রিং মাস্টার জেমিসন

টিন এজ বয়সে তিনি স্বপ্ন দেখতেন এনবিএতে খেলবেন, বাস্কেটবল কোর্টে ঝড় তুলবেন। তাঁর স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক আবার চাইতেন তাঁকে জ্যাভলিন থ্রোয়ার বানাতে। অন্যদিকে বাবা চাইতেন ছেলে স্প্রিন্টার হোক। চাইলে তিনি বক্সারও হতে পারতেন। কারণ, তাঁর একেকটা ডেলিভারিতে তো বক্সিং রিংয়ের একেকটা নকআউট পাঞ্চ!

কিউইদের পেস আক্রমণে জেমিসনের উত্থান কি আশীর্বাদ স্বরূপ বলা যায়? বলা যায় বটে! তবে জেমিসন এসে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন কিউই নির্বাচকদের। একাদশের হিসাব কষতেই এখন অনেক সময় পেরিয়ে যায়। ভুরি ভুরি সিমারে ভরা স্কোয়াড। কাকে রেখে, কাকে খেলাই বিড়ম্বনা যাকে বলে আর কি।

এই বিড়ম্বনাকে অবশ্য বড় করেই দেখতে হবে, কেননা এই বিড়ম্বনাই একটা দলকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দলীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সুষম প্রতিযোগিতা তৈরি হলে সবাই পারফর্ম করা শুরু করে দেয়। দিন শেষে সামগ্রিকভাবে লাভবান হয় দল।

সবমিলিয়ে মোটে এক বছর! জেমিসনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উত্থানের বয়স। এই এক বছরে খুব যে বেশি খেলতে পেরেছেন তা কিন্তু না! করোনা মহামারীর অল্পকিছুদিন আগে তাঁর অভিষেক। তবে করোনা মহামারীর পর ক্রিকেটবিশ্বে প্রতিপক্ষের জন্য মহামারীরূপে আবির্ভাব ৬ ফুট ৮ ইঞ্চির দীর্ঘাদেহি এই বোলারের। গায়ে এই তকমা স্বল্পাকারে লেগে গেছে ভারতের বিপক্ষে অভিষেকে। প্রথম দুই টেস্টে শিকার ৯ উইকেট। শিকারের তালিকায় — বিরাট কোহলি, চেতেশ্বর পূজারা, ঋষাভ পান্ত, রবীন্দ্র জাদেজার নাম ছিলো।

টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট ও নিল ওয়াগনারের পাশে জেমিসনের নব ছায়া কিংবা প্রবীণদের ছায়ায় মাঝেও আবির্ভূত হওয়া নতুন জেমিসনে উপকৃত সমগ্র ক্রিকেট বিশ্ব। ৮ টেস্টেই পাঁচবার নিয়েছেন ৫ উইকেট করে। পেইস, সুইং, বাউন্সে নাভিশ্বাস করে তুলেছেন ব্যাটসম্যানকে। গতকাল বিরাটের আউট যারা দেখেছেন, কেবল তারাই বলতে পারবেন — জেমিসন বাউন্সের সাথে কতোটা তীক্ষ্ণ সুইং করাতে জানেন। বর্তমানের সেরা ব্যাটসম্যানকে ভড়কে দিয়েছেন নিমিষেই। দুই ইনিংসেই বিরাটের উইকেট নিয়েছেন জেমিসন।

এ চারজনের ভিড়ে আড়ালে পড়ে যান লোকি ফার্গুসন। অথচ গতির ঝড়ে যিনি কিনা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন। পেশাদার ক্রিকেটের এটাই সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য আবার নিষ্ঠুরতম চিত্রও। একজনের জন্য ছাড়তে হয় আরেকজনকে স্থান। কিউইরা নিজেদের এতোটাই শক্ত-পাকাপোক্ত করেছে যে, তাদের ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিতে এসব এখন ঘটতেই থাকবে। অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স করেও দলে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে গতকালের জয় প্রত্যাশিত এবং আকাঙ্ক্ষিত দুটোই বলা চলে৷ আইসিসি ইভেন্টে শেষ কয়েকবছর ধরে জয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও হাতছাড়া হয়েছে স্বপ্ন। খুব কাছে গিয়েও তাদের ছুঁয়ে দেখা হয়নি স্বপ্নকে। ক্রিকেটীয় কঠিন বাস্তবতার কষাঘাতেও হেরে যেতে শিখেনি এ দলটা। তাই এবারের এ ট্রফি তাদের নিয়ে গেছে ভিন্ন এক চূঁড়ায়। যে চূঁড়ায় কিউইরা একাই বসবাস করে। যে চূঁড়ায় ইতিহাসে প্রথমবার শত ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেও মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়ালো কিউইরা।

একটু অতীত ঘেঁটে দেখি।

অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে প্রোটিয়াদের একাধিক ভুলকে কাজে লাগিয়ে কিউইদের ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার পর, মেলবোর্নে অসহায় আত্মসমর্পণের গল্প থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপে ওল্ড ট্রাফোর্ডে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে বিধ্বংসী বোলিংয়ে ভারতকে কুপোকাত করেও, লর্ডসে ফাইনালের নিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়ে নিষ্ঠুর পরাজয়ের পর আর মানতে বাকি নেই যে; ক্রিকেটে এখন ভারতকে রুখে দেওয়ার মতো কোনো দল থাকলে সেটা নি:সন্দেহে নিউজিল্যান্ড। অর্থ্যাৎ ক্রিকেটে এখন অন্যতম সেরা দল তাঁরাই।

পরপর দুই বিশ্বকাপে শিরোপা হাতছাড়া! সবশেষ বিশ্বকাপ জিততে পারলে রস টেইলরকে হয়তো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে দেখাও যেতোনা। কিন্তু নিয়তি ডেকে এনেছে তাকে এখানে। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় দলকে শিরোপা এনে দিলেন ব্যাট হাতে অধিনায়ককে সাথে নিয়ে। কিউই ইতিহাসের দুই সেরা ব্যাটসম্যানের হাত ধরেই এলো প্রথম বিশ্বসেরার তকমা।

উইলিয়ামসন-টেইলরের ব্যাটে শেষদিনের শেষ সেশনে জয় আনতে পেরেছে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু বোলারদের কৃতিত্বেই তো এই ফাইনাল তাদের হলো। জেমিসন, সাউদি, বোল্ট, ওয়াগনারের অনবদ্য পারফরম্যান্সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিলো। তাই কিউইদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনের পেছনে মূল কৃতিত্ব বোলারদেরকেই দিতে হবে নি:সন্দেহে। 

আর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব অবশ্যই জেমিসনের। সেজন্যই তো তিনি ফাইনালের ম্যাচ সেরা। টিন এজ বয়সে তিনি স্বপ্ন দেখতেন এনবিএতে খেলবেন, বাস্কেটবল কোর্টে ঝড় তুলবেন। তাঁর স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক আবার চাইতেন তাঁকে জ্যাভলিন থ্রোয়ার বানাতে। অন্যদিকে বাবা চাইতেন ছেলে স্প্রিন্টার হোক। চাইলে তিনি বক্সারও হতে পারতেন। কারণ, তাঁর একেকটা ডেলিভারিতে তো বক্সিং রিংয়ের একেকটা নকআউট পাঞ্চ!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...