টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বের সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট কি? অবশ্যই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। তবে, হয়তো ভারতে আইপিএল এতটা জোরদার হত না যদি না আসতো ২০০৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। সেদিন ছিল প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল। ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টির বিকাশে এই দিনটির অবদানই সবচেয়ে বেশি।
শেষ ওভারে পাকিস্তানের জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৩ রান, হাতে মাত্র ১ উইকেট। বল হাতে যোগিন্দর শর্মা আর স্ট্রাইকে মিসবাহ উল হক! প্রথম বলেই ওয়াইড দিলেন জোগিন্দর। পরের বলটা ডট। অর্থাৎ ৫ বলে দরকার ১২ রান। পরের বলেই ফুলটসে লং অফের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে সমীকরণ কিছুটা সহজ করে নেন মিসবাহ। ৪ বলে প্রয়োজন ৬ রান, ভারতের দরকার ১ উইকেট!
তৃতীয় বলে জোগিন্দর শর্মার স্লোয়ারকে স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে স্কুপ করলেন মিসবাহ। বল ইনার সার্কেলের ভেতরেই সোজা শ্রীশান্তের হাতে! বল করার আগেই ডিপ ফাইন লেগ থেকে শ্রীশান্তকে শট ফাইন লেগে আনা হলো। সবকিছুই খেয়াল করলেন মিসবাহ।
কিন্তু, সেই ফাঁদেই কি’না পা দিলেন তিনি! শ্রীশান্তের মাথার উপর দিয়ে বাউন্ডারি মারার প্রয়াশ করলেও জোগিন্দরের পরিকল্পিত স্লোয়ারে কাটা পড়েন মিসবাহ। সেই সাথে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্ভোধনী আসরেই পাকিস্তানকে ৫ রানে হারিয়ে শিরোপা জয় করে ভারত।
বিশ্বকাপ মানেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর। তাও আবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের প্রথম বিশ্বআসর। এসব কিছু ছাপিয়ে যখন ভারত-পাকিস্তানের ফাইনাল – ম্যাচে উত্তেজনাটা একটু বাড়তিই! ভারত-পাকিস্তানের ম্যাচ মানেই যেনো রক্তপাতহীন এক যুদ্ধ।
বিশ্ব মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের হারটা সেই যে ৯২ তে শুরু হয়েছিলো এরপর আর বিশ্বকাপে জয়ের মুখ দেখেনি তাঁরা। কোথাও যেনো অদৃশ্য এক কালো দাগ এঁটে আছে পাকিস্তানের ভাগ্যে। দ্বিপাক্ষিক সিরিজে দাপট দেখালেও বিশ্ব মঞ্চে ভারতের সামনে পরাজয় বরণ করাটা যেনো রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে পাকিস্তানের।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্ভোধনী আসরে শুরু থেকেই বেশ দুর্দান্ত খেলছিলো ভারত ও পাকিস্তান। গ্রুপ পর্বের দেখায় অবশ্য টান টান উত্তেজনার ম্যাচ টাই হয়! এরপর বল-আউটে জয়ী হয় ভারত।
সেবার ফাইনালে জোহানেসবার্গে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় কাপ্তান মহেন্দ্র সিং ধোনি। ধোনির আন্ডারে ভারত প্রথমবারের মতো বিশ্ব আসরে খেলছিলো।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মোহাম্মদ আসিফ ও সোহেল তানভীরদের টাইট বোলিংয়ে পাওয়ারপ্লেতে ২ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৪০ রান তুলে ভারত। ম্যাচের শুরুতেই পাকিস্তানের দাপুটে বোলিংয়ের সামনে ব্যাকফুটে ছিলো ধোনির দল।
ইউসুফ পাঠান, রবিন উথাপ্পার বিদায়ের পর জুটি বাঁধেন গৌতম গম্ভীর ও ওই বিশ্বকাপেই ছয় বলে ছয় ছক্কার রেকর্ড গড়া যুবরাজ সিং। তৃতীয় উইকেটে দু’জনে মিলে গড়লেন ৪৭ বলে ৬৩ রানের জুটি! অবশ্য এর সিংহভাগ রানই এসেছে গম্ভীরের ব্যাট থেকে। একপ্রান্তে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে গম্ভীর তুলে নেন ব্যক্তিগত ফিফটি!
আরেকপ্রান্তে যুবরাজ খেলছিলেন কচ্ছপ গতিতেই। বলা চলে, গম্ভীরকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন তিনি! এরপর দলীয় ১০৩ রানে ১৯ বলে ১৪ রানে ফেরেন যুবরাজ! দুই ওভারের মাঝে অধিনায়ক ধোনি ফিরলে বিপাকে পড়ে ভারত। উমর গুলের দাপুটে বোলিংয়ে পর পর দুই ওভারে দুই উইকেট হারায় ভারত। ১৬ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ তখন ৪ উইকেটে ১১৪ রান।
পরের দুই ওভারে আসে ১৬ রান! ১৭ তম ওভারে উমর গুলের বলে ছক্কা হাঁকানোর পরেই ব্যক্তিগত ৭৫ রানে বিদায় নেন গম্ভীর। ১৮ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ভারতের সংগ্রহ তখন ১৩০! গম্ভীরের ইনিংসেই বেশ ভালো অবস্থানে পৌঁছায় ভারত। তবে, শেষ ঝলকটা দেখান তরুন রোহিত শর্মা।
শেষ দুই ওভারে রোহিত শর্মার ক্যামিওতে আসে ২৭ রান! রোহিতের অপরাজিত ১৬ বলে ৩০ রানেই নির্ধারিত ২০ ওভারে ৫ উইকেটে ১৫৭ রান সংগ্রহ করে ভারত! পাকিস্তানের পক্ষে উমর গুল ৪ ওভারে ২৮ রানে নেন ৩ উইকেট।
১৫৮ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারেই আউট মোহাম্মদ হাফিজ! আরপি সিং’য়ের বোলিং তোপে কামরান আকমলও ফেরেন শূন্য হাতে। একপ্রান্তে ইমরান নাজিরের ১৪ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস ভীত গড়ার চেষ্টা করলেও রবিন উথাপ্পার থ্রো’য়ে রান আউটের শিকার হয়ে বিদায় নেন তিনিও!
