বহু দেরি হয়ে গেল, বন্ধু

চল্লিশে হয় চালশে, ক্রিকেটে বাতিল ধরা হয় ত্রিশের পরেই। তবে এমন কিছু উদাহরণও আছে ক্রিকেটে যারা কিনা অভিষিক্তিই হয়েছিলেন ঐ ‘বাতিল’ বয়সে। এমন কিছু বয়স্ক অভিষিক্ত ক্রিকেটারের গল্প বলার জন্যই আজ আমার ঝাঁপি খুলে বসেছি। 

‘সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়’ – যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘কাকাতুয়া’ কবিতার এই লাইন অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। লালনও তো বলেছিলেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ । ক্রিকেটের জন্য তা যেন আরো বেশি করে সত্য। অল্প বয়সে অভিষেক, এরপর বয়সের ‘পিক টাইমে’ ছেড়ে দিতে হয় ক্রিকেট।

চল্লিশে হয় চালশে, ক্রিকেটে বাতিল ধরা হয় ত্রিশের পরেই। তবে এমন কিছু উদাহরণও আছে ক্রিকেটে যারা কিনা অভিষিক্তই হয়েছিলেন ঐ ‘বাতিল’ বয়সে। এমন কিছু বয়স্ক অভিষিক্ত ক্রিকেটারের গল্প বলার জন্যই আজ আমার ঝাঁপি খুলে বসেছি।

  • ডন প্রিঙ্গল (৪৩ বছর ৪১ দিন)

জন্ম নিয়েছিলেন ম্যানচেস্টারে। তবে ইংলিশ বিলাসী শহর ছেড়ে তিনি দ্রুতই পাড়ি জমান ইস্ট আফ্রিকাতে। এরপর সেখানেই ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা প্রেমের চর্চা করতে থাকেন। সুযোগও মেলে এরপর, ১৯৭৫ নাগাদ ইস্ট আফ্রিকার (কেনিয়া) হয়ে ওয়ানডে অভিষেক হয় ডন প্রিঙ্গলের। তবে অভিষেকের সময় প্রিঙ্গলের বয়স ছিল ৪৩ বছর ৪১ দিন, ভাবা যায়!

ডন প্রিঙ্গল হয়তো তাঁর দেরিতে শুরু হওয়া ক্যারিয়ার আরো দীর্ঘায়িত করতে পারতেন। তবে সে সুযোগ তিনি পাননি। অভিষেকের ১১৫ দিনের মাথায় মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি এ পারের মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান ওপারে।

  • ফ্লাভিয়ান আপোনসো (৪৩ বছর ১১২ দিন)

ফ্লাভিয়ান আপোনসোর জন্ম হয়েছিল শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে। শ্রীলঙ্কা যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি সেই তখন তিনি দলের হয়ে খেলেছেন; তামিলনাড়ুর বিপক্ষে। তবে এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্রোহী লিগে খেলার জন্যে তিনি শ্রীলঙ্কায় নিষিদ্ধ হলে পাড়ি জমান নেদারল্যান্ডে।

শ্রীলঙ্কা ছাড়লে কি হবে, ক্রিকেটটা তিনি একেবারেই ছাড়েননি। ব্যাট-বলের চর্চা সেখানেও অব্যাহত রেখে দিলেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডের হয়ে অভিষেকও হয়ে গেল তাঁর। পুরো টুর্নামেন্টে নেদারল্যান্ডের খেলা পাঁচ ম্যাচে অংশ নিয়েই  তিনি করেন ৩০ গড়ে ১২০ রান। অফ ব্রেক বোলিংয়েও নেন ২ উইকেট। ভাল কথা, সে সময় আপোনসোর বয়স ছিল ৪৩ বছর ১১২ দিন!

  • লেনি লোও (৪৩ বছর ২৩৬ দিন)

দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া লেনি লোও সে দেশের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন ২৭ বছর। এরপরই তিনি জীবনের মাঝামাঝি সময়ে পাড়ি জমান নামিবিয়াতে।

নামিবিয়ার হয়েই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বাদ পান তিনি; সেও ২০০৩ বিশ্বকাপের ঘটনা। জিম্বাবুয়ের সাথে সে ম্যাচটাতে ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৬০ রান দিয়ে পেয়েছিলেন মাত্র ১ উইকেট। কিন্তু তাতে কি, ততক্ষণে ইতিহাসের পাতায় চলে গেছেন লেনি লুউ। আন্তর্জাতিক অভিষেকের সময় তাঁর বয়স যে ছিল ৪৩ বছর ২৩৬ দিন!

  • রাহুল শর্মা (৪৩ বছর ৩০৬ দিন)

দিল্লীতে জন্ম নেওয়া রাহুল শর্মা খেলতেন রঞ্জি ট্রফিতে। ছিলেন দিল্লীর ওপেনিং ব্যাটসম্যান। কিন্তু ভারতীয় দলে ডাক পাচ্ছিলেন না তিনি। আর এরপরই তিনি পাড়ি জমান হংকংয়ে।

২০০৪ সালে এশিয়া কাপে হংকংয়ের হয়ে অভিষেকও হয়ে যায় তাঁর। বয়স তখন ৪৩ বছর ৩০৬ দিন! হংকংয়ের হয়ে এরপর আরো ম্যাচ খেলেছেন রাহুল, করেছেন ২০ সেঞ্চুরি। ২০০৭ সালে নিজের শেষ ওয়ানডে খেলার সময় তাঁর বয়স ছিল ৪৭ বছর।

  • নরম্যান গিফোর্ড (৪৩ বছর, ৩৫৯ দিন)

নরম্যান গিফোর্ড ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হয়েছেন ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকের প্রায় ২৫ বছর পর। শুরু থেকে বলি তাহলে। প্রায় ২৮ বছর ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে গিফোর্ড ৭১০ ম্যাচে নিয়েছিলেন ২০৪৮ উইকেট। কিন্তু দুর্দান্ত এই পরিসংখ্যানের পরও ইংল্যান্ড দলে জায়গা মিলছিল না গিফোর্ডের।

ইংলিশ দলে তখন খেলছেন টনি লক আর ডেরেক আন্ডারউড। কিন্তু এরপর যখন গিফোর্ডের সামনে সুযোগ আসে গিফোর্ডের বয়স তখন ৪৩ বছর ৩৫৯ দিন। নিজের খেলা ২ ওয়ানডেতে তিনি নিয়েছিলেন ৪ উইকেট, ইকোনমি রেট ছিল ২.৫!

