ফিট আজম খানরা কি আরো ভালো খেলতেন?

আলু, লাড্ডু, হাতি, গোলগাপ্পা, বিগ বয়। 

রাস্তার দেয়ালগুলোতে এই ধরনের শব্দগুলো পাবেন না আপনি, কিন্তু আজম খান নিজের জীবনের আপ্তবাক্য মেনে নিয়েছিলেন এই শব্দগুলোকেই। কাগজে লিখে টানিয়ে রেখেছিলেন নিজের দেয়ালে। 

আজম বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে বলতেন তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ ? আমি বলতাম এগুলোই আমার মোটিভেশন।’

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই সমালোচনা আজম খানের পিছু ছাড়েনি। গুগলে আজম খান লিখে সার্চ করলেই উত্তরগুলো আসে অনেকটা এরকম – নেপোটিজম, মোটু, হাতি। খানিকটা বেশি ওজনের শরীরের ভার যেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই বইতে হচ্ছে তাঁকে। 

পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক মইন খানের ছেলে আজম। খেলোয়াড়ি ছাড়ার পর ক্রিকেট কোচিংয়ে জড়িয়ে পড়েন মইন। পিএসএলে তাঁর দল কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়েই প্রথম লাইম লাইটে আসেন আজম। ২০১৯ পিএসএলে নিজের একমাত্র ম্যাচে ১৫ বলে ১২ রান করে আউট হন ২০ বছর বয়সী আজম। রান না পাওয়ার কারণেই কিনা সমর্থকদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে আজমের শরীরের উপর। তাঁদের কথাবার্তা তাঁকে এতটাই আঘাত করেছিল যে আজম নিজের অনুভূতি লিখে রেখেছিলেন ডাইরিতে। 

আজম বলেন, ‘পিএসএলে সুযোগ পাবার পর সবাই আমার ওজন নিয়ে কথা বলতে থাকে এবং আমার শরীর ক্রিকেটের জন্য উপযুক্ত নয়।’

এক বছর বাদেই সবাইকে ভুল প্রমাণ করেন আজম। ২০২০ পিএসএলের প্রথম ম্যাচেই খেলেন ৩৩ বলে ৫৯ রানের ম্যাচজয়ী এক ইনিংস। বছরের পুরোটা সময় তিনি ব্যস্ত থাকেন কঠোর পরিশ্রমে। পাকিস্তান ক্রিকেট একাডেমিতে সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিমগ্ন থাকেন প্রস্তুতিতে। জিমে সময় কাটান, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনেন, বিগ হিটিংয়ে পারদর্শী হন। এক বছরের মাঝেই ৩০ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেন। 

২০২২ পিএসএলেই জায়গা মেলে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায়। জাতীয় দলে ডাক পাবার আগেই সিপিএলের দল বার্বাডোস রয়্যালসের হয়ে খেলে ফেলেন। গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প হত। 

কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটেনি। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপগামী পাকিস্তান দলে ডাক পান আজম। কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাঁকে বাদ দিয়ে দলে নেয়া হয় সরফরাজ আহমেদকে। সাবেক পাকিস্তানি পেসার আকিব জাভেদ মন্তব্য করেন আজমের হয় চিকন হতে হবে নয়তো ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হবে। 

জবাবটা যেন তৈরিই ছিল আজমের কাছে। বলেন, ‘মোটা হওয়াটা বিষয় না, মূল ব্যাপারটা পারফরম্যান্স। আপনি নিশ্চিতভাবে ফিট ৪০০ রান করা ক্রিকেটারের চাইতে মোটা ৮০০ রান করা ক্রিকেটারকেই দলে চাইবেন। আমি ব্যাপারটা এভাবেই দেখি।’

কিন্তু সেই ৮০০ রান করা ক্রিকেটার যদি আরেকটু ফিট হতো, নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে আরেকটু কাজ করত, তবে কি সে ১০০০ রান ছাড়িয়ে যেত?

ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং চেন্নাই সুপার কিংসের সাবেক ট্রেনার গ্রেগ কিং ব্যাপারটা এভাবেই দেখেন। তাঁর ভাষায়, ‘একজন ক্রিকেটার স্কিলফুল হলেই যে সফল হবেন ব্যাপারটা এমন না। কিন্তু আপনি যদি দারুণ ফিটনেসের সাথে স্কিলের সম্মিলন ঘটনা, তবে সফলতার হার বেড়ে যায় বহুলাংশে।’

প্রশ্নটা আসলে সেখানেই, যদি আজম শারীরিকভাবে আরো ফিট হতেন তবে কি আরো ভালো আজম খানকে পেতো ক্রিকেট বিশ্ব? 

