‘ভালো-খারাপ, সবটা মিলেই আজ আমি এখানে’

সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক কে? – এই তালিকায় যে গুটিকয়েক তারকার নাম আসে তাঁদের একজন হলেন ইকার ক্যাসিয়াস। স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি তিনি। রিয়ালের হয়ে সম্ভাব্য যা যা অর্জন করা সম্ভব সবই তিনি অর্জন করেছেন এই জীবনে। স্পেনের হয়ে অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন বিশ্বকাপ ও ইউরো শিরোপা।

৪০ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তিনি বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হন ফিফা ডট কমের। সেখানে কথা বলেছেন নিজের জীবন, ফুটবল ও সাফল্য নিয়ে।

আপনার ৪০তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। দিনটি আপনার জন্য কতটা স্পেশাল?

ইকার ক্যাসিয়াস: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার জন্মদিন আমার কাছে সবসময়ই বিশেষ, তবে গত দু’বছর ধরে আমি হার্ট অ্যাটাকের তারিখটিও (১ মে) জন্মদিনের মতন করেই পালন করেছি। সেদিনে যেন আমার পূর্নজন্ম হয়েছিল।

২০১৯ সালে এই ঘটনা আপনাকে ফুটবল থেকে অবসর নিতে বাধ্য করেছিল। এই ঘটনার পর ফুটবল ও জীবনের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছে?

হার্ট অ্যাটাক অবশ্যই আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। এটি আমাকে বাধ্য করেছিল আমার ভালোবাসার জায়গা থেকে সরে আসতে, এমন একটা সময়ে যখন ফুটবলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারার সাধ ও সাধ্য আমার ছিল।

কিন্তু জীবন জীবনের মতন এগিয়ে যায় এবং সেই সাথে আগ্রাধিকারও পরিবর্তন হয়। জীবনের এই পর্যায়ে রিয়াল মাদ্রিদ, আমার ফাউন্ডেশন, লা লিগা এবং আমার ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলি নিয়েই ব্যস্ত আছি।

হৃদরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে আপনার কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে এবং কীভাবে এটি জীবন বাঁচাতে পারে?

আপনি ক্রীড়াবিদ হন কিংবা না হন, হৃদরোগ সনাক্ত করা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায় এবং সবার তা করা জরুরী। অহেতুক ভয় থেকে বাঁচতে প্রত্যেকেরই উচিত নিয়মিত চেক-আপ করা।

আমি বিভিন্নভাবে গবেষণা প্রকওল্পকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। আইডোভেনের একটি প্রকল্পের সাথে কাজ করে আমার বেশ ভালো লেগেছে। যা হল প্রাথমিক সনাক্তকরণের মাধ্যমে হৃদরোগ এবং আকস্মিক মৃত্যু রোধে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও পরিধেয় প্রযুক্তির ব্যবহার।

খেলোয়াড়দের এ ব্যাপারে কতটা সচেতন হওয়া উচিত?

আমরা ফুটবলাররা বিশ্বাস করি যে, আমরা যে পরিমাণ নজরদারির মধ্যে থাকি তাতে আমরা হার্টের সমস্যায় ভুগব না। তবে আমার মতো কেসে সেটা ঘটেনি। বড় বড় ক্লাবের খেলোয়াড়দের সবসময় লিমিট পুশ করতে হয়। আর সেই জায়গাতে এই সমস্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

এতকিছুর পরেও, আপনার ক্যারিয়ার থেকে সবচেয়ে মূল্যবান অর্জন কী? খেলোয়াড় হিসাবে যেটিকে আপনি অন্য সবকিছু থেকে এগিয়ে রাখেন?

আমার কাছে প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভালো সময় আপনাকে আল কিছু উপহার দিবে কিন্তু খারাপ সময় আপনাকে এমন কিছু শিক্ষা দিবে যা ভালো সময়ে কাজে লাগবে। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে আমার অভিষেক, প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা, লা ডেসিমা, দুটি ইউরো এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ। এর সমান কিছু হয় না।

আপনি স্প্যানিশ স্বর্ণযুগের অন্যতম একটা অংশ যা স্প্যানিশ ফুটবলকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল। ২০০৮ ইউরো ও কোচ লুইস অ্যারাগোনসের সাথে সেরা স্মৃতি কোনটা?

স্কোয়াডে আমাদের সম্পর্কটাই ছিল সেরা স্মৃতি। প্রতিটি খেলোয়াড়ই ছিল একে অপরের বন্ধু আর নেতৃত্বে ছিলেন অ্যারাগোনস। যিনি এই দলটার মধ্যে বিশ্বাস ঢুকাতে পেরেছিলেন যে, হ্যাঁ আমরা চাইলেই বড় কিছু করে দেখাতে পারবো। এবং সেটা পেরেছিও।

এরপর ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপটি এসেছিল। ইউরোজয়ী দল হিসেবে প্রবেশ করায় যে প্রত্যাশার পারদ বেড়ে গিয়েছিল আপনাদের প্রতি, সেটিকে কীভাবে সামাল দিয়েছেন?