শোয়েব মালিক, ইউনিস খানরাও দিতে পারেননি নিজেদের সেরাটা। শহিদ আফ্রিদিও ফেরেন শূন্য রানেই! ইরফান পাঠানের ম্যাজিকেল স্পেলে ৭৭ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে ম্যাচে ব্যাকফুটে তখন পাকিস্তান!
১২ ওভার শেষে পাকিস্তানের সংগ্রহ তখন ৬ উইকেটে ৭৮ রান! ম্যাচ জিততে তখনো প্রয়োজন ৮ ওভারে ৮০ রান। পাকিস্তানের শেষ ভরসা হিসেবে উইকেটে তখন মিসবাহ উল হক ও ইয়াসির আরাফাত। ম্যাচে ভারত তখন ফেবারিট! ম্যাচে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলো মহেন্দ্র সিং ধোনির দল।
খাদের কিনারে থাকা দলকে সপ্তম উইকেট জুটিতে টেনে তুলার চেষ্টা করেন ইয়াসির ও মিসবাহ। ২৬ বলে ২৭ রানের জুটির সমাপ্তি ঘটে ইরফান পাঠানের বলে ব্যক্তিগত ১৫ রানে ইয়াসির ফিরলে। দলের রান তখন ৭ উইকেটে ১০৪! শেষ ২৪ বলে দরকার ৫৪ রান!
ম্যাচে তখন হার চোখ রাঙাচ্ছিলো পাকিস্তানের সামনে। একপ্রান্তে উইকেটে সেট থাকা মিসবাহর সঙ্গি হন সোহেল তানভীর। এরপরই জোহানেসবার্গে বয়ে গেলো ছোট্ট এক ঝড়! এই ঝড়েই পালটে যায় ম্যাচের চিত্র।
পরের দুই ওভারে ৩৪ রান নিয়ে ম্যাচে আবারো আশা জাগায় মিসবাহ-তানভীররা! মাত্র ৪ বল খেলেই ২ ছক্কায় ১২ রান করেন তানভীর। অপরদিকে, দুই ওভার আগে ২৪ বলে ১৭ রানে অপরাজিত থাকা মিসবাহ পরের ৮ বলে করেন ১৯ রান!
ওই দুই ওভারে ৫ ছক্কা হাঁকান মিসবাহ ও তানভীর। ব্যাকফুটে থাকা পাকিস্তান হুট করেই ম্যাচে আবারো কামব্যাক করে মাত্র দুই ওভারের ব্যবধানে। ১৮তম ওভারের শেষ বলে তানভীর ফিরলে অষ্টম উইকেট হারায় পাকিস্তান।
শেষ ২ ওভারে প্রয়োজন তখনো ২০ রান, হাতে মাত্র ২ উইকেট! উইকেটে তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে মিসবাহ; যিনি তখন পাকিস্তানের একমাত্র ভরসা। ১৯ তম ওভারে বোলিংয়ে এলেন সেই ম্যাচে ভারতের অন্যতম সফল বোলার আরপি সিং। প্রথম চার বলে দিলেন মোটে তিন রান!
স্ট্রাইকে তখন উমর গুল। শেষ ৮ বলে প্রয়োজন ১৭ রানের! ওভারের পঞ্চম বলে লেগ স্টাম্প উপড়ে দিয়ে উমর গুলকে ফিরিয়ে পাকিস্তানকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন আরপি সিং।
শেষ ৭ বলে প্রয়োজন ১৭ রান। স্ট্রাইকে নতুন ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আসিফ। আরপি সিং’য়ের শেষ বলে অফ স্টাম্পের বাইরের ফুলটস আসিফের ব্যাটের কানায় লেগে পেছনে চার! শেষ বলে চার রানে পাকিস্তানের জন্য সমীকরণটাও কিছুটা সহজ হলো।
শেষ ওভারে পাকিস্তানের দরকার ১৩ রান, স্ট্রাইকে মিসবাহ। ভারতের হয়ে বোলিংয়ে আসলেন যোগিন্দর শর্মা। ওই নাটকীয় ওভারে ৫ রানের জয় পায় ভারত। পাকিস্তানের স্বপ্ন দুমড়েমুচড়ে শিরোপা নিজেদের করে নেয় ভারত!
আগের বলের ছয়ে ম্যাচের ভিলেন হতে যাওয়া জোগিন্দর শর্মাই পরের বলে মিসবাহ’কে ফিরিয়ে বনে গেলেন ম্যাচের নায়ক। ভারতের পাতা ট্র্যাপে পা দিয়ে মিসবাহর উইকেটে সেদিন আরো একবার বিশ্বকাপের মঞ্চে পরাজয় বরণ করে পাকিস্তান। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী আসরেই জয়ের কাছে যেয়েও শিরোপা খোয়ায় পাকিস্তান। অপরদিকে, মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে প্রথম আসরেই জয় পায় ভারত।