অগ্নিতপ্ত করাচি, বরফশীতল বাবর

পঞ্চম দিনের খেলা তখনো শুরু হয়নি। ঝলমলে রোদে ততক্ষণে ঘাম ঝড়ছে দর্শকদের। তবুও শেষ দিনের লড়াইয়ে প্রিয় দলকে সমর্থন দিতে করাচিতে দর্শকদের বড় একটি অংশ উপস্থিত। বাবর আজমের উপর যে সবচেয়ে বেশি আস্থা সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

পঞ্চম দিনে পাকিস্তানের জয়ের জন্য দরকার আরও ৩১৪ রান, হাতে ৮ উইকেট! জয়ের চেয়ে প্রাথমিক লক্ষ্যটা ড্র নিশ্চিত করা। কারণ প্রথম ইনিংসের ভরাডুবির পর শেষদিনে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং দাপটের সামনে টিকে থাকতে পারবে কিনা পাকিস্তানি ব্যাটাররা সে নিয়েও ছিল সংশয়।

পাকিস্তানি সমর্থকদের সবচেয়ে বড় ভরসা বাবর আজম সেঞ্চুরি করে অপরাজিত আছেন। আগের দিনও আলোচনায় ছিলেন তিনি। সাবেক সহ বর্তমান বেশ কিছু ক্রিকেটারের টুইট ও দর্শক-সমর্থকদের বার্তা অনুযায়ী পাকিস্তানকে এই ম্যাচে টিকে থাকতে হলে শেষ দিনে বাবরকেই শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হবে। বাবর অবশ্য নিরাশ করেননি পাকিস্তানি সমর্থকদের! করাচির তপ্ত গরমে বরফশীতল ব্যাটিংয়ে হারের মুখ থেকে দলকে ফিরিয়ে দাপুটে ড্র ছিনিয়ে আনেন এই পাকিস্তানি অধিনায়ক!

অধিনায়ক হিসেবে এর আগে বাবরের অবদান কতটুক? সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বোলারদের কল্যাণেই কি দল জয় পেয়েছিল না? মোহাম্মদ রিজওয়ান, শাহীন শাহ আফ্রিদির অনবদ্য পারফরম্যান্সের কারণেই কি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিতে পৌঁছায়নি পাকিস্তান?

ব্যাটিং নিয়ে যদি বলি – তিনি কি সেই নয় যিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ধীরগতির ইনিংস খেলে দলকে বিপদে ফেলেছিলেন? তিনি কি সে নন যিনি করোনার আগে সবশেষ টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন? – বাবরকে নিয়ে সমালোচনা করতে অনেকেই এই ব্যাপারগুলো তুলে ধরে।

আমরা মাঠের বাইরে থেকে বাবরকে নিয়ে যেমনটা ভাবি আসলে ভাবনা চিন্তা আর বাস্তবতার মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। পুরস্কার বিতরণী কিংবা সংবাদ সম্মেলনের সময় বেশিরভাগই ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, যাতে বেশ অস্বস্থিবোধ করেন বাবর। তিনি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন করতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। পাকিস্তান ক্রিকেটের ব্র‍্যান্ড হিসেবে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি করার প্রস্তাব আসে সেটিকেই তিনি এড়িয়ে যেতে চান। বিরাট কোহলির মাঝে ন্যাচারালি যে জিনিসগুলো সহজেই করতে দেখা যায়, সেই ব্যাপারগুলোতে বাবর এখনো বলতে গেলে শিক্ষানবিশ!

অধিনায়কের ভূমিকায় বাবর একদিনে গড়ে উঠেননি। ব্যাট হাতে ফর্মহীনতার পরই অধিনায়কত্ব থেকে বাদ পড়েন সরফরাজ আহমেদ, আজহার আলীরা। সেই সময় ফর্মের তুঙ্গে পাকিস্তানি তারকা বাবর আজম। দায়িত্ব পেয়ে যান অধিনায়কত্বেরও! যদিও বলতে গেলে চাপের মুখেই দায়িত্ব পান তিনি। তিনি যখন ব্যাটিং করেন ক্যামেরার ফোকাসে তিনি মোটেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, এই চাপটাও তিনি বেশ অনুভব করেন।

করাচিতে যখন তিনি শেষ ইনিংসে ব্যাট করতে নামলেন ক্যামেরন গ্রিনের বাউন্সারে তখন ফিরছেন আজহার আলী। বাবর এসে আজহারের জায়গা নিলেন। কিন্তু বাবরের জায়গায় কি দ্রুত কেউ আসতে পারবে? নাকি দেখা যাবে কোনো মহাকাব্যিক ইনিংস কিংবা রূপকথার গল্পের কোনো এক বাস্তব চিত্র!

লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৫০০, ওভার খেলতে হবে ১৫০ প্রায়! চাপের মুখে বাবরের শুরুটাও তাই মাথায় চাপের পাহাড় নিয়ে। ধীরে ধীরে দেখেশুনেই খেলতে লাগলেন বাবর। অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের টাইট লাইন-লেন্থে বল ডিফেন্ড করতেও শুরুতে খানিকটা বেগ পেতে হয় বাবরকে। তবে ক্রিজে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার যে টার্গেট নিয়ে তিনি নেমেছিলেন ধীরে ধীরে সেটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের রিভার্স স্যুইং, বাউন্সারগুলো একের পর এক রুখে দিচ্ছিলেন বাবর। সাথে যোগ্য সঙ্গটাই দিচ্ছিলেন আব্দুল্লাহ শফিক। বাবর আত্মবিশ্বাস দেখালেও পাকিস্তানের এই ম্যাচ বাঁচানোটা অনেকটাই স্বপ্নের মতো। প্রথম ২১ বলে করেন মোটে ১ রান। সোয়েপসন অবশ্য লাইন-লেন্থ পরিবর্তন করে বার বার বাবরকে পরীক্ষা করছিলেন। সেই পরীক্ষায়ও টিকে যান বাবর। বলের লাইন বুঝে ডিফেন্সেই মনোযোগী ছিলেন তিনি। পেসারদের সামনেও বাবরকে কখনোই মনে হয়নি নড়বড়ে। স্টার্ক-কামিন্সদের বাউন্সার কিংবা ফুলার লেন্থেও মেরেছেন বাউন্ডারি!

চতুর্থ দিনটা দেখেশুনে খেলতে খেলতে পৌঁছে যান সেঞ্চুরিতে! প্রায় বছর দুয়েক পর টেস্ট সেঞ্চুরি, তাও কিনা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ে! এমন এক প্রত্যাবর্তনই বাবরের কাছে দেখতে চাচ্ছিলেন পাকিস্তানি সমর্থকরা। বাবর-শফিকদের ব্যাটিং চতুর্থ দিন শেষে সমর্থকদের মনে আবারও আশা জাগায়। শেষদিনে অনেক কিছু ঘটতে পারে। পাকিস্তান পেতে পারে এক ঐতিহাসিক জয় কিংবা দাপুটে লড়াইয়ের ড্র! আবার ভিন্ন চিত্রে দেখা যেতে পারে অজিদের সহজ জয়ও। সবকিছুই সম্ভব।

পঞ্চম দিনেও শুরুটা করেছিলেন অসাধারণ। অজিদের উইকেটের দেখা নেই, বাবর-শফিকের ব্যাটে তখন ড্র’য়ের দিকেই হাঁটছে করাচি টেস্ট। লাঞ্চ বিরতির ঠিক আগে ৯৬ রানে শফিকের বিদায়টা যেনো হটাৎ ম্যাচে পালের হাওয়া লাগার মতোই! কিন্তু বাবর যে তখনো ক্রিজে। লাঞ্চ বিরতির পর পরের সেশনেই তুলে নেন ব্যক্তিগত দেড়শো! ফাওয়াদ আলম ফিরলেও হটাৎ ম্যাচে তখন ফলাফলের ইঙ্গিত! ব্যাটিং কলাপ্স করলে অজিদের জয়, টিকে গেলে পাকিস্তানের জয়!

শেষ সেশনে দরকার ছিলো ১৯৫ রানের! ওভার প্রতি ৫ এর উপরে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য তখনো ভালো সম্ভাবনা। বাবর-রিজওয়ানকে দ্রুত ফেরাতে পারলে এই টেস্টে জয় পাওয়াটা কঠিন হবে না। কিন্তু করাচির ৩৮ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঘামে ভেজা বাবর যে ঠান্ডা মাথায় অজি বোলারদের একের পর এক বল প্রতিরোধ করে চলেছেন।

ইতোমধ্যেই চতুর্থ ইনিংসে অধিনায়ক হিসেবে খেলে ফেলেছেন সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। শেষ সেশনে ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৪ রান দূরে! নাথান লিঁওর বলে ধরা পড়লেন তিনি। ৪ রানের আক্ষেপ নিয়ে ফিরলেও ১৯৬ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলে দলকে ফেরালেন হারের মুখ থেকে।

শেষদিকে অজিদের জয়ের কিছুটা আশা জাগলেও রিজওয়ানের সেঞ্চুরিতে এক ঐতিহাসিক ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়ে পাকিস্তান। লম্বা সময় টেস্টে নিষ্প্রভ বাবর ফিরলেন সম্রাটের মতোই! রাজকীয় এক প্রত্যাবর্তনে দলের বিপর্যয় কাঁধে নিয়ে ম্যাচ বাঁচালেন অধিনায়কখচিত ইনিংস খেলেই!

সময় যখন বাবরের ঠিক পুরোপুরি পক্ষে ছিল না, তখন বাবর সে কাজটাই করলেন যেটার সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। পাকিস্তানে এমনিতেই অধিনায়কের কাজটা কঠিন। আর মাত্র ২৭ বছর বয়সেই বাবর সব ফরম্যাটের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, আর সেটা এতটাই খাঁদহীন যে – প্রায়ই দেশটির প্রধানমন্ত্রীর খেলোয়াড়ী জীবনের সাথে তাঁর তুলনা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link