নির্ভরতার সমরনায়ক

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়ার্ধে বোলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটিংয়েও ইমরানের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। প্রতিভার দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চারজনের মধ্যে উঁচু পর্যায়ের ব্যাটসম্যান হওয়ার মানসিকতা একমাত্র ইমরানেরই ছিল। এরই ফলে ক্যারিয়ার শেষে দেখতে পাওয়া যায় যে ইমরানের ব্যাটিং গড় চার জনের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে। ধীরে সুস্থে নিজের ইনিংসকে গড়ে তুলতেন ইমরান, তারপর পরিস্থিতি বুঝে গিয়ার পাল্টাতেন। এরই ফলে কপিল বা বোথামের ব্যাটিং বেশি চিত্তাকর্ষক হলেও ব্যাটসম্যান ইমরানের নির্ভরযোগ্যতা বোথাম বা কপিলের চেয়ে বেশি ছিল।

ইয়ান বোথাম – কপিল দেবকে নিয়ে যখন ক্রিকেট বিশ্ব যখন উচ্ছ্বসিত তখন বিশ্বের দুই প্রান্তে ইমরান খান এবং রিচার্ড হ্যাডলি নিজেদের গড়ে তুলছেন বিশ্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার লক্ষ্যে।

ক্যারিয়রের দ্বিতীয়ার্ধে দুজনেই অনেকটা বদলে ফেলেন নিজের বোলিং অ্যাকশন। তবে ইমরান যেখানে মিডিয়ম পেসার থেকে নিজেকে তুলে ধরেন ভয়াবহ ফাস্ট বোলার হিসেবে যিনি গতি এবং বাউন্সের সঙ্গে রিভার্স স্যুইং নামের অমোঘ অস্ত্রে পৃথিবীর বড় বড় ব্যাটসম্যানের ঘুম কাড়বেন, সেখানে হ্যাডলি লাইন – লেন্থ – নিয়ন্ত্রন আর সুইংকে মূলমন্ত্র করে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করবেন।

ইমরানের বিধ্বংসী বোলিঙের সর্বোত্তম প্রদর্শন দেখা যায় ১৯৮২-৮৩ মৌসুমের ভারত – পাক সিরিজে। উইকেট প্রতি ১৪ রান দিয়ে মোট ৪০টি উইকেট নেন ইমরান। সেই সঙ্গে ব্যাট হাতেও ২৪৭ রান করেন, গড় প্রায় ৬২। অনেকটা বোথামের অ্যাসেজের মতোই এই সিরিজটা ইমরানের সিরিজ নামে প্রচলিত ক্রিকেট বিশ্বে।

পাকিস্তান সিরিজ জিতে নেয় ৩-০ ব্যবধানে, দু’বার ম্যাচ সেরা হওয়া ছাড়াও সিরিজ সেরা হন ইমরান। সুনীল গাভাস্কার এবং মহিন্দার অমরনাথ ছাড়া প্রায় কেউই তেমন সুবিধে করতে পারেন নি ইমরানের সামনে। সিরিজে মোট ২৪ উইকেট নিলেও ইমরানের তুলনায় অনেকটাই নিস্প্রভ ছিলেন কপিল।

অবশ্য ১৯৭৯-৮০ সালের ভারত – পাক সিরিজে মূলত কপিলের দাপটে ২-০ ব্যাবধানে সিরিজ জিতেছিল ভারত। মাদ্রাজ টেস্টে দুই ইনিংস মিলে ১১টি উইকেট নেন কপিল, সঙ্গে একমাত্র ইনিংসে ঝড়ের গতিতে ৮৪ রান। প্রায় একই রকম পারফর্মেন্স আবার দেখা যায় ১৯৮২ সালের লর্ডস টেস্টে। দুই ইনিংস মিলে ১৩০ রান (তার মধ্যে ৫৫ বলে ৮৯ রানের বিধ্বংসী ইনিংসও ছিল) এবং বল হাতে ৮টি ব্রিটিশ উইকেট (সেই টেস্টে ইংল্যান্ডের মোট ১৩টি উইকেট পড়ে) নিয়ে ভারতের পরাজয়ের মধ্যেও উজ্জ্বল ছিলেন কপিল।

ক্রিকেট জীবনের আরম্ভে শুধু জোরে বল করতে চাইতেন ইমরান। ওনার সেই সময়ের বোলিং একশনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার জেফ টমসনের কিছুটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। তবে তখন ইমরানের বলে নিয়ন্ত্রন ছিল না বলে সাফল্যও ছিল কম।

