আমি জন্মেছিলাম ব্রাজিল দেশে। যে দেশের পথে পথে ছোট ছেলেরা ফুটবলের স্কিল দেখিয়ে রোজগার করে। যে দেশের নামে একবাক্যে ফুটবল ভেসে ওঠে। যে দেশকে ছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপ ভাবা যায় না, একবারও যে দেশকে ছাড়া ফুটবল বিশ্বকাপই হয়নি। সে দেশের গামা প্রদেশে আমার জন্ম। আমিই বোধহয় একমাত্র ফুটবলার, যার বাবা এবং মা দু’জনেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। একজন স্কুল শিক্ষক, আর একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। চেয়েছিলেন আমি হব ডাক্তার। কিন্তু পরমপ্রভু যীশুর ইচ্ছেয় তা আর সম্পূর্ণ হয়নি।
আমি যখন প্রথম সাও পাওলোতে খেলতে শুরু করি, অনেকেই প্রথম দলে ডাকত না। তা সত্বেও ভাল পাস বাড়ানোর দৌলতে আমি ধীরে ধীরে মূল দলে জায়গা করে নিই। আমার পায়ে বল এলে বরাবর তা পাস বাড়ানোর জন্যই আসত। সেভাবেই আমি তৈরি হয়েছিলাম। সাও পাওলোতে যখন আমি খেলি, তখনই মনের কোনও গোপন কোটরে স্বপ্ন বুনে রেখেছিলাম, একদিন দেশের হয়ে খেলব। নিজেকে তৈরি করছিলাম সেই লক্ষ্যে। জানেন, স্বপ্ন কখনও ঘুমিয়ে দেখতে নেই। সেটা স্বপ্ন থাকে না। কারণ স্বপ্ন এমনই একটি বস্তু যা আপনাকে ঘুমোতে দেয় না। এশিয়ার কোনও এক দেশের মহান বিজ্ঞানী কথাটি বলেছিলেন বোধহয়।
আমি ডাক পেয়ে গেলাম দেশের হয়ে খেলতে। ২০০১ সালে অভিষেক হল বলিভিয়ার বিরুদ্ধে, ভালই খেলেছিলাম। তখন কতই বা বয়স আমার, ঐ বছর কুড়ি। তাতেই পরের বছর ডাক পেলাম বিশ্বকাপ স্কোয়াডে। সাকুল্যে একটা ম্যাচেই খেলেছিলাম, তবু বিশ্বকাপ জেতার আনন্দ কী আর কম হয়! সে রাতে কোরিয়ায় আমাদের আনন্দ দেখে কে! সারারাত পার্টি, আর অত কম বয়সে প্রথম বিশ্বকাপকে হাতে ধরার অনুভূতি অন্য রকম, সব কিছুর চেয়ে আলাদা, একেবারে আলাদা। আমার খেলার প্রশংসাও খুব হয়েছিল। তাই তো পরের বছর কনকাকাফ কাপে আমাকে দলের অধিনায়ক করা হল।
দেশের জার্সিতে ফুটবল খেলে আমি জীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফলতা পেয়েছি, জানেন। অনেক কিছু জিততে পেরেছি। বিশ্বকাপ, কনকাকাফ গোল্ড কাপ, কনফেডারেশন কাপ। শুধু কোপা আমেরিকা এবং অলিম্পিকের স্বর্ণখচিত মেডেলটা আর পাওয়া হয়নি। তা না হোক। মানুষ কি এক জীবনেই সব কিছু পেয়ে যায়।
আমি যখন প্রথম এসি মিলানে যোগ দিই, তখন আমার কোচ ছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। ওনার বিখ্যাত ‘ক্রিসমাস ট্রি ফর্মেশন’-এ আমি ছিলাম মূল অস্ত্র। আমি একবার স্যারকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এনে দিয়েছি। আর একবার পারিনি। তাতেও ফাইনালে হার্নান ক্রেসপোকে একটা লম্বা থ্রু বল বাড়িয়েছিলাম, সেটার কথা আজও লোকে বলে।
সে বছরও দুর্দান্ত খেলেছিলাম। স্যার যতদিন ছিলেন, বলা ভাল আমি যতদিন মিলানে ছিলাম – ততদিন বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে সোনালি মূহূর্ত কাটিয়েছি। আমার পাশে ফরাসি সেডর্ফ আর কিছু পরে স্বদেশীয় লেজেন্ড রোনাল্ডো এসে পড়ে, ওদের সান্নিধ্যে আমার খেলারও প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল। এরপর কি মনে হল, আমি এক ‘ম’ ছেড়ে অন্য ‘ম’-তে গেলাম। মানে মিলান ছেড়ে মাদ্রিদে। সেখানে আমার পাশে কারা খেলত জানেন? যাদের আপনারা সুপারস্টার বলে চেনেন। কাসিয়াস, পতুর্গিজ কিংবদন্তি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, আর্জেন্টাইন ট্যালেন্ট অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, জার্মানির মাঝমাঠের ইঞ্জিন ওজিল – কে নেই সে তালিকায়!
আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিমে কোপাকাবানার ধারে ডুবে যেতে লাগল। আমার জীবনে সবই প্রায় পাওয়া হয়ে গেছিল। সাধের ব্যালঁ ডি অরও। আমার আর ফুটবল থেকে কিছু পাওয়ার ছিল না। বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত বোধহয় সেদিনই নিয়েছিলাম, যেদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় স্নেইডারের হেড আমাদের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিয়েছিল।
আমি সেই কাকা। রিকার্ডো কাকা। আমিই সেই ব্যক্তি, যে পারফেক্ট অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলাম। আমিই সেই ধাবমান পাশুপত অস্ত্র, যার পায়ে বল এলে ঠিকানা লেখা পাস থাকত সামনে থাকা সেন্টার ফরোয়ার্ডের জন্য। আমিই সেই চৈতক, যে প্রবল বেগে বল নিয়ে মাঝমাঠ থেকে গোল পর্যন্ত ছুটতে পারত অনায়াসে। হ্যাঁ, আমিই সেই কাকা, যে সারা পৃথিবীতে অনেক ছোট ছেলের ফুটবলের প্রেমে পড়ার কারণ। অনেকের ইন্সপিরেশন। অনেকের ছোটবেলার নায়ক। অনেকের কৈশোরের প্রেম, যৌবনের ভালবাসা। আমি, রিকার্ডো কাকা।
লোকে আমার নামে বলত, ২০০০-এর পর একটা গোটা জেনারেশনকে ফুটবলের প্রতি টান তৈরি করার জিনিয়াস। আমি ওসব জানি না। আমি শুধু চিনতাম, বলটা পেলে কীভাবে ডিফেন্ডারদের বোকা বানিয়ে মাঝখান থেকে একটা চোরা থ্রু বাড়ানো যায়। কীভাবে পায়ের মুভমেন্টকে কাজে লাগিয়ে, ডজ করে সামনে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া যায়।
আমি রিকার্ডো কাকা। কারোর কাছে জিনিয়াস, কারোর কাছে কৈশোরের নায়ক, কারোর কাছে যৌবনের ভালবাসা। আমার দেশের এত শ্রেষ্ঠদের ভীড়ে আমিও সমান ভাবে জ্বলজ্বল করছি।