বাংলাদেশের তিন প্রজন্মের সাথে ক্রিকেট খেলেছেন এমন ক্রিকেটারদের ভিতর প্রথম সারিতেই থাকবে ইমরুল কায়েসের নাম।
আফসোসটা হলো, তিন প্রজন্মের সাথে ক্রিকেট খেললেও কখনোই দলে স্থায়ী হতে পারেননি এই ব্যাটসম্যান। দলে স্থায়ী হতে না পারা নিয়ে ইমরুলের আক্ষেপ ও হাতাশা যেমন আছে; তেমনি আছে অভিযোগও।
ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বাক বদলের গল্প নিয়ে ইমরুল কায়েস কথা বলেছেন খেলা ৭১ এর সাথে। নিজের ক্যারিয়ারের এমন অবস্থার জন্য নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করার পাশাপাশি ভাগ্যকে যেমন দোষ দিয়েছেন ইমরুল কায়েস; তেমনি আঙ্গুল তুলেছেন টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের দিকেও।
ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ড সফরে রয়েছে বাংলদেশ। তবে নিউজিল্যান্ড সিরিজের স্কোয়াডে জায়গা হয়নি ইমরুল কায়েসের। দলে জায়গা ফিরে পেতে নিয়মিত অনুশীলন ও ফিটনেস নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হতাশ না হয়ে সামনের ঘরোয়া লিগে পারফর্ম করে জাতীয় দলে জায়গা ফিরে পাওয়া।
তিনি বলেন, ‘ফিটনেস নিয়ে অনেক কাজ করতেছি। জিমে যাই, স্টেডিয়ামে যাই। যখনই বাদ পড়ি তখনই ফেরার লক্ষ্য থাকে। জাতীয় দলে সব সময় এনজয় করি। চেষ্টা করে যাচ্ছি, অনুশীলন করে যাচ্ছি। সামনে যদি লিগের খেলা আসে চেষ্টা করবো ভালো খেলে আবার জাতীয় দলে ব্যাক করার। হতাশ হচ্ছি না। হতাশ হয়ে তো কোন লাভ নাই। যেটা ভালো মনে করেছে নির্বাচক প্যানেল বা ওনারা সেটাই করেছে।’
নিউজিল্যান্ড সিরিজের দলে বাদ পড়া নিয়ে হতাশ না হলেও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা রয়েছে ইমরুল কায়েসের। প্রায় দেড় যুগের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইমরুল কায়েস খেলেছেন মাত্র ৭৮ ওয়ানডে, ৩৯ টেস্ট ও ১৪ টি টি-টোয়েন্টি। এতো কম ম্যাচ খেলার জন্য ভাগ্যকে দোষ দিয়ে ইমরুল কায়েস জানিয়েছেন তিনি একটু খারাপ করলেই বাদ পড়েছেন। তিনি মনে করেন ভাগ্য পাশে থাকলে ক্যারিয়ারটা আরো ভালো হতো তাঁর।
ইমরুল বলেন, ‘এটাতো অবশ্যই হতাশার, কারণ প্রতিটা ক্রিকেটারই চায় জাতীয় দলে স্থায়ী হতে এবং ভালো খেলতে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হয়েছে। কারণ এতো স্ট্রাগল করলে স্থায়ী হওয়া কঠিন। আপনি ভালো খেলবেন বা খারাপ খেলবেন এটাই ক্রিকেটের নিয়ম। জাতীয় দলে সবাই সব সময় ভালো খেলে না। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে যখনই খারাপ খেলেছি তখনই বাদ পড়েছি। তখন ঘরোয়া লিগে রান করে আবার ফিরতে হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এভাবেই তো চলছে আমার; যেটা অন্যদের ক্ষেত্রে হয় নাই। আমার মনে হয় ওরকম হলে ক্যারিয়ারটা আরো ভালো দেখাতো। অবশ্যই আফসোস হয়। আফসোস হবে না কেনো। ক্রিকেটের জন্যই তো সব কিছু। পড়ালেখা করেছি এরপর তো আর কোন দিকে যাই নাই; ক্রিকেটেই আছি। আমার কাছে মনে হয় যে ক্যারিয়ারটা আরো বেটার হতে পারতো যদি ভাগ্যটা পাশে থাকতো; আরো যদি খেলতে পারতাম।’
গত এক যুগে তামিম ইকবাল নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে গিয়েছেন অন্য উচ্চতায়। ওপেনিংয়ে তামিমের একজন যোগ্য সঙ্গী খোঁজা হয়েছে সব সময়ই। কিন্তু কেউ থিতু হতে পারেননি; থিতু হওয়ার সুযোগ ছিলো ইমরুল কায়েসের সামনেও। তামিমের সঙ্গী হতে না পারার জন্য শুধু ভাগ্যকেই দোষ দিবেন নাকি ব্যর্থতা ছিলো নিজেরও? এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরুল কায়েস নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে জানিয়েছেন খারাপ সময়ে অন্য সবাই সমর্থন পেলেও তাঁর পাশে থাকেনি কেউই।
তিনি বলেন, ‘নিজের দোষটা অবশ্যই থাকবে। যখন খারাপ খেলবেন তখন নিজের সমস্য ওটা। কিন্তু আপনি যখন ভালো খেলবেন তখন সবাই আপনাকে সাপোর্ট দেবে এটা ক্রিকেটের একটা নিয়ম। একটা ক্রিকেটার কিন্তু সব সময় ভালো করে না। বাংলাদেশের যারা বড় ক্রিকেটার বা প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটার আছে তাদের কিন্ত খারাপ সময় গেছে। কিন্তু তাঁরা বাদ পড়েনি; যেটা আমার ক্ষেত্রে হয় নাই। আমি যদি ঐ সাপোর্টটা পেতাম তাহলে আমার ক্যারিয়ারটা আরো বেটার হতো।’
