দুই অংক, তুমি কত দূরে!

২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারত টেস্টে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোর ছুঁয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে সাত উইকেটে ইনিংস ঘোষণা করার আগে করেছিল ৭৫৯ রান। এবার চার বছর বাদে, ঠিক সেই একই দিনে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর গড়লো ভারত। দিনটা কী টেস্টে ভারতের সবচেয়ে লজ্জার দিনও নয়!

ইনিংসে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি কোন ব্যাটসম্যান!

৪, ৯, ২, ০, ৪, ০ ,৮, ৪, ০, ৪, ১- নাহ, এটি কোন ফুটবল ম্যাচের স্কোরলাইন না, না কোনো ফোন নম্বর। অ্যাডিলেড ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের স্কোর বোর্ডের অবস্থা এটি।

১৮৭৭ সালে প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেট খেলতে মাঠে নামে বিশ্ব পরাশক্তি দুই দল অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড। সে হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসটা সুদীর্ঘ ১৪৩ বছরের। কালের বিবর্তনে লাল বলের টেস্ট ক্রিকেট ফ্লাডলাইটের আলোর নিচে নবরূপ পেয়েছে গোলাপী বলে। এই সুদীর্ঘ সময়ে ক্রিকেট মাঠে আনন্দ-বেদনার কাব্য, গৌরব কিংবা বীরত্বগাথা লেখা হয়েছে অনেকবার।

কিন্তু, ইনিংসে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেননি কোন ব্যাটসম্যান- ১৪৩ বছরের ইতিহাসে একটা ঘটনা ঘটলো এই মাত্র দ্বিতীয়বার। প্রথম নজীরটা যদিও ৯৬ বছর পুরনো।

বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির প্রথম ম্যাচে ভারত স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামে ফ্লাডলাইটের নিচে দিবারাত্রির গোলাপি বলে। ভারতের অভিজ্ঞতা বলতে গেল বছরে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে বাংলাদেশের বিপক্ষে গোলাপি বলে একমাত্র টেস্ট ম্যাচটি খেলার স্মৃতি। সেই অর্থে এই ফরম্যাটে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতার পাল্লাটা বেশ ভারিই বলা যায়।

ভারতের ব্যাটিং লাইনআপকে বিশ্বসেরা বলাই চলে। দলের নেতৃত্বে এ যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ‘কিং’ কোহলি, ব্যাটিং অর্ডারে পৃথ্বী শ, মায়াঙ্ক আগারওয়াল, চেতেশ্বর পুজারাদের মতো মাস্টারক্লাস কিংবা প্রতিভাবান বলে পরিচিত ব্যাটসম্যানদের উপস্থিতি নি:সন্দেহে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে আশার সঞ্চরণ ঘটিয়েছিল বেশ। কিন্তু নিপুণ আশায় সওয়ারি ভারত কিনা গোলাপি বলের তৃতীয় দিনের খেলায় দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে গেলো মাত্র ৩৬ রানে!

ভারতের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তিন টেস্ট স্কোর

  • ৩৬, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, অ্যাডিলেড, ২০২০
  • ৪২, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, লর্ডস, ১৯৭৪
  • ৫৮, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ম্যানচেস্টার, ১৯৫২

ফ্লডলাইটের নিচে দুই অজি পেস তারকা জশ হ্যাজেলউড আর প্যাট কামিন্সের গোলার সামনে কার্যত দাঁড়াতেই পারেনি ভারতীয় দল। ইনিংসে একটা জায়গাতেই মূলত ত্বরান্বিত হয়েছে ভারতের বিশ্বসেরা ব্যাটিং অর্ডারের পতন। অজি বোলারদের অফ স্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে ছোড়া মাপা লেন্থের লাফিয়ে ওঠা বলগুলো খেলতেই সবচেয়ে বেশি হিমশিম খেতে হয়েছে ভারতকে। কামিন্স-হ্যাজেলউড জুটির বলে উইকেটের পিছনে অজি অধিনায়ক টিম পেইনের হাতে ক্যাচ দিয়েই ফিরেছে ভারতের পাঁচ ব্যাটসম্যান।

