আমি খেলবো, খেলতে আমাকে হবেই!

প্রতিবেশীদের বেকারত্বের কটুক্তিতে তুমি তখন বিধ্বস্ত। অথবা জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বারবার ব্যর্থ হতে হতে তখন তুমি ভাবতে শুরু করেছো মেডিকেলের ভুত ছেড়ে জেনারেল লাইনেই শেষমেশ ভর্তি হয়ে যাবে। তখন তুমি অসহায়। নিস্তব্ধতার একটা কালো মসলিন গ্রাস করছে তোমাকে।

প্রতিবেশীদের বেকারত্বের কটুক্তিতে তুমি তখন বিধ্বস্ত। অথবা জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বারবার ব্যর্থ হতে হতে তখন তুমি ভাবতে শুরু করেছো মেডিকেলের ভুত ছেড়ে জেনারেল লাইনেই শেষমেশ ভর্তি হয়ে যাবে। তখন তুমি অসহায়। নিস্তব্ধতার একটা কালো মসলিন গ্রাস করছে তোমাকে।

সারাদিনের চাকরি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে রাত নয়টায় তুমি যখন বাড়ি ফিরছ, ঠিক যেন ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে শিয়ালকোটের মাটিতে ওয়াকার ইউনুসের বিষাক্ত একটা বাউন্সারে ষোলো বছরের এক ব্যাটসম্যান রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। চারিদিকের মানুষজন তখন আতঙ্কিত।

টিমের ফিজিও থেকে ক্যাপ্টেন – সবাই সেই রক্তাক্ত ষোড়শীয় নবাগতকে ক্রিজ ছেড়ে হাসপাতালে যাবার নির্দেশ দিচ্ছে। পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা উল্লাসে ঠাট্টা করছে – ‘ইয়ে বাচ্চা খেল পায়েগা ক্যয়া।’

ঠিক তোমার মতো, তোমার এই বেকারত্বে বিহ্বল হয়ে তোমার পরিবার চাকরির চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় মন দিতে বলছে, ঠিক যেভাবে বারবার জয়েন্টে ব্যর্থ ছাত্রটিকে তার বাবা মেডিকেলের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে জেনারেল লাইনের দিকে পা ফেলতে বলছে।

তুমি তখন দোমনা। কি করবে ভাবছো। একবার চোখ বোজো। কিছু মিনিট। কিছু সেকেন্ড। ফিরে যাও ১৯৮৯-এর শীতকালে পাকিস্তানের মাটিতে যখন জীবনের প্রথম ম্যাচে মাত্র ১৫ রানে বোল্ড করা সেই ওয়াকারই সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে বাউন্সারে রক্তাক্ত করল বছর ষোলোর কিশোরকে।

দলের রান তখন ৩৮ রানে ৪ উইকেট। সেই ম্যাচে তাকে খুব দরকার ছিল ম্যাচটা ড্র করার জন্য ঠিক যেমন তোমাকে দরকার তোমার পরিবারের। রক্তাক্ত তখন সেই কিশোরটি। কপালের লাল স্রোত মিশে গেছে লাল বলের সাথে। ক্রিজে আগুন ধরাচ্ছে ওয়াকার-ইমরান-আকরামরা।

আউট হয়ে গেছেন আজহার, শ্রীকান্ত এমন কি কপিল দেব। ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। চোখ বুজল ঠিক তোমার মতো। কিছু মিনিট। কিছু সেকেন্ড। তারপর সবাই যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত তখন উঠে দাঁড়িয়ে সে মাত্র দুটি শব্দ উচ্চারণ করল, ‘ম্যায় খেলেগা… ম্যায় খেলেগা।’

হতবম্ব সবাই। হতবম্ব ওয়াকার। রক্ত মুছে ব্যাট ধরল সে। ওয়াকারের পরের দুটি বলেই ব্যাক টু ব্যাক বাউন্ডারি। সেই ইনিংসে ৫৭ রান করে দলের নিশ্চিত হার বাঁচাল বছর ষোলোর কিশোরটা। আর ওয়াকারকে ব্যাক টু ব্যাক বাউন্ডারি মেরে ঠিক এইভাবেই বাঘের নজরে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল সে ওয়াকারের দিকে।

তুমিও চোখ বোজো। রাত্রের বিছানাটা একটা ব্যর্থদিনের কান্নায় না ভিজিয়ে সময় নাও কিছু মিনিট। কিছু সেকেন্ড। পরদিন সকালবেলায় যখন তোমার পরিবার স্থানীয় কোনো কলেজে জেনারেল লাইনের ফর্মে তোমার সইয়ের অপেক্ষারত তোমার মেডিকেলের স্বপ্ন চুরমার করে, পরদিন সকালে যখন তোমার চাকরির ব্যর্থ চেষ্টায় বিব্রত হয়ে সবাই আবারো ব্যাবসায় লেগে পড়ার কথা বলবে, তখন তুমি এগিয়ে যাও বুক উঁচু করে, মাথা সোজা করে, আর বুক চিতিয়ে বলো সেই দুটি অমর শব্দ- ‘ম্যায় খেলেগা… ম্যায় খেলেগা’ কিংবা ‘আমি খেলবো, খেলতে আমাকে হবেই!’

জীবন মানে অন্যের সাহায্যে সুখ ভোগ করা নয়, জীবন মানে শত আঘাতেও ক্রিজে আঁকরে থেকে নিজের ইচ্ছা ছিনিয়ে নেওয়া।এখানেই বড়লোকি বাবার টাকায় ম্যানেজমেন্ট কোটায় মেডিকেল পাওয়া ছাত্রের জীবন খাটো হয়ে যায় পাঁচ বার ব্যর্থ হয়েও ষষ্ঠবারে নিজের চেষ্টায় জয়েন্ট ক্র‍্যাক করা ছেলেটার কাছে।

আর বিশ্বে বারবার এরকম জয়ের নেপথ্যে থেকে যায় সেই দুটি শব্দ – ‘ম্যায় খেলেগা… ম্যায় খেলেগা’ আর যেদিন তুমি সফল হবে, সেদিন, হ্যাঁ, ঠিক সেইদিনই তুমি এরকম বাঘের নজরে তাকিও তোমার সমালোচকদের দিকে।সেই দিনটা তোমার,শুধুই তোমার। আর সেইদিন তুমি তোমার চারপাশে একটাই চিৎকার অনুভব করবে – ‘সা… চি… ন… সা… চি… ন…’

জীবনে বারবার হারা মানুষগুলোও দিনের শেষে জিততে চায়, সাইকেলের মেকানিকটাও প্রতিদিনের গড় ২০০ টাকা রোজকার করতে করতে হাল ছাড়ে না, তারপর একদিন তার ডাক আসে কোনো নামি গ্যারেজ থেকে, ট্রেনে গান গেয়ে যাওয়া রানু মন্ডলের কাছেও একদিন এসে যায় এ আর রহমানের শুভেচ্ছা বার্তা। আর একটা হারে ভেঙে না পড়ে আবার উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাট ঘোরানোর পিছনে রয়ে যায় একটা শচীন টেন্ডুলকার আর রয়ে যায় দুটি শব্দ – ‘ম্যায় খেলেগা, ম্যায় খেলেগা!’ কিংবা ‘আমি খেলবো, খেলতে আমাকে হবেই!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link