পর্যাপ্ত সুযোগ না পাওয়া এবং একটু খারাপ খেললেই বাদ পড়ার জন্য ইমরুল কায়েস কাঠগড়ায় তুলেছেন টিম ম্যানেজমেন্ট সহ টিম নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সবাইকে। কারণ নতুন কোচ আসার পর সে জানতো না কোন ক্রিকেটার কোন পর্যায়ে খেলেছে ও দলকে কিভাবে সার্ভিস দিয়েছে। এই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান মনে করেন টিম ম্যানেজমেন্ট ও টিম নিয়ে যারা কাজ করে তাদের উচিত ছিলো নতুন কোচকে এই সব বিষয়ে অবগত করা এবং যারা দীর্ঘ দিন দলকে সার্ভিস দিয়েছেন তাদের পাশে থাকা।
এ প্রসঙ্গে ইসরুল বলেন, ‘সব থেকে বড় কারণ মনে হয় আমার কাছে দেখেন আমি অলরেডি তিনটা প্রজন্মের সাথে ক্রিকেট খেলেছি। সুমন ভাইদের থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যারা তরুণ। আমি তিনটা প্রজন্মকে দেখলাম। জিনিসটা হচ্ছে যারা টিমের সাথে থাকেন বা যারা টিম নিয়ে কাজ করেন তারা তো দেখে যে আমি বা কোন ছেলেটা বাংলাদেশ টিমে ৮-১০ বছর হলো খেলতেছে। কিন্তু নতুন কোচ এসে কিন্তু দেখবে না কোন ছেলেটা ১০ বছর ১২ বছর বাংলাদেশ টিমে খেলেছে, কিভাবে খেলেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যখন নতুন কোচ আসে তখন সে একটা প্লেয়ার পছন্দ করতেও পারে, নাও করতে পারে। অপছন্দ করার কারণে যদি কেউ বাদ পড়ে যায়, তখন দায়িত্ব কিন্তু যারা বাংলাদেশ টিমে আছেন বা অনেক দিন কাজ করেছেন তাদের। কারণ তাঁরা জানে একটা ছেলে কোন কোন জায়গাতে রান করেছে, বাংলাদেশকে কি ভাবে সার্ভিস দিয়েছে। তাদের দায়িত্ব ছেলেটাকে ব্যাক করানো। শুধু আমার ক্ষেত্রে না, অনেকের ক্ষেত্রে। এই জায়গা গুলোতে ঘাঠতি রয়েছে। বিদেশি কোচ আসবে; তাদের পছন্দ অপছন্দের প্লেয়ার থাকবে। এটা অনেকের ক্ষেত্রে হয়, অনেকের ক্ষেত্রে হয়না। আমার ক্ষেত্রে হয়েছে, অনেক কোচ এসেছে যারা আমাকে পছন্দ করে নাই বা তাদের প্রিয় হই নাই। আমার মনে হয় যারা ম্যানেজমেন্টে ছিলেন তাদের উচিত ছিলো যারা দীর্ঘ দিন সার্ভিস দিয়েছে তাদের পাশে থাকা।’
নিজের এমন অভিযোগের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন ইমরুল কায়েস। এই ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ারের সোনালী সময় কাটিয়েছেন জেমি সিডন্সের অধীনে। আর নিজের থমকে যাওয়া ক্যারিয়ার পুনর্জাগরণ করেছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহের সময়ে। ইমরুল কায়েস জানিয়েছেন এই দুজন কোচই তাঁর খেলা পছন্দ করতো বলেই খেলতে পেরেছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমি লম্বা সময় ধরে পেয়েছি জেমি সিডন্সকে ও হাথুরুসিংহেকে। আমি অবশ্যই জেমি সিডন্সের সময় অনেক রান করেছি এবং অনেক ম্যাচও খেলেছি। সে আমাকে খুব পছন্দ করতো। ইনফ্যাক্ট যখন হাথুরু ছিলো তখন ও আমাকে দেখেছে, ও আমাকে পছন্দ না করলেও আমার খেলাকে পছন্দ করতো। মানুষ হিসাবে হয়তো তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিলো না। কিন্তু প্রফেশোনালি ওর সাথে আমার খারাপ সম্পর্ক ছিলো না। ও আমার খেলার জন্য সমর্থন দিতো এবং পছন্দ করতো। আপনি যখন দেখবেন একটা কোচ আপনার খেলা পছন্দ করছে তখন আপনি চাইবেন আরো ভালো কিছু করতে।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৩৫৩ রান করেছেন ইমরুল কায়েস; ২০ টি হাফসেঞ্চুরির সাথে ৭ টি সেঞ্চুরিও রয়েছে তাঁর। যখনই সুযোগ পেয়েছেন তখনই নিজকে প্রমাণ করেছেন এই ব্যাটসম্যান। এতো প্রতিবন্ধকতার ভিতর নিজকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত রেখেছেন কি ভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরুল কায়েস জানিয়েছেন জেদ ও চ্যালেঞ্জই তাকে জাতীয় দলে ফিরিয়ে এনেছে বারবার।
এই ব্যাটসম্যান বলেন, ‘আমি নিজকে একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে সব সময় প্রস্তুত