আমরা সকলেই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। আমরা সত্যিকার অর্থেই একটা দল ছিলাম, প্রত্যেকের মধ্যেই একটা আলাদা মিল ছিল। ইউরো জিতে সরাসরি বিশ্বকাপ যাওয়ায় আলাদা একটা চাপ তো ছিলই।

কিন্তু আপনি যখন জানেন যে আপনার পিছনে পুরো দেশ রয়েছে এবং দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের লক্ষ্য একটাই, তখন ব্যাপারটা অনেক সোজা হয়ে যায়। আমাদের বিশ্বাস ছিল যে আমরা বিশ্বকাপ নিয়েই ঘরে ফিরবো। আর সেটাই আমাদের শেষ মুহূর্তপর্যন্ত উজ্জ্বীবিত করেছে জেতার জন্য।

আপনাদের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের কাছে হেরে। হন্ডুরাসকে ২-০ গোল হারানো বাদে অন্যান্য সমস্ত জয় এক গোলের ব্যবধানে…

সব ভালো তার, শেষ ভালো যার। আমরা শুরুটা খারাপ হয়েছিল কিন্তু শেষটা ছিল ভালো। আমরা কোনও ম্যাচই ডমিনেট করে জিতিনি। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের খেলাটা দিয়েছি। আমরা জানতাম যে আমরা সর্বদা স্কোর করতে পারি আর আমাদের ডিফেন্স ভাঙা এত শক্ত নয়। এই জিনিসটাই আমাদের সকলকে সাফল্যের বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল।

রোবেনের শট সেভ, পুয়োলের অভিনন্দন জানিয়েছে, ইনিয়েস্তার গোলের পরপর করা কান্না … ২০১০ এর ফাইনাল থেকে এই মুহুর্তগুলিকে কীভাবে স্মরণ করেন?

আমার মনে আছে এটি কোনও গোল ছিল না! (হাসি) সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছিল যে মনে হচ্ছিল সব স্লো মোশন হয়ে গিয়েছে। রোবেন বল নিয়ে আমার দিকে দৌড়ে আসছে, বলটা যখন শেষ মুহূর্তে কার্ভ করালেন শেষ মুহূর্তে পা সরিয়ে বলের লাইনে নিয়ে গেলাম আর বল তাতেই বাইরে। এই মূহুর্তটা আজীবন আমার মনে গেঁথে আছে।

পুয়োলের ক্ষেত্রে সত্যি হলো আমার কিচ্ছু মনে নেই। সেই সময়ে মাথার মধ্যে এত কিছু চলছিল যে আমি জানিই না ও কী বলেছে। এটুকু শুধু মনে আছে যে সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরেছিল।

তবে আন্দ্রেসের গোলে সব ছিল। নাভাসের ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেখান থেকে ইনিয়েস্তা তারপর সেস্ক। এরপর সেস্ক পায় তোরেসকে। তোরেসের লক্ষ্য ছিল ইনিয়েস্তা কিন্তু বল ডিফ্লেক্ট হয়ে আবার ফেরত আসে সেস্কের কাছেই। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর ভুল হয়নি, সেস্কের বলটা সেবার ইনিয়েস্তাকেই খুঁজে পেয়েছে…

এই স্মৃতো আমার কাছে স্লো মোশনই ছিল। প্রতিটি সেকেন্ডকে মিনিট বলে মনে হচ্ছিল। যে মুহূর্তে বলে পা ছুঁয়েছেন, সেখান থেকে বল জালে পৌছানোর প্রতিটি মুহূর্ত ছিল স্মরনীয়। আর গোলের পর কে কী করবে কেউ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যেন একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। যে যার মত যেদিকে পারে উদযাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।

আপনাদের বিশ্বজয়ের সার্কেল বন্ধ হয়েছিল ইউরো ২০১২ সালের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে ৪-০ ব্যবধানের জয় দিয়ে। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারকদের ইতিহাসের বৃহত্তম জয় ছিল সেটা।

কোনও দল এত বড় ব্যবধানে ফাইনাল জিততে পারেনি, তবে আমাদের প্রতিপক্ষের প্রতি সেই রেস্পেক্টটা ছিল। আমার বিপরীতে ছিলেন (জিয়ানলুইজি) বুফন, বন্ধু হিসেবে তাঁর মতন মানুষ হয় না। ফাইনাল হেরে গেলেও তার প্রতি সেই সম্মানটা আজও অটুট আছে।

ক্লাব স্তরে, রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে সব জিতেছে আপনি। ১৬ বছর বয়সে নরওয়েতে খেলতে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্লাবের অন্যতম সেরা অধিনায়ক হিসেবে তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জেতা… কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি মনে পরে?

আমি সবকিছুকে এক ধরণের বিবর্তন হিসাবে মনে করি। সেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলার জন্য আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে নিয়ে যাওয়ার মুহুর্ত থেকে শেষ পর্যন্ত, আমার ক্যারিয়ারের উত্থান-পতন সব অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছি। শিরোপাগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি ছিল যখন আমি নয় বছর বয়সে প্রথমবারের মতো রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে পা দিয়েছিলাম।

আমার অভিষেক হয়েছিল লা ক্যাথেড্রালে (অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সান ম্যামস স্টেডিয়াম)। সেই মুহূর্তটা আমি কখনও ভুলবো না। এক ম্যাচ খেলে ফেরত গিয়েছিলা কাস্তিয়ায় (মাদ্রিদের রিজার্ভ দল)। সেখান থেকে এক মৌসুম কাটিয়েছি যখন সিজার সানচেজের ব্যাক আপ হিসেবে। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো আপনাকে সামনে আগাতে এবং বড় হতে অনেক বড় সাহায্য করবে। এই মুহুর্তগুলোই আপনাকে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করে, সেরা হতে শেখায়। আমার সাথে যা যা ঘটেছিল, ভালো কিংবা খারাপ, সবটা মিলেই আজ আমি এখানে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link