মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে তখন প্রবেশ করছে রাজনীতির করালগ্রাস। সহিষ্ণুহৃদয় ভারতবর্ষ আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে তার কভার পিকচারটা। অশোক চক্রের চ্চব্বিশটা স্পোক হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মধ্যবিত্তের ঘর ছেড়ে। সাম্যবাদ বনাম বুনিয়াদের লড়াইয়ে বলিদান সাধারণ মধ্যবিত্তর স্বপ্নগুলো। তখনও ফেসবুক, টুইটার ওঠেনি।
ইচ্ছা করলেই সরকার বিরোধী প্রতিবাদী পোস্ট আপলোড করা যেতনা। ছিল কিছু সাদাকালো নোকিয়া মোবাইল। সাধারণ মধ্যবিত্তের দীর্ঘ অফিসযাত্রার সাথী। রাজনীতি, সমাজনীতির বনেট খুলে হঠাৎ করে একমুঠো খোলা হাওয়া প্রবেশ করল মধ্যবিত্তের জীবনে। সাথে থাকা নোকিয়া ফোনগুলির কিপ্যাডে *১৪৩# বা *১২১# এর টাইপে মধ্যবিত্ত খুঁজে নিল অশোকচক্রের চব্বিশটা স্পোক। মধ্যবিত্তের মনে সবুজ মাঠের প্রতিবিম্ব। অফিসে কাজ করতে করতে মধ্যবিত্তের মনে দুটি প্রশ্ন জাগ্রত হতে থাকল –
১.দাদা-ছোটে কি আউট হয়ে গেছে?
২. ওদের গিলি-হেডেনের একজনকে যেন আমাদের জাহির প্রথম ওভারেই ফেরায়।
আস্তে আস্তে সবুজ ইডেন কিংবা মেলবোর্নের ম্যানিয়া প্রবেশ করতে থাকল পশ্চিমবঙ্গের আঁনাচে কাঁনাচে। সকালের আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া’ এর খবরের মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হতো উন্মাদনা। সবার ঘরে টিভি থাকতোনা। ভাড়া করা টিভিতে অফিস শেষে মধ্যবিত্ত খুঁজে নিত তাদের জীবনের সমস্ত চাওয়া-পাওয়া আবেগগুলো।
কখনও বা ভোর পাঁচটায় উঠে ব্রাশ করতে করতে তারা লক্ষ্য রাখত ২২ গজের দাদা-ছোটের দৌড়্গুলো।মধ্যবিত্তের জীবন-রেনেসাঁর কান্ডারী হয়ে উঠল একটা ছোট্ট প্রতিদ্বন্দীতা-বাঘ বনাম ক্যাঙারু,সৌরভ বনাম পন্টিং, হেডেন-গিলক্রিস্ট বনাম শচীন-শেহবাগ। সুব্রত-প্রশান্ত-শ্যামের কলকাতা ময়দান ছেড়ে বাঙালী ভাসিয়ে দিল টিম ইন্ডিয়ার স্পর্ধা বনাম ব্যাগি গ্রিনের আস্ফালনের যুদ্ধে।
লড়াই ছিল অনেকগুলো টুকরো টুকরো। হরভজন বনাম পন্টিং,শচীন বনাম লি,সৌরভ বনাম ওয়ার্ন। কুরুক্ষেত্র হিসাবে কখনও ইডেনের দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা,কখনও বা মেলবোর্নের ভোরবেলা। কয়েন নিয়ে এগিয়ে আসত সৌরভ গাঙ্গুলি আর রিকি পন্টিং,কয়েন ঘোরার সাথে সাথেই ঘুরে গেল মধ্যবিত্তের জীবন চাকা,ঘুরতে আরম্ভ করল অশোক চক্রটাও।
নীল জার্সি গায়ে নামত বেহালার বাঙালি আর মুম্বাইয়ের ছোটেলাল আর সবুজহলুদে আস্ফালন করতে আসত কিঙ্গারের হেডেন আর বেলিঞ্জেনের গিলক্রিস্ট। শতবর্ষের ক্রিকেট ইতিহাসে জুটি বনাম জুটির লড়াইয়ে মাদকতা খুঁজে নিয়েছিল ২০০০ বৎসর-উর্ধবসময়ের একগুচ্ছ বাঙালি। কখনও ম্যাকগ্রার বলে সৌরভ-শচীন জুটির বিচ্ছেদ বিমর্ষ করত তাদের, কখনও বা জাহিরের বলে ছিটকে দেওয়া গিলক্রিস্টের স্টাম্প উত্তাল করত এগারো কোটির বাঙালিকে। জুটি বনাম জুটি, বেহালার এক রোগা বাঙালির বিশ্বসেরার দাবি বনাম বিশ্বসেরাদের আভিজাত্যের হুঙ্কার।
বুক ভেঙেছে অনেকবার, কিন্তু তবুও ভাঙেনি মধ্যবিত্ত। তবুও ৫০ গ্রামের প্লাস্টিকের বল আর বাঁশের ব্যাটে সৌরভ-শচিন-হেডেন হওয়া চলত। ২০০৩ ফাইনালের পরেও সেই একইভাবে টিভি ভাড়া করা চলত, চলত বিকালবেলায় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নেওয়া, চলত ভোরবেলায় সাড়ে চারটায় অ্যালার্ম দেওয়া, নেপথ্যে ক্রিকেট ইতিহাসের তিলোত্তমা বনাম তিলোত্তমার দ্বন্দ্ব- নীলচে ভারত আর হলদে অস্ট্রেলিয়ার স্পন্দিত লড়াই।
সাদাকালো মধ্যবিত্তের জীবনে একমুঠো ফাগুনে আলো। আজ ফাঁকা ইডেনে ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া হলে অজান্তেই ভেসে ওঠে কিছু সিনেমার রিল- হরভজনের প্যাঁচানো অ্যাকশন, পন্টিংয়ের চামচ তোলা শট, আর সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দুশিবিরে দুই জুটির দ্বৈরথ- সৌরভ-শচীন বনাম হেইডেন-গিলি।
কফি হাউসের আড্ডার মতোই সেই ইডেন বা সেই মেলবোর্ন আর কোনোদিনই ফিরবেনা মধবিত্তের এক ফালা আলো হয়ে। কারণ এগারোটা ‘SAHARA’ আজ ‘সাহারা’ মরুভূমি মধ্যবিত্তের জীবন হতে।