ইএসপিএন, ক্রিকইনফো তে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম, ভারত সবে কোটলায় নাটকীয় জয় পেয়েছে তৃতীয় দিনেই, যা দ্বিতীয় দিনের শেষে দূরতম কল্পনাতেও কেউ ভাবেননি।
আর্টিকেলটা দেশের মাঠে ভারতের পারফরম্যান্সকে ক্লে কোর্টে রাফায়েল নাদালের সঙ্গে তুলনা করেছিল। টেনিস ও ক্রিকেট দুটি খেলাই বাকি স্পোর্টস এর তুলনায় বেশি ফলো করি বলে তুলনাটা খুবই যথাযথ লাগল।
আমি খেলা দেখতে শুরু করার পরে ভারতকে ঘরের মাঠে টেস্ট হারতেই খুব কম দেখেছি, সিরিজ তো দূর অস্ত। ২০০০ সালে ডামাডোলের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৪ এ আবার ডামাডোলের মধ্যে প্রায় কোনো টেস্টেই ফুল টিম নিয়ে না খেলা ভারতকে অস্ট্রেলিয়া হারিয়ে দেয়, আর ২০১২ তে কুক পিটারসেন পানেসার সোয়ান মিলে ভারতকে শেষ বারের মত ঘরের মাঠে সিরিজ হারান।
নাদালকে বহু ম্যাচ খেলতে দেখেছি। একটা কথা তাঁর সম্পর্কে ধারাভাষ্যকাররা বেশির ভাগ সময় বলে থাকেন – রিলেন্টলেস। প্রতিটা পয়েন্ট এমনভাবে খেলেন যেন এর উপরেই ম্যাচ জেতা হারা নয়, নিজের জীবন মরণ নির্ভর করছে। হয়তো ২ সেটে পিছিয়ে আছেন, সবাই ভাবছে ম্যাচ শেষ, নাদাল তখনও কাউন্টার পাঞ্চ করেই যাচ্ছেন।
এভাবে হয়তো খেলাটাকে পঞ্চম সেটে নিয়ে গেলেন এবং প্রতিপক্ষ ভেঙে পড়ল। এভাবেই ২০২২ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের ফাইনালে মেদভেদেভ কে হারিয়েছিলেন নাদাল। আবার এমনও হয়েছে, প্রথম দুই সেট জিতেও পরের দুই সেট আচমকা হেরে পঞ্চম সেটে ম্যাচ, সবাই ভাবছে মোমেন্টাম প্রতিপক্ষের দিকে, কিন্তু আচমকা জ্বলে ওঠে পঞ্চম সেট ও ম্যাচ জিতে নিয়েছেন ( ২০০৮ এপিক উইম্বলডন ফাইনাল)।
দিল্লি টেস্টে যেন ভারতের পারফরম্যান্স অনেকটাই নাদালের মত হল। প্রথম দিন অস্ট্রেলিয়াকে ২৬৩ রানে অল আউট করলেও, বোঝা যাচ্ছিল চতুর্থ ইনিংসে ১০০ এর উপর যে কোনো রান তাড়া করা সহজ হবে না। ভারত প্রথম দিন ২১/০ তে শেষ করায় মনে হয়েছিল প্রথম ইনিংসে একটা বড় লিড নিয়ে হয়তো ম্যাচে জাঁকিয়ে বসবে ভারত।
সুতরাং, প্রথম সেট, ভারত!
কিন্তু দ্বিতীয় দিন সকালে দারুণভাবে লায়নের ঘূর্ণিতে ম্যাচে ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করে লাঞ্চের সময় ভারতকে ৮৮/৪ এবং লাঞ্চের পর প্রথম জলপানের বিরতির ঠিক পরেই ১৩৯/৭ এ নামিয়ে আনে তারা।
এই সময়ে অধিকাংশ ক্রিকেট ভক্ত ভারত বড় ব্যবধানে ম্যাচ হারতে চলেছে ভাবছিলেন।
অর্থাৎ, প্রথম সেট প্রথম দিন ভারত জিতলেও, দ্বিতীয় সেটে পর্যুদস্ত হয়েছে তারা। সেকেন্ড সেট অস্ট্রেলিয়া!
কিন্তু এইখান থেকেই প্রত্যাঘাত শুরু করে ভারত, যা তারা আগের বর্ডার গাভাস্কার ট্রফিতে মিনি হাসপাতাল হয়ে যাওয়া দল নিয়ে ক্যাঙারুদের ডেরায় করে দেখিয়েছে। অক্ষর, অশ্বিন মিলে অমূল্য ১০০+ রানের পার্টনারশিপ করে একটা সময় একটা ভালো লিডের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন। যদিও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। অস্ট্রেলিয়া মাত্র ১ রানের লিড পায়, যা ঘণ্টা দেড়েক আগে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল।
অতএব তৃতীয় সেট ভারত জিতল। প্রত্যাঘাত করে, নাদালের মতই।
কিন্তু নাদালের অনেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মতই, অস্ট্রেলিয়া হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। দিনের শেষের গোটা ১২ ওভারে তারা প্রায় বাজবল ক্রিকেট খেলে রান নিয়ে গেল ৬১/১ এ। লিড ৬২, এবং হাতে নটি উইকেট। আর ১৫০ রানও যদি যোগ হয়, ম্যাচ ভারতের হাতের বাইরে।
অর্থাৎ চতুর্থ সেট অস্ট্রেলিয়া, এবং মোমেন্টাম তাদের দিকে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতেই নাদাল দুর্জয় হয়ে ওঠেন। নিজের খেলা এমন উচ্চতায় তুলে নিয়ে যান, যে প্রতিপক্ষ তাঁকে হারানোর কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে আনফোর্সড এরর করা শুরু করে। ভারতও তৃতীয় দিন সেভাবেই শুরু করল। অশ্বিন আর জাদেজার নিয়ন্ত্রিত স্পিন বোলিং অস্ট্রেলিয়ার গলায় ফাঁসের মত চেপে বসছিল।
আগের দিনের আক্রমণকারী ট্রাভিস হেড আউট হবার পরে লাবুশেণ কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে, একের পর এক উইকেট পড়ছিল। শুরুতে অশ্বিন পরে জাদেজা মিলে মাত্র ৪৮ রানে ফেলে দেন অস্ট্রেলিয়ার শেষ ৯ টি উইকেট। ভারতের নির্ভুল ক্রিকেটের সামনে একের পর এক আনফোর্সড এরর করতেই থাকে অস্ট্রেলিয়া, সুইপের পর সুইপ মারতে গিয়ে একের পর এক উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে, পিচে তেমন কোনো জুজু না থাকা সত্ত্বেও।
মাত্র ১১৩ রানে অস্ট্রেলিয়াকে অল আউট করে দেওয়া ছিল অনেকটা নির্ণায়ক সেটে প্রতিপক্ষের সার্ভিস ব্রেক করার মত। এরপরে একটাই কাজ বাকি ছিল, নিজের সার্ভিস ধরে রেখে সেট ও ম্যাচটা জিতে নেওয়া।
বহু যুদ্ধের ঘোড়া নাদাল যেমন ক্লে কোর্টে এইসব পরিস্থিতিতে কখনো হারেন না, ভারতও ১৯৮৭ সালে শেষবার টেস্ট হারা দুর্ভেদ্য দুর্গ কোটলাতে ১১৫ রান করতে বিশেষ বেগ পায়নি। চারটি উইকেট হারিয়ে সহজেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভারত, যার একটি উইকেটও বোলারদের কৃতিত্বে পাওয়া নয়।
গেম, ফিফথ সেট, অ্যান্ড ম্যাচ, ইন্ডিয়া!