্ড এর মত করে মনে করে না।বরং মনে রাখে বাজে রেফারিং এর জন্যে। পুরো বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক রেফারিং এর দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

২৩ জুলাই। আরো এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টার ফাইনাল এর চারটি খেলাই একই দিনে বিকাল তিনটায় রাখা হলো।তার মধ্যে একটি ম্যাচে পশ্চিম জার্মানির প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে, সে ম্যাচের প্রধান রেফারি ইংলিশ। অন্য ম্যাচ এ ইংল্যান্ড এর প্রতিপক্ষ আর্জেন্টিনা, সে ম্যাচের প্রধান রেফারি পশ্চিম জার্মান। আসলেই কি কাকতালীয়!

এবং দুই ম্যাচেই উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা হেরেছে।আর্জেন্টিনার এক প্লেয়ারের সাথে জার্সি বদল করার সময় ইংল্যান্ডের জর্জ কোহেনকে ইংল্যান্ড এর ম্যানেজারের বাঁধা দেওয়ার ঘটনা এখনো সমালোচকদের মুখে লেগে আছে।

কোয়ার্টার ফাইনালে হারার পরে বাজে রেফারিং এর কথা বিশ্বকে জানাতে উরুগুয়ের দুই খেলোয়াড় অভিনব পন্থা গ্রহণ করেন। তারা দুই ইংলিশ শিশুর অটোগ্রাফ খাতায় স্প্যানিশ ভাষায় লিখে দেন – ‘রেফারি একজন চোর’, এবং ‘জার্মান ক্রিমিনালরা উরুগুয়ের কাছ থেকে ম্যাচ চুরি করে নিয়ে গেছে।’ যা তখন বেশ আলোড়ন তুলে।

ইংলিশ কর্তৃপক্ষ মিডিয়া কভারেজকেও নিজেদের কবজায় নিয়ে নেয়। যেখানে প্রতি ম্যাচে ১৪ জন ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার থাকতে পারত, সেখানে বাকি দেশগুলো থেকে মাত্র দুজন করে প্রতি ম্যাচে অনুমতি পেয়েছিল। পরে ব্রাজিলের পক্ষ থেকে জানানো হয় তারা শুধু স্ট্যান্ড এ অতিরিক্ত ফটোগ্রাফার রাখবে, তখনো অর্গানাইজিং কমিটি থেকে জানানো হয় যদি এমন কাউকে পাওয়া যায় তাহলে তাদের স্ট্যাডিয়াম থেকে বের করে দেওয়া হবে।

তাছাড়া তখন জাতীয় পতাকা নিয়েও ইংল্যান্ড গড়িমসি করে। বার্মিংহামে সকল অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পতাকা প্রদর্শনের সময় আবার নামিয়ে নিতে হয় কারণ হাঙ্গেরি ও আর্জেন্টিনার পতাকা ভুল উত্তোলন করা হয়েছিল।

অনেক ম্যাচই নির্ধারিত সময়ের দেরিতে শুরু হয়েছিল। আর্জেন্টিনার প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে কোনো গোলপোস্ট ছিল না। বিদেশী সাংবাদিকদের জন্যে পর্যাপ্ত টিকেট না থাকা, ভেন্যুর গন্তব্যের সব ট্রেনই প্রতিদিন দেরি করা, স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের টেলিফোন ঠিকভাবে কাজ না করা, টেলিগ্রাম পাঠানোর সুবিধা না দেওয়া সবাইকে, বিদেশি সাংবাদিকদের থাকার জন্যে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ঠিক করা হয়, যেখানে প্রেস সেন্টার থেকে যেতে আসতেই অনেক সময় অপচয় হতো। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার ছিল প্রতিদিন সকাল আটটায় তীব্র সাইরেন বাজিয়ে সবার ঘুম ভাঙানো। এ যেন চরম অনিয়মের একটি বিশ্বকাপ হয়ে দাড়িয়েছিল।

১৯৬৬ বিশ্বকাপ দিয়ে যেন ইংল্যান্ড তার শত বছরের অর্জিত ‘সভ্য’ নামটি ধুলোয় মিশে যেতে দিল শুধুমাত্র বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেওয়ার জন্যে। লাতিন আমেরিকার প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশ তাদের পত্রিকায় এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখতে থাকে। ইংল্যান্ড এগুলো সরাসরি তেমন কোনো প্রতিবাদও করে নি, কেবল নিজেদের মিডিয়ার মাধ্যমে একচেটিয়া নিজ গুণগান গেয়ে গেছে। হয়ত ভেবেছিল সময়ের সাথে মানুষ তা ভুলে যাবে। কিন্তু ইতিহাস কখনো কোনো কিছু ভুলে না। কোনো না কোনো সময় একটি ছোট ঘটনা আবারও সব সামনে নিয়ে আসে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...