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটার রাকিম কর্নওয়ালের গল্পটাও একই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সবচেয়ে বেশি ওজনের ক্রিকেটার তিনি। শুরুতে ক্রিকেট এবং ফুটবল দুটো খেললেও পরবর্তীতে বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটকেই।

ঘরোয়া ক্রিকেটে রীতিমত অনবদ্য পারফর্ম করেই জায়গা করে নেন জাতীয় দলে। কিন্তু নিজের তৃতীয় টেস্টের আগেই সাবেক ক্যারিবীয় স্পিনার ল্যান্স গিবস মন্তব্য করেন, কর্নওয়াল কেবল দুই পা হাঁটেন এবং বল ছোঁড়েন। যদিও কেনি বেঞ্জামিন এবং স্যার কার্টলি অ্যামব্রোজরা কর্নওয়ালের পক্ষে প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে তখনই জীবনে প্রথমবারের মত কর্নওয়াল বুঝতে পারেন তাঁর শরীর নিয়ে বাকিরা কি ভাবে। 

তিনি বলেন, ‘আমি আমার শরীরের গঠন বদলাতে পারবো না। আমি দাবি করবো না আমি দারুণ ফিট। সবাই খাটো হবে না কিংবা সবাই চিকন হবে না। আমি যেটা করতে পারি সেটা হলো মাঠে নেমে নিজের সামর্থ্যের জানান দেয়া।’

নিজের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় টেস্টের মাঝামাঝি সময়ে হাঁটুতে অপারেশন হয় তাঁর। এরপর ফিরে এসে সাত টেস্টে ২১ উইকেট নিলেও জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েন । এরপর আর ফিরতে পারেননি। তাঁর পারফরম্যান্স বাজে হবার পেছনে নানা কারণ আছে। হয়তো ইনজুরির কারণে বোলিংয়ের ধার কমে গেছে, তাঁর ওজন নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলায় নির্বাচকরাও খানিকটা বিব্রত থাকেন। দক্ষিণ আফ্রিকান সিসান্দ্রো মাগালা এবং প্রমীলা ক্রিকেটার লিজি লির গল্পটাও একই। 

মাগালা দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে সাতটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নেন এবং ২০২২ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি ছিলেন। কিন্তু এখনো জাতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি। মাগাল বলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকাতে ফিটনেস বলতে দুই কিমি দৌড়কে বুঝায়। দলে যোগ্য হবার জন্য আপনাকে আগে সাড়ে আট মিনিট দুই কিমি দৌড়াতে হবে।’

মাগালা দৌড় শেষ করেছিলেন আট মিনিট ৪২ সেকেন্ডে। মাত্র ১২ সেকেন্ডের জন্য তাকে বিবেচনা করা হয়নি জাতীয় দলের জন্য, এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেটেও বেঞ্চে বসতে হয়েছে। মাগালা এর যৌক্তিকতা খুঁজে পান না, প্রশ্ন তোলেন, ‘ক্রিকেট মাঠে আপনাকে কোন সময় টানা দুই কিলোমিটার দৌড়াতে হবে?’

তাঁর এই প্রশ্নের জবাবটাই দেন কিং, দৌড় কেন ক্রিকেটের জন্য জরুরি।  তিনি বলেন, ‘যখন আমরা দৌড়াই, আমরা দেখি অ্যারোবেটিক এবং কার্ডিওভাস্কুলার পেশির সক্ষমতা। অ্যারোবেটিক ফিটনেস দেখে আমরা বুঝতে পারি একজন ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ সক্ষমতা যা কিনা পেসারদের জন্য জরুরি। তাছাড়া এটা আরো বুঝায় হাই ইন্টেসিটির কোনো কাজের পর সে কত দ্রুত ফিরে আসতে পারে। অ্যারোবেটিক ফিটনেস কম হলে আউনি হয়তো চাপের মুখে শুরুর দিকে ভাল করবেন, কিন্তু দ্রুতই খেই হারিয়ে ফেলবেন। পেসারদের জন্য এটা বেশি জরুরি কারণ তাঁদেরকে টানা বল করতে হয়। সেক্ষেত্রে দ্রতু রিকোভার করার ক্ষমতা থাকতে হয়।’

তবে চারিদিকের শরীর নিয়ে সমালোচনা বারবার প্রভাব ফেলেছে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যে। মাগালা তো ভুগছেনই, কর্নওয়াল সবসময় এসব থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন। বলেন, “প্রত্যেকেরই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে।” আজম খানকে তো প্রতি মূহুর্তে মুখোমুখি হতে হয় এসবের। 

ডাক্তার মারিয়া-ক্রিস্টিনা কস্টেলি বলেন, ‘পেশিবহুল শরীরের প্রতি একটা ঝোঁক থাকে পুরুষ অ্যাথলেটদের। একে বলে বডি ডাইমর্ফিয়া, ফলে যারা স্থুলকায় তাঁদের মাঝে জিমে বেশি সময় কাটানোর প্রবণতা দেখা দিতে পারে।’

তবে খাবারের প্রতি ঝোঁকটাও অনেক সময় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃত অ্যাথলেট হয়ে উঠতে হলে ফুড ডায়েট অত্যাবশ্যক। আজম মজা করে বলেন, ‘আমি পানি খেলেও ওজন বেড়ে যায়। তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আমি ডায়েট মেনে চলছি, খাবারের তালিকা থেকে অনেক কিছুই বাদ দিয়েছি।’ কর্নওয়াল অবশ্য এখনো প্রোটিনের উপরই নির্ভরশীল, তবে সেটা নির্দিষ্ট মাত্রায়। কিন্তু যখন দেশের বাইরে সফরে যায় তখন কি ডায়েট মেনে খাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে?

ঘুরে ফিরে সেই কিংয়ের প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়, স্থুলকায় ক্রিকেটাররা যদি  শারীরিকভাবে ফিট হতেন তবে কি তাঁদের বেটার ভার্সনটা পেত না ক্রিকেট বিশ্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link