১৯ বছরের এক ছেলে মাঠে নেমেছে মাঠে, ভারতের সবচেয়ে সম্মানের, মর্যাদার ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির টুর্নামেন্ট রঞ্জি ট্রফিতে। ভারতের কানপুরের গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামে। কিন্তু তিনি যখন ব্যাটিং-এ নেমেছিলেন তখন তাঁর দলের ব্যাটিং পরিস্থিত খুবই নাজুক। দলকে সেই পরিস্থিতি থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব ছিলো সেই কেবল বলিষ্ঠ হতে শুরু করা কাঁধে।
ছেলেটা প্রতিপক্ষ বোলারদের আক্রমণ প্রতিহত করে উল্টো তাঁদের আক্রমণ করে রান তুলতে থাকেন এবং বিপর্যয় থেকে দলকে টেনে তোলেন। শেষমেষ ৭৫ রানে তিনি দলের জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন। সেই থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর উত্থানের শুরু।
বলছিলাম ভারত টেস্ট দলে সদ্য অভিষিক্ত শ্রেয়াস আইয়ারের কথা। ভারতের টেস্ট ইতিহাসের ৩০৩ নম্বর ক্যাপটি জুঁটেছে নবাগত এই মিডেল অর্ডার ব্যাটারের। যেই মাঠ থেকে শ্রেয়াসের উত্থানের সূত্রপাত সেই কানপুরের গ্রিন পার্ক মাঠেই নিজের টেস্ট ক্যাপটি বুঝে নিয়েছেন শ্রেয়াস আইয়ার।
অভিষেক টেস্টেই তাঁকে পালন করতে হয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তিনি যখন ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন তখন ভারতের অভিজ্ঞ চার ব্যাটার চলে গিয়েছিলেন সাঁজঘরে। ১৪৫ রানে চার উইকেটের পতন ঘটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের। সেই মুহূর্তে সদ্য অভিষেক হওয়া শ্রেয়াস জুঁটি বাঁধলেন অভিজ্ঞ রবিন্দ্র জাদেজার সাথে।
তারপর ধৈর্য্যের সাথে খেলে ফেললেন এক অনবদ্য শত রানের ইনিংস। এই ইনিংসেও তাঁর স্বভাবচারিত পালটা আক্রমণাত্মক ভাবভঙ্গি ছিল বিদ্যমান। নিজের স্কিলে ভরসা করে সাবলীলতায় এবং প্রতিপক্ষ বোলারদের ভাল বলগুলোকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েই তিনি ১৭১ বলে ১০৫ রান করে ক্ষান্ত হন। দলীয় ৩০৫ রানে আউট হন শ্রেয়াস। বিপর্যয় কাটিয়ে তাঁর ব্যাটের উপর ভর করেই ৩৪৫ রানের ডিফন্ড করার মতো একটি পুঁজি পায় ভারত।
২০১৭ সালে সাদা বলের দুই ফরম্যাটে শ্রেয়াসের অভিষেক ঘটলেও তাঁর লালবলের অভিষেক পেতে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর। অভিষেক টেস্টে এমন এক কার্যকরী ইনিংস এবং নানন্দিক ব্যাটিং শৈলী প্রদর্শন করাটা বেশ প্রসংশযোগ্য। তাছাড়া লাল বলের অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের শুরুর ইনিংসের এই শতক তাঁর বাকি ক্যারিয়ারে জোগাবে আত্মবিশ্বাস। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে শ্রেয়াসের গায়ে লেগে থাকা ‘সাদা-বলের’ ব্যাটার তকমাটারও পরিসমাপ্তি ঘটবে।
কিন্তু কানপুরে যাওয়ার পরও শ্রেয়াস জানতেন না যে তাঁর অভিষেক ঘটবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চলমান প্রথম টেস্ট ম্যাচেই। এ বিষয়ে শ্রেয়াস বলেন, ‘আমি যখন কানপুরে আসি আমি তখনও জানতাম না আমি একাদশে থাকবো কিনা। কিন্তু রাহুল স্যার ও অধিনায়ক আমার রুমে এলেন এবং হঠাৎ করেই আমাকে লাল-বলের ক্রিকেট অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের মাইন্ডসেট ঠিক করা নিয়ে পরামর্শ দেন তাঁরা। কেননা আমি এই ফরম্যাটে শেষ খেলেছি তিন বছর আগে। আমি ভারতীয় দলে খেলাটাকে একটি সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।’