  • হার্বার্ট আইরনমঙ্গার (৪৬ বছর ২৪৭ দিন)

হার্বার্ট আইরনমঙ্গারের জীবনটাই গোটা চিত্রনাট্য। ছিলেন কৃষক বাবার ১০ সন্তানের শেষজন। প্রথম জীবনটা অর্থাভাবে এত দৈন্যতায় কেটেছে যে মেলবোর্নের রেলওয়েতে শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে। তবে ক্রিকেটের নেশা হার্বার্টকে ছেড়ে কখনওই যায়নি। কিন্তু নেশা থাকলে কি হবে, অস্ট্রেলিয়ার জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন ডানা মেলছিল না হার্বার্টের।

অবশেষে সেই স্বপ্ন ডানা মেলে ১৯২৮ সালে,ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। বয়স তাঁর তখন ৪৬ বছর ২৪৭ দিন। দেরিতে শুরু হলেও, দ্রুতই কিন্তু তিনি থেমে যাননি। ১৯৩৩ সালে যখন তিনি ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলতে নামছেন, তাঁর বয়স তখন ৫০ বছর!

  • ডন ব্ল্যাকি  (৪৬ বছর ২৫৩ দিন)

ডন ব্ল্যাকির প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারটা বেশ ভাল, ২৪ ম্যাচে নিয়েছেন ২১১ উইকেট। শুধু তাই না, ১৯২৬/২৭ মৌসুমে তিনি এক মৌসুমে বল করেছিলেন ২৪৯৫ টি যেটা কিনা কোন অস্ট্রেলিয়ান বোলারের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ বল করার রেকর্ড। যা হোক, অস্ট্রেলিয়ার মূল দলে তিনি ডাক পান ১৯২৩ সালে, বয়স যখন তাঁর ৪৬ বছর ২৫৩ দিন!

  • নোলান ক্লার্ক (৪৭ বছর ২৪০ দিন)

সব খেলোয়াড়েরা যখন অবসর নিয়ে বেশ কিছু বছর যাপন করে ফেলে, ঠিক সেরকম একটা বয়সে অভিষেক হয় নোলান ক্লার্কের। জন্মেছিলেন তিনি বার্বাডোসে, তবে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন নেদারল্যান্ডে। নেদারল্যান্ডকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে তুলতে তাঁর ছিল বেশ ভাল অবদান। তবে আইসিসি স্বীকৃত ওয়ানডে ম্যাচে তিনি অভিষিক্ত হন ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালে।

সেই বিশ্বকাপে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারলেও এখনও তিনি নেদারল্যান্ড ক্রিকেটে বেশ অবদান রেখে যাচ্ছেন। নেদারল্যান্ডের যুবদলের পরিকল্পনাগুলোর কোচ হিসেবে এখনও বহাল আছেন তিনি।

  • মিরন বখশ (৪৭ বছর ২৮৪ দিন)

ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তখন মাত্র ১২ বছর পেরিয়েছে, পাকিস্তান খেলতে নামছে ভারতের সাথে। ১৯৫৫ সালের সে টেস্টেই মিরন বক্সের মাথায় টেস্ট ইয়াপ পরিয়ে দেওয়া হয়।

২ টেস্ট ম্যাচে ৪৭ বছর বয়সে সুযোগ পেলেও খুব বেশি নজর কাড়তে পারেননি, ৫৭.৫০ গড়ে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। এরপরই জাতীয় দল থেকে বাদ পড়লেও ক্রিকেটটা কিন্তু এরপরও চালিয়ে গিয়েছেন মিরন বক্স। রাওয়ালপিন্ডির হয়ে পেশোয়ারের বিপক্ষে নিজের শেষ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলার সময় তাঁর বয়স ছিল ৫১ বছর!

  • জেমস সাউদারটন (৪৯ বছর ১১৯ দিন)

১৮৭০ এর দশকের সেরা স্পিনার মানা হয় জেমস সাউদারটিনকে। স্লো আর্মে পাইওনিয়ারও মানেন এই ইংলিশম্যানকে কেউ কেউ। জেমস সাদারটনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দুটোই সাসেক্সে। ক্যারিয়রের শুরুতে তিনি কাজ করতেন একজন হেয়ার ড্রেসার হিসেবে। সেই হেয়ারড্রেসার থেকে ক্রিকেটার, ক্রিকেটার থেকে সোজা আন্তর্জাতিক দল।

গল্পটা থ্রিলার গল্পের ক্লাইম্যাক্সের মতই চমক জাগানিয়া। আর সেই চমকের বড় অংশ হচ্ছে, অভিষেকের সময় সাউদারটনের বয়স- ৪৯ বছর ১১৯ দিন! এখন আধুনিক ক্রিকেটে ফিটনেসের যে কড়াকড়ি এই রেকর্ড মনে হয়না কেউ আর ভাঙতে পারবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...