ইংল্যান্ডে কলেজ এবং কাউন্টি ক্রিকেট খেলার সময় নিজের বোলিং একশন নিয়ে পরীক্ষা আরম্ভ করেন ইমরান। পেসের সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্ধর্ষ ইনস্যুইঙ্গার। বল হাতে প্রথম বড় সাফল্য আসে ১৯৭৬-৭৭ সালের সিডনি টেস্টে – ম্যাচে মোট ১২ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানকে জয় এনে দেন ইমরান।

এবং সেই টেস্টেই ক্রিকেট বিশ্ব দেখতে পায় তার নতুন ছন্দবদ্ধ বোলিং অ্যাকশন যার ক্লাইম্যাক্সে রয়েছে বল ডেলিভারির ঠিক আগে ব্যাটসম্যানের দিকে হাতের বল তাক করে সেই বিখ্যাত লাফ যা পরবর্তীকালে ইমরানের বোলিঙের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে বিধ্বংসী ফাস্ট বোলিঙেরও।

ইমরানের বোলিঙের আরও এক বিশেষত্ব ছিল পুরনো বলে রিভার্স স্যুইং করা। তবে এই ধরনের বোলিং ইমরানই প্রথম করেন নি। প্রথম শ্রেণী বা কাউন্টি ক্রিকেটে এই বোলিংয়ের প্রচলন বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ছিল তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রিভার্স স্যুইং আমদানি করার কৃতিত্ব দেওয়া হয় সত্তর দশকের পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার সরফরাজ নওয়াজকে।

রিভার্স স্যুইং বস্তুটা আসলে কী? সাধারণত নতুন বল স্যুইং করে বোলারের সিম ব্যাবহারের ফলে। যে কোনো একদিকে সিম বাঁকিয়ে রাখার জন্য বলের সিমেট্রি নষ্ট হয় এবং বলের একদিকে বায়ুর গতি অন্যদিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় বল স্যুইং করে। একটু পুরনো বলেও স্যুইং করে – এক্ষেত্রে স্যুইং হয় যে দিকে বলের চকচকে তল আছে তার বিপরীত দিকে।

রিভার্স স্যুইং করার জন্য বলকে এমন ভাবে বজায় রাখতে হয় যাতে বলের একদিক চকচকে থাকে, অপরদিক রুক্ষ। এর ফলে যে দিকে প্রথাগত স্যুইং হয়, পুরনো বল তার বিপরীত দিকে স্যুইং করে। অর্থাৎ রিভার্স স্যুইঙ্গের ক্ষেত্রে বল চকচকে তলের দিকে স্যুইং করে। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার ঘাসে ঢাকা মাঠ এবং পিচের তুলনায় উপমহাদেশের রুক্ষ মাঠে বল তাড়াতাড়ি পুরনো এবং এবড়োখেবড়ো হওয়ায় উপমহাদেশের পিচে রিভার্স স্যুইং বেশি কার্যকর। সাধারণত ৪০ উভারের পুরনো বল রিভার্স স্যুইঙ্গের জন্যে উপযুক্ত হলেও অনেক বোলারকেই ২০ ওভারের পুরনো বলেও রিভার্স স্যুইং করতে দেখা গেছে।

১৯৭৬-৭৭ সালে বারবিসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইমরান লক্ষ করেন যে সরফরাজ পুরনো বলে দারুণ স্যুইং করাচ্ছেন। তিনি সরফরাজের কাছ থেকে এর রহস্য জানতে চান। সরফরাজ জানান যে আগামীকাল তিনি তাকে নেটে এই শিল্প সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা দেবেন। নিজের কথা রেখেছিলেন সরফরাজ। শুধু ইমরানকেই তিনি রিভার্স স্যুইং শেখাননি, পাকিস্তানের ফিল্ডারদেরও শিখিয়েছিলেন কীভাবে বল মেন্টেন করলে বোলারদের পক্ষে রিভার্স স্যুইং করানো সহজ হবে।

১৯৭৭ সালের মেলবোর্ন টেস্টে ইমরান প্রথমবার এই নতুন আর্ট মেলে ধরেন বিশ্বের সামনে। দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেন ইমরান, তার মধ্যে চারজনই বোল্ড বা এল বি ডাবলু। তবে ইমরানের রিভার্স স্যুইংয়ের ভয়ংকরতম প্রদর্শন দেখা যায় ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালের করাচি টেস্টে।

প্রথম ইনিংসে ২৮৩ রানে পেছিয়ে পড়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে গাভাস্কর এবং ভেংসরকার মিলে ভারতের ইনিংস মেরামত করার কাজ আরম্ভ করেন। একসময় ভারতের স্কোর ছিল ১০২/১। এরপর আরম্ভ হয় ইমরানের জীবনের ভয়ংকরতম বোলিং স্পেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ভারতের স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ১১৮/৭।

গাভাস্কর বোল্ড হয়ে ফিরে যান ইমরানের লেট ইন স্যুইঙ্গারে। লেগ বিফোর হয়ে ফিরে যান মোহিন্দার অমরনাথ। তবে ইমরান তার শ্রেষ্ঠ বলটি করেন গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে প্রায় ষষ্ঠ স্ট্যাম্পের লাইন থেকে গোঁত্তা খেয়ে বলটি তুলে নেয় বিশ্বনাথের অফ স্ট্যাম্প। কাঁধের ওপর ব্যাট তুলে বলটি ছেড়ে দিয়েছিলেন ভিশি! ভারত ম্যাচ হারে ইনিংস এবং ৮৬ রানে। উচ্ছ্বসিত পাকিস্তানিরা ইমরানকে এফ – ১৬ নামে ডাকা আরম্ভ করলেন, যে নামের ফাইটার প্লেন কিনেছিল পাকিস্তান আমেরিকা থেকে।

ইমরানের পর ওয়াসিম আকরাম বা ওয়াকার ইউনিসও রিভার্স স্যুইঙ্গের উঁচু দরের শিল্পী ছিলেন। সেই সময়ে প্রায়ই দেখা যেত যে বিপক্ষ দলের ইনিংস হঠাৎ সম্মানজনক অবস্থা থেকে ধ্বসে পড়ল। তবে এই ধরনের বোলিং নিয়ে বিতর্কও কিছু কম হয় নি। বলকে পুরনো বা এবড়ো-থেবড়ো করার কাজ সবসময় নিয়ম মেনে করা হত না। এ কাজে কোল্ড ড্রিঙ্ক বোতলের ছিপি, পেরেক, কাচের টুকরো ইত্যাদিও ব্যবহার করা হত বলে অভিযোগ করত ব্যাটসম্যানেরা। আম্পায়াররাও নাকি বলের অবস্থা দেখে কিছুটা অনুমান করতে পারতেন কিন্তু বিতর্ক এড়াবার জন্যে এই ব্যাপারে বেশি জলঘোলা করতেন না।

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়ার্ধে বোলিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটিংয়েও ইমরানের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। প্রতিভার দিক দিয়ে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও চারজনের মধ্যে উঁচু পর্যায়ের ব্যাটসম্যান হওয়ার মানসিকতা একমাত্র ইমরানেরই ছিল। এরই ফলে ক্যারিয়ার শেষে দেখতে পাওয়া যায় যে ইমরানের ব্যাটিং গড় চারজনের মধ্যে সবচেয়ে ওপরে।

ধীরে সুস্থে নিজের ইনিংসকে গড়ে তুলতেন ইমরান, তারপর পরিস্থিতি বুঝে গিয়ার পাল্টাতেন। এরই ফলে কপিল বা বোথামের ব্যাটিং বেশি চিত্তাকর্ষক হলেও ব্যাটসম্যান ইমরানের নির্ভরযোগ্যতা বোথাম বা কপিলের চেয়ে বেশি ছিল।

নিজের টেস্ট ক্রিকেট জীবনের শেষ ১০ বছরের ৫১টি টেস্টে ইমরান ব্যাট হাতে পঞ্চাশের ওপরের গড়ে রান করেন। বল হাতে এই সময়ে তার গড় ছিল মাত্র ১৯। এতদিন ধরে ব্যাটিং এবং বোলিংয়ের এই পর্যায়ের ধারাবাহিকতা আমাদের আলোচ্য অলরাউণ্ডারদের মধ্যে একমাত্র ইমরানের মধ্যেই দেখা গেছিল।

অধিনায়কত্ব ইমরানের ক্রিকেটের আরও একটি শক্তিশালী দিক। বিশ্বকাপ জয় ছাড়াও ভারতের মাটিতে ভারতকে হারানো এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অপরাজিত থাকা ইমরানের ক্যাপ্টেনশিপের মাইলস্টোন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে খেলা ১৯৮৮ সালের পাক – ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ১-১ ড্র হয়। অনেকের মতে, সিরিজের সঠিক ফলাফল হত ২-০ কারণ শেষ টেস্টে নবম উইকেটে ৬১রান করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাকিস্তানের অভিযোগ আম্পায়ারের দাক্ষিন্য ছাড়া সেই টেস্ট জিততে পারত না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গোটা সিরিজেই অসাধারণ বোলিং করে ইমরান মোট ২৩টি উইকেট নেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...