তিনি শেষ লাল বলের ম্যাচ খেলেছিলেন তিন বছর আগে ইরানি কাপে। তারপর থেকে তাঁকে আর ঘরোয়া ক্রিকেটে দেখা যায়নি। তাঁর ‘সাদা-বলের ব্যাটার’ ট্যাগ পাওয়াটা যথার্থই মনে হতে পারে। কিন্তু তিনি নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচেই শতক হাঁকিয়ে প্রমাণ করেছেন একজন শ্রেয়াস আইয়ার সব ফরম্যাটের, একজন ক্রিকেটার শ্রেয়াস আইয়ারের কাছে সাদা-বল, লাল-বলের বিশেষ পার্থক্য নেই।
শ্রেয়াস জানতেন তাঁর জন্যে এই অভিষেক ইনিংসটা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একজন প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যাটার হতে সব ফরম্যাটেই হতে হয় পারদর্শী তা খুব ভাল করেই জানতেন শ্রেয়াস। তিনি বিগত আট বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটের দাপটের সাথে খেললেও আসলেও আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকটা বেশ বিলম্বেই হল।
টেস্টের এই অভিষেক বিলম্ব তাঁকে বেশ হতাশ করে দিয়েছিল। কেননা তাঁর বাল্যগুরু প্রবীন আম্রে তাঁকে একবার বলেছিলেন যে একজন ব্যাটারের আসল পরিচয় মেলে টেস্ট ক্রিকেটে ময়দানে। এ বিষয়ে শ্রেয়াস আরো বলেন, ‘আমি যখনই প্র্যাকটিসে যাই, প্রবীন স্যার আমাকে বলেন তুমি তোমার জীবনে অনেক কিছু অর্জন করে ফেলেছো। তুমি একটি আইপিএল দলের অধিনায়ক ছিলা এবং অনেক রান করোছো ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কিন্তু এসব কিছুই তুমি করেছো সাদা-বলের ক্রিকেটে। কিন্তু তোমার আসল অর্জন হবে যখন তুমি জাতীয় দলের টেস্ট ক্যাপ পাবা।’
সুতরাং শ্রেয়াস যে মুখিয়ে ছিলেন টেস্ট অভিষেকের জন্যে তা বলাই যায়। তাঁর কাছে টেস্ট ক্রিকেটের মাহাত্ম্য যে অন্যকোন ফরম্যাটের থেকেও বেশি। তাই হয়ত তিনি নিজের টেস্ট অভিষেকের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এক অনবদ্য ইনিংস খেলেছেন এবং দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। সুযোগের একেবারে সঠিক সদব্যবহার।
শ্রেয়াস তাঁর এই টেস্ট অভিষেকের শতক দ্বারা তাঁর সমালোচকদের ভুল প্রমাণে পুরোপুরি সফল। সমালোচকদের ভুল প্রমাণে পাশাপাশি এখন শ্রেয়াস ভারতের অভিজ্ঞ দুই ব্যাটারের দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়েও ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে বাধ্য করেছে।
দলের নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি ফিরলে হয়ত একাদশ থেকে বাদ পড়তে পারেন অভিজ্ঞ দুই ব্যাটার চেতেশ্বর পুজারা ও আজিঙ্কা রাহানে। তাঁদের অফ ফর্ম ও শ্রেয়াসের সম্ভাবনাময়ী ইনিংসের ফলশ্রুতিতে টিম ম্যানেজমেন্টের এমন সিধান্তে অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
শ্রেয়াসের মতো করেই ক্রিকেটীয় ভঙ্গিমায় চলুক অহেতুক সমালোচনা ও নিন্দার জবাব দেওয়ার রীতি বিশ্বক্রিকেট অঙ্গনে।