ভারতের টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম এই দিনে দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেননি ভারতের কোন ব্যাটসম্যান। এক অঙ্কের বৃহত্তম সংখ্যা সর্বোচ্চ ৯ রান আসে ভারতের মায়াঙ্ক আগারওয়ালের ব্যাট থেকে। হনুমা বিহারি করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮ রান। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৪ রান করে করেন অধিনায়ক কোহলি, পৃথ্বী ও ঋদ্ধিমান সাহা। ইনিংসে রানের খাতাই খুলতে পারেননি ভারতীয় তিন ব্যাটসম্যান।

একটি জায়গায় ভারত হয়তো সান্ত্বনা খুঁজতে পারে। ইনিংসে কোন ব্যাটসম্যানের দুই অঙ্কের ঘরে না পৌঁছানোর ঘটনা টেস্ট ক্রিকেটে এটাই প্রথম নয়। ১৯২৪ সালে এজবাস্টনের বার্মিংহ্যামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো এমন নির্মম ঘটনারই সাক্ষী হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। প্রোটিয়াদের ৩০ রানে অলআউট হওয়া ইনিংসে ব্যাটসম্যানদের মতো সর্বোচ্চ ৭ রান করেছিলেন হার্বি টেলর। যদিও, তাঁদের ‘অদৃশ্য’ ব্যাটসম্যান ‍দুই অংক ছুঁয়েছিলেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, অতিরিক্ত খাত থেকে আসে ১১ রান।

১৯৭৪ সালের লর্ডসে ইংলিশদের বিপক্ষে ৪২ এর পর অ্যাডিলেডে অজিদের বিপক্ষে ভারতের ইতিহাসের সর্বনিম্ন ৩৬ রানের এ ইনিংস টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে কোন দলের পঞ্চম সর্বনিম্ন রানের ইনিংস, যা একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ক্রিকেটে কোন দলের করা সর্বনিম্ন রান। এর আগে ২০১৯ সালে লর্ডসে ইংলিশদের বিপক্ষে আইরিশরা গুটিয়ে গিয়েছিল ৩৮ রানে। গোলাপি বলের ক্রিকেটেও কোন দলের সর্বনিম্ন রানের ইনিংসটা এখন ভারতের দখলে।

প্রথম ইনিংসে ৫৩ রানে পিছিয়ে থেকেও দাপুটে বোলিংয়ে অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট জিতে নিয়েছে ৮ উইকেটে। দিবা রাত্রির টেস্টে এমন ঘটনা ঘটেছিল এর আগে মাত্র একবারই। ২০১৮ সালে ব্রিজটাউন টেস্টে উইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫০ রানে পিছিয়ে থাকার পরেও ঐ টেস্টটা জিতেছিল শ্রীলঙ্কা।

এর আগে বিরাট কোহলি টসে জিতেছেন এমন টেস্টে ভারত কখনোই হারেনি। এই টেস্ট হারের মাধ্যমে বিরাট কোহলি তার টসে জেতা ২৬ টেস্টে প্রথমবারের মতো ম্যাচে হারলেন। আরো এক‌টি রেকর্ডেরও সাক্ষী হলো এই অ্যাডিলেড টেস্ট। এশিয়ার বাইরে ৩৫ তম বারের মতো দুই বা ততোধিক টেস্ট ম্যাচের সিরিজ হার দিয়ে শুরু করলো ভারত। এর বাইরে পূর্বের ৩৪ সিরিজের ৩১ টিতেই হারের বিপরীতে মাত্র তিনটিতে ভারত সিরিজ শেষ করতে পেরেছিলেন সমতা দিয়ে।

একটা কাকতালীয় রেকর্ডের প্রসঙ্গ টেনে লেখার ইতি টানি। ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর ভারত টেস্টে নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোর ছুঁয়েছিল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চেন্নাইয়ে সাত উইকেটে ইনিংস ঘোষণা করার আগে করেছিল ৭৫৯ রান। এবার চার বছর বাদে, ঠিক সেই একই দিনে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর গড়লো ভারত। দিনটা কী টেস্টে ভারতের সবচেয়ে লজ্জার দিনও নয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...