করোনা ভাইরাস নামের মহামারী প্রায় বছর খানেক স্তব্ধ করে দেয় গোটা বিশ্বকে। বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো হয়ে যায় পণ্ড কিংবা পিছিয়ে যায় দিনক্ষণ। এর ফলে এখন যা হয়েছে সবরকম ক্রীড়াঙ্গনের খেলোয়াড়দের হঠাৎ করেই ম্যাচের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ফুটবল ও ক্রিকেট অঙ্গনে। এতেই নতুন এক টার্মের বেশ প্রচোলন হয়েছে তা হলো খেলোয়াড়দের ওয়ার্কলোড কিংবা কাজের চাপ।
সত্যিকার অর্থেই চাপের মুখে আছেন খেলোয়াড়েরা। জমে থাকা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট থেকে দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলো যেন রীতিমত গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে খেলোয়াড়দের। ক্রিকেটারদের যেন এই চাপটা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। কিন্তু এই ওয়ার্কলোড বা কাজের চাপ ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনে ছিল আগে থেকেই।
এখন নব্য যে সমস্যায় ভুগছে দলগুলো তা হচ্ছে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন ও জৈব সুরক্ষা বলয়। এই মহামারীর আগে তবু খেলোয়াড়েরা সময় পেতেন নিজেদের মতো করে নিজেদের মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি দূর করে আবার মাঠে ফেরার। কিংবা খেলার মাঝের বিরতিতে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ থাকলেও বর্তমানে নেই তেমন কোন সুবিধা। এতে করে যা হয় তা হচ্ছে প্রচণ্ডরকমের মানসিক অবসাদ। এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগি টিম ইন্ডিয়া।
এটা মোটামুটি অনুমেয় ছিল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টানা ধকলের পর বিশ্রামে যাবেন ভারতের ওডিআই ও টেস্ট অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বিশ্রাম সবারই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এখন। এত শক্ত বিধি নিষেধ কিংবা কাছাকাছি সময়ে এত খেলায় অংশ নেওয়া দুষ্কর।
তবে যদি এই বায়োবাবল নিয়মটাকে একটু পাশে রেখে যদি খেলার পরিমাণের দিকে হিসাব করি তাহলে দেখা যাবে ভারতীয় ক্রিকেটে এই ওয়ার্কলোড মহামারীর আগে থেকেই বিদ্যমান। ভারতে ক্রিকেটাররা শুরু থেকেই থাকেন অত্যাধিক চাপের মধ্যে।
এক ক্রিকেটিয় পঞ্জিকা বর্ষের একটা বড় সময় জুড়ে চলে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। সেখানে ব্যস্ত থাকেন অধিকাংশ ভারতীয় খেলোয়াড়। তাছাড়া যদি কেবল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একটা হিসেবও আসলে করা প্রয়োজন। চলুন সহজ একটা হিসেব কষে নেই। ক্রিকেটের তিন পরাশক্তির কে কতগুলো ম্যাচ খেলে থাকে তাঁর হিসেব।
২০১৮ জানুয়ারি থেকে এই বছরের নভেম্বরের ১৪ তারিখ অবধি খেলা ম্যাচগুলোর হিসেবটা আগে করাই শ্রেয়। এই সময়কালটা ঠিক ৪৬ মাসের একটি পিরিওড। এই ৪৬ মাসের ভারত খেলেছে ১৫৯টি ম্যাচ। এর মধ্য়ে টেস্ট ম্যাচ রয়েছে ৩৭টি, ওডিআই ৬৩টি ও টি-টোয়েন্টি ৫৯টি। অপরদিকে এই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড খেলেছে যথাক্রমে ১৩৭টি ও ১৫৭টি ম্যাচ।
অস্ট্রেলিয়া এই ৪৬ মাসের সময়কালে টেস্ট খেলেছে ২৭টি, ওডিআই ৫২ ও টি-টোয়েন্টি ৫৮টি। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৪৬, ৬৪, ৪৭। এটা প্রমাণ করে ক্রিকেটের শীর্ষে অবস্থান করা এই তিন দেশের জাতীয় দল কি পরিমাণ ক্রিকেট খেলে থাকে এ সময়ে। নতুন বায়ো-বাবল পরিস্থিতিতে নাভিঃশ্বাস উঠে যাবার মতো উপক্রম হয় ক্রিকেটারদের।
কিন্তু যদি মহামারীর আগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করা যায় তবে খুব বেশি হেরফের হবে না খেলোয়াড়দের খেলা ম্যাচের সংখ্যায়। এবার সময়কাল ৪৮ মাসের। জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০১৭। এই সময়ে ভারতের খেলা ম্যাচের সংখ্যা ১৭৬। টেস্ট, ওডিআই ও টি-টোয়েন্টি যথাক্রমে ৪২, ৮৯, ৪৫।
যদি অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যানের ঢুঁ মারা যায় তবে দেখা মিলবে যথাক্রমে ১৫৬ ও ১৭৩ অংকের। অতএব খুব যে বেশি পরিবর্তন হয়েছে মহামারীর আক্রমণে বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু ভারতীয় খেলোয়াড়দের জন্যে যা শঙ্কার কারণ হয়েছে তা হচ্ছে খুব অল্প বিরতিতে একের পর এক সিরিজে অংশ নেওয়া। বর্তমান জৈব-সুরক্ষা বলয়ের নিয়মানুসারে এই স্বল্প বিরতিতে ম্যাচ খেলা যেন ধীরে-ধীরে পরিণত হচ্ছে বিভীষিকায়।
ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনে খেলোয়াড়দের এমন চাপ চলতে থাকলে হয়ত মানসিক অবসাদ ও ক্লান্তি থেকে খেলোয়াড়দের মাঝে চলে আসতে পারে ক্রিকেটের প্রতি অনীহা। অন্যদিকে এই পরিমাণ মানসিক চাপ খেলোয়াড়দের স্বাভাবিক পারফর্মেন্সে ঘটাতে পারে ব্যাঘাত। যার ফলে হুমকির মুখে পড়তে পারে খেলোয়াড়দের ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে ভারতের বাদ পড়ে যাওয়া হতে পারে মোক্ষম উদাহরণ।
এমতবস্থায় প্রতিটি দল ছুটছে ফরম্যাট অনুযায়ী দল গোছানোর দিকে। এটা খেলোয়াড়দের উপর থেকে চাপ অপসারণের অনেক বড় এক পন্থা হতে পারে। তাছাড়া ভারতের মতো ক্রিকেটের স্বর্গরাজ্যে ভিন্ন ফরম্যাটে ভিন্ন খেলোয়াড় খুঁজে পেতে খুব একটা বেশি সমস্যা হবার কথা নয়। তাছাড়া ভারতীয় ক্রিকেটার কিংবা সমর্থকেরা হয়ত এমনটাই প্রত্যাশা করে যে খেলোয়াড়দের উপর থেকে চাপ কমাতে সুন্দর গোছালো একটা পঞ্জিকা অনুসরণ করবে ভারতীয় ক্রিকেট ম্যানেজমেন্ট। যাতে করে অকালে যেন ঝড়ে না পড়ে কোন খেলোয়াড়।