এল নন্দের নন্দন

কণ্ঠটা দৃঢ় করে মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করে বললেন, ‘ষোল বছর বয়স পর্যন্ত যদি এই ছেলে বেঁচে থাকে, ওকে থামানোর মতো কেউ নেই এই দুনিয়ায়। পুরো দেশে রাজত্ব করবে বলাকার ছেলে, সারা পৃথিবী এক নামে চিনবে তোর এই ছেলেকে। গর্ভে তোর রাজপুত্তুর আসছে।’

১.

১৯৮২ সাল।

বাংলাদেশের ইতিহাসে উত্তাল এক সময়। রাজনীতিতে চলছে নানান উত্থান-পতন। কিশোরীর মনের চেয়েও দ্রুত বদলাচ্ছে দেশের ইতিহাস।

এই উত্তাল হাওয়ার ঢেউ নড়াইলেও এসে লাগে। ন্যাপের নেতা অ্যাডভোকেট আতিয়ার রহমানের কাছে নানা রকম প্রস্তাব আসতে থাকে। তার দল সেই গৌরবোজ্জ্বল সময় পার করে এসেছে। কেউ এদিকে, কেউ ওদিকে পাড়ি জমাচ্ছেন। নির্বাচন করা, নতুন নতুন দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে। কিন্তু আতিয়ার রহমান মাওলানা ভাসানীর প্রজ্ঞা আর মার্ক্সসীয় দর্শন বুকে নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকেন – দল বদলাব না।

গুমোট এই সময়টা স্বাভাবিকভাবে আতিয়ার রহমানের পরিবারেও প্রভাব ফেলার কথা। কিন্তু জীবনের একটা মজা হলো, সে কিছুতেই থমকে যেতে পারে না। চুপ থাকতে পারে না। তাই এমন উত্তাল সময়েও আতিয়ার রহমানের বাড়িতে বিসমিল্লাহ খানের সানাই বেজে ওঠে।

আজ আতিয়ার রহমানের বড় মেয়ে হামিদা রহমান বলাকার বিয়ে।

চারখাদা গ্রামের গোলাম নবীর পুত্র, এলাকার ডাকাবুকো ছেলে গোলাম মুর্তজার সঙ্গে মহা ধুমধাম করে বিয়ে দিচ্ছেন মেয়ের। সেই সময় প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিয়ে বিয়ে দেওয়াটা অন্য কোনো অভিভাবকের জন্য একটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনাচরণের কারণে এসব সংস্কারে কখনোই বাঁধা পড়েননি আতিয়ার রহমান। উদার হাতে তাই বরণ করে নিয়েছেন মেয়ের পছন্দকে।

দিনটা ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।

তারিখটার বিশেষত্ব মনে করে আজও হাসিতে ভরে যায় মাশরাফির বাবা ও মায়ের মুখ। বাবা গোলাম মুর্তজা স্বপন হাসতে হাসতেই বলেন, ‘তখন তো আর বুঝিনি যে, এটা ভালোবাসা দিবস। আজকাল যখন ছেলেমেয়েরা এই দিনে ভালোবাসা দিবস পালন করে; আমরা মনে মনে হাসি। না জেনেই ভালোবাসা দিবসে আমাদের এই জীবনের শুরুটা হয়েছে।’

মানুষের জানাটা তো জরুরি নয়; জরুরি হলো প্রকৃতিই ঠিক করে দিয়েছে ভালোবাসা দিবসের এই বন্ধনে বাঁধা পড়বেন স্বপন-বলাকা জুটি।

২.

আতিয়ার রহমানের বন্ধু হিসেবে নেপাল সরকারের খুব যাতায়াত ছিল এই বাড়িতে।

সেদিন এসে কেবল চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছেন, এমন সময় মনে হলো যাই, ভেতরে গিয়ে অ্যাডভোকেট সাহেবের মেয়েটাকে দেখে আসি। মেয়েটার গর্ভে তখন সাত মাসের সন্তান।

মেয়েটার চোখ দুটো যেন একটু বসে গেছে।

বৃদ্ধ নেপাল সরকার বিছানার পাশে একটা চেয়ারে আস্তে আস্তে গিয়ে বসলেন। বলাকার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখি তো মা, তোর হাতটা দে। একটু দেখি।’

যদিও এসব বিষয়ে আতিয়ার রহমান, খালেদা রহমান বা বলাকা; কারোরই তেমন কোনো বিশ্বাস নেই। জ্যোতিষবিদ্যায় বিশ্বাস করার মতো কোনো প্রয়োজনও তাঁরা মনে করেননি। তারপরও নেপাল কাকার অনুরোধ ফেললেন না। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

অনেকটা সময় নিয়ে হাত দেখলেন নেপাল সরকার।

আস্তে আস্তে বললেন, ‘তোর কোলে তো রাজপুত্র আসছে রে, মা।’

একটু কৌতুহলী হয়ে উঠলেন বলাকা। চোখ বড় বড় করে শুনতে চাইলেন। নেপাল সরকার আপন মনে বলে চলেছেন, ‘ছেলে হবে তোর। এই ছেলের ছোটবেলায় অনেক বিপদ আছে; অনেক বিপদ।’

জ্যোতিষবিদ্যায় বিশ্বাস থাকুক আর না-ই থাকুক; এমন অশুভ ভবিষ্যদ্বাণীতে কাল হয়ে যায় সকলের মুখ। নেপাল সরকার এই সবকিছুই যেন খেয়াল করেন না। তিনি আপন ভুবনে ডুবে গেছেন। কণ্ঠটা দৃঢ় করে মুখমণ্ডল উজ্জ্বল করে বললেন, ‘ষোল বছর বয়স পর্যন্ত যদি এই ছেলে বেচে থাকে, ওকে থামানোর মতো কেউ নেই এই দুনিয়ায়। পুরো দেশে রাজত্ব করবে বলাকার ছেলে, সারা পৃথিবী এক নামে চিনবে তোর এই ছেলেকে। গর্ভে তোর রাজপুত্তুর আসছে।’

বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সকলের চোখে পানি। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত অনাগত এই ছেলেকে নিয়ে শঙ্কা এবং সুদূর ভবিষ্যতের এক সম্রাটের চেহারা কল্পনা করে আনন্দের দোলাচল। সব ছাপিয়ে ওই একটা বাক্যই বারবার বাজতে থাকল রাজত্ব করবে একদিন বলাকার ছেলে।

৩.

রাজপুত্তুর, নাকি এলাকার মাস্তান-সন্তান কী হবে, সে নিয়ে তাদের দুজনের অন্তত কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

সন্তান বেড়ে উঠছে, সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে; এতেই আনন্দের শেষ নেই। আতিয়ার রহমান সাহেবের বিরাট বাড়িতে দুদ- মুখোমুখি বসার সময় আর সুযোগ মেলে না। তখনকার দিনে গর্ভে সন্তান নিয়ে স্বামীর সঙ্গে গল্প করার সুযোগ তো খুব একটা মিলত না।

তারপরও নিশ্চয়ই এক লহমা সুযোগে, দুজন দুজনের চোখে চেয়ে একটু লাজুক হাসতেন!

সব বিষয়ে দুজন একমত। একটা বিষয় ছাড়া। বাবা গোলাম মুর্তজা স্বপন বলতেন, ‘আমার একটা মেয়ে হবে।’

আর মা হামিদা মুর্তজা চোখ পাকিয়ে বলতেন, ‘একটা ফুটফুটে ছেলে হবে।’

এই নিয়ে খুনসুটি, এই নিয়ে তর্ক। এমন সুখের তর্ক যেন দুনিয়ায় আর হয় না।

৪.

৫ অক্টোবর, ১৯৮৩।

হাড় কাঁপানো শীত পড়বে এ বছর। অক্টোবর শুরু হতে না-হতেই নড়াইল শহরে শীত জাঁকিয়ে বসেছে।

আগের দিন সন্ধ্যাবেলাতেই বলাকার শরীরটা একটু খারাপ হতে শুরু করেছে। আতিয়ার রহমান সাহেব বুঝতে পারছেন না, ঠিক কী করবেন। দৌড়ে গিয়ে রাস্তার উল্টো পাশেই ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনলেন। তিনি মেয়েকে দেখে হাসতে হাসতে বের হলেন।

যাওয়ার সময় মজা করে বললেন, ‘এত টেনশন করো না, উকিল সাহেব। তোমার ঘরে চাঁদের আলো আসবে। আর কিছু না। বাসায় বলে গিয়েছি। সময় হলেই ওরা আমাকে ডাক দেবে।’

শশুরবাড়িতে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরতে থাকা গোলাম মুর্তজার কানেও গেল শব্দগুলো। তিনি বুঝতে পারলেন, জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হতে চলেছে। এমন অনুভূতির মুখোমুখি আগে কখনো হননি। কত ডিফেন্ডারকে হতভম্ব করে, গোলকিপারকে দর্শক বানিয়ে গোল করেছেন। কত প্রতিপক্ষকে যোজন দূরে ফেলে দিয়েছেন দৌড়ে। কিন্তু এমন সময় বুঝি এর আগে আসেনি।

কী করবেন এখন গোলাম মুর্তজা?

তাকে অবশ্য কিছুই করতে হয় না। ভেতরে হামিদা মুর্তজার মা বেলা ম্যাডাম, খালারা এবং এলাকার অভিজ্ঞ সব মানুষেরা যোগাড়যন্ত্র করতে থাকেন। অভিজ্ঞদের কাছে এই সময়টা মোটেও নতুন কিছু নয়। এমন রাতজাগা তাদের অনেক চেনা। এমন মায়ের যন্ত্রণা দেখে দেখেই চুলে পাক ধরেছে তাদের।

কিন্তু মুর্তজা সাহেব? কিংবা হামিদা মুর্তজা বলাকা!

এমন সময় তো তাদের জীবনে আর আসেনি। ভোররাতে ভেতর থেকে যখন বলাকার কাতরানির শব্দ পেলেন, জীবনটা যেন তছনছ হয়ে গেল মুর্তজা সাহেবের ‘স্ত্রী’ তার এত কষ্ট পাচ্ছে!

যন্ত্রণায় জীবন ওষ্ঠাগত বলাকারও। হাত ধরে সান্তনা দেন, ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন বলাকার মা। কিন্তু কিছুতেই সেই কষ্ট কমে না।

কোনোক্রমেই যেন রাত শেষ হতে চায় না।

অবশেষে আজানের শব্দ শোনা যায়। আতিয়ার রহমান, গোলাম মুর্তজা ওজু করে নামাজে দাঁড়ান। আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে যায়। সূর্য হেসে ওঠে কুয়াশা কাটিয়ে। একটু একটু করে শীতের সকালে রোদ উজ্জ্বল হতে থাকে।

সকাল তখন ৮টা ৩০ মিনিট।

শীতের কুয়াশা চিরে ভেতর থেকে পরপর দুটো চিৎকার ভেসে আসে। বলাকার প্রবল চিৎকার। পরপরই একটা নতুন প্রাণ, এই জগতে এক নবাগত চিকন তারস্বরে জানিয়ে দেয় সে এসেছে। প্রবল চিৎকারে যেন পুরো বাংলাদেশ কাঁপিয়ে ঘোষণা করে দেয় আমি, আমি এসেছি।

আমি চলে এসেছি রাজত্ব করব বলে।

৫.

হঠাৎ সব ব্যথা থেমে গেছে। কোনো এক জাদুর কাঠি যেন হঠাৎ শান্ত করে দিয়েছে দুনিয়াকে।

চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, পৃথিবীটা যেন ঘুরছে। চোখ দুটো বুজে আসতে চাচ্ছে। ঘুম বড় টানছে। ঠিক এমন সময় চেনা একটা কণ্ঠ কানে এল, ‘ছেলে দেখবি না, বলাকা?’

সব ঘুম পালিয়ে গেল, যে অজ্ঞান করতে এসেছিল; সেও যেন এক লহমায় দূরে চলে গেল।

নড়ার শক্তি নেই শরীরে। আস্তে আস্তে পাশের দিকে মাথা ঘোরান।

কে যেন তোয়ালেতে পেঁচানো ছোট্ট একটা পুতুল এনে মুখের সামনে ধরল। চোখের পানিতে ঠিকমতো দেখতেও পান না। মুখের সঙ্গে মিশল পুতুলটার মুখ। পৃথিবীর সব কষ্ট, সব বেদনা মিলিয়ে গেল। এই তো তার সুখের পাত্র দুনিয়ায় এসেছে।

বলাকা শুধু বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন – এই আমার ছেলে! এই ছেলেটাই ছিল আমার পেটে!

এতগুলো বছর পার করে আজও সেই গল্প বলতে গিয়ে বলাকার চোখ জলে ভরে ওঠে। মুখে হাসি, চোখে জল নিয়ে এক স্বর্গীয় দৃশ্য তৈরি করে বলেন, ‘এত্তটুকু! এত্তটুকু ছিল। আমি শুধু দেখলাম, কী ফর্সা একটা পুতুল। আমি বললাম, এটা আমার ছেলে।’

হ্যাঁ, এটা আপনার ছেলে, বলাকা। এটা আপনার কৌশিক।

৬.

আস্তে আস্তে দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে দেন গোলাম মুর্তজা।

তোয়ালেতে পেঁচানো ছোট্ট একটা পুতুল যেন তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। খুব সাবধানে, তুলর পুতুল ধরার মতো করে বুকের কাছে নেন মুর্তজা সাহেব। ঝাপসা চোখে পুতুলটার দিকে চেয়ে দেখেন। চোখ ভরে ওঠে পানিতে। সারা জীবন কতশত সাফল্য-ব্যর্থতার পেছনে ছুটেছেন। কত কী পেয়েছেন, কত কী না পাওয়ার আফসোস করেছেন।

এই একটা মুহূর্তে কোলে সন্তান নিয়ে মুর্তজা সাহেব শুধু ওপরে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানান। আর নিজেকেই বলেন-জীবনের সেরা সম্পদটা পেলাম আজ।

মাশরাফি’ বই থেকে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...