আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে আপনি কোন দলকে দেখতে চান কিংবা কোন টিমের রয়েছে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা তাহলে উত্তর কি দেবেন? নানারকম উত্তর আসবে। বৈচিত্রময় পৃথিবীর মতের বৈচিত্র তো নতুন নয়। তবে একটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়। অন্তত চল্লিশ শতাংশ ক্রিকেট সমর্থকদের উত্তরে পাকিস্তানের নাম পাওয়া যেতে পারে। এর পেছনে হাতি-ঘোরার মত বিশাল কোন তত্ত্ব নেই। সরলভাবে তাঁদের সাম্প্রতিক ফর্ম বিবেচনায় যে কেউ এমন উত্তর দিতে পারে।
তবে নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসে এই যে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের উড়ন্ত সূচনার পেছনের কারণ কি? পেছনের কারণ তো রয়েছেই। নইলে কি আর উড়ে বেড়ানো যায় ক্রিকেটের নীল দিগন্তে? প্রধান কারণ হিসেবে সামনে আসতে পারে কন্ডিশন সম্পর্কিত অগাধ জ্ঞান। হ্যাঁ, গেল প্রায় এক যুগ ধরে আরব আমিরাত পাকিস্তানের হোম ভেন্যু। ‘হোম ফার ফ্রম হোম’। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার মধ্যকার দ্বিপাক্ষি সিরিজে সন্ত্রাসী হামলার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান থেকে বিদায় নেয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
বেশ কয়েকবার পাকিস্তান নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ঘরের মাঠে নিয়ে যেতে পারেনি কোন আন্তর্জাতিক দল। পাকিস্তানের ক্রিকেট যেন স্তিমিত হয়ে না যায় সেই লক্ষ্যে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড আরব আমিরাতকে নিজেদের হোম ভেন্যু হিসসেবে বেছে নিয়ে সেখানে গত প্রায় একযুগ ধরে আয়োজন করে আসছে দ্বিপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সিরিজ থেকে শুরু করে পাকিস্তানের ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগ পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল)।
যার ফল এখন পেতে শুরু করেছে পাকিস্তান ক্রিকেট দল। ভারতে অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারত ও আইসিসি আরব আমিরাতকে বেছে নেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সপ্তম আসরের ভেন্যু হিসেবে। গত এক যুগে হাতের তালুর মতো করে রপ্ত হয়ে গিয়েছে আরব আমিরাতের কন্ডিশন। সেই পরিচিত কন্ডিশনে ভাল খেলাটা যেন ছিল অনিবার্য। উড়ন্ত পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের এই কন্ডিশন জ্ঞান কাজ করছে পাখির মস্তিষ্ক হিসেবে।
উড়ন্ত পাখিটির দুই পাখা ব্যাটিং আর বোলিং। ব্যাটিং এ পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ধারাবাহিক একটি দল। তাঁদের ব্যাটিং দক্ষতা দেখেছে পুরো ক্রিকেট দুনিয়া। ভারতের বিপক্ষে বাবর আজম ও মোহাম্মদ রিজওয়ানের অদম্য জুঁটি তাঁদেরকে এনে দিয়েছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া প্রথম জয়।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচে ব্যাটিং এর ভালই পরীক্ষা দিতে হয়েছে পাকিস্তান দলকে। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে শোয়েব মালিকের অভিজ্ঞতার দৃঢ়তা ও শেষ ম্যাচে প্রথম ম্যাচের মতো বাবর আজমের দায়িত্বশীল ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়তে দেয়নি পাকিস্তানকে। শেষের দিকে আসিফ আলির ঝোড়ো ক্যামিও-তে এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টে অপরাজেয় পাকিস্তান।
পাকিস্তানকে তাঁদের ক্রিকেট যাত্রার আদিকাল থেকে ধরা হয় বোলার তৈরির কারখানা। আরেকটু যদি বিশেষভাবে বলতে গেলে তা দাঁড়ায় পেসার তৈরির কারখানা। এই উড়ন্ত পাকিস্তানের আরেক ডানার পালক হবেন শাহীন শাহ আফ্রিদি, হাসান আলী, হারিস রউফ, সাদাব খানরা। তারুণ্যের সাথে অভিজ্ঞতার এক দারুণ মিশেল রয়েছে পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপের মতো বোলিং লাইনআপেও। পাল্লা ব্যালেন্স করছেন মোহাম্মদ হাফিজ ও কালেভদ্রে শোয়েব মালেক।
তাছাড়া পাকিস্তানের পেসারদের রিলে রেসের ব্যাটন হাতে ছুটে চলেছেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। মাত্রই তো বয়স একুশ। তাতেই কি বিধ্বংসী! তাছাড়া স্লোয়ার বল কি করে কাজে লাগাতে হয় কোন উইকেটে তা করতে হয় তা বেশ ভাল করেই জানা হাসান আলীর। আর হারিস রউফ তো রীতিমত গতিতে কাবু করছেন বাঘা বাঘা ব্যাটারদের। আর সাদাবের ঘূর্ণিতে কুপকাত না হবার উপায় তো নেই।
এতো গেলো দুইটি পাখার কথা। উড়ন্ত পাখিকে আকাশে উড়তে প্রচণ্ডরকমভাবে সহয়তা করে তাঁর শরীরের ফাঁপা অবয়ব বা কঙ্কাল। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের এই ফাঁপা অস্থি হচ্ছে তাঁদের ফিল্ডিং-এ উন্নতি। কথায় আছে ‘ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস’। পাকিস্তান ক্রিকেট দল বহুকাল ধরে এই অপবাদ নিয়ে ঘুরেছে যে তাঁদের দ্বারা ফিল্ডিংটা ঠিক হয়ে ওঠেনা।
এমন বহু ম্যাচ তাঁরা হেরেছ শুধুমাত্র ক্যাচ মিসের কারণবশত। তবে চলতি বিশ্বকাপে এ যেন অন্য পাকিস্তান। বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলা বারোটি দলের মধ্যে ফিল্ডিং বিবেচনায় এই উড়ন্ত পাকিস্তান নিঃসন্দেহে উপরের দিকেই থাকবে। বাবর আজমের দল তাঁদের শরীরি ভাষায় এবং ফিল্ডিং-এ এই বার্তাটুকু স্পষ্টতই দিয়েছে যে এই পাকিস্তান ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়া এক নতুন পাকিস্তান।
উড়ন্ত পাকিস্তান শেষ অবধি তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কি না তাঁর জন্যে চেয়ে রইতে হবে হাতে কিংবা ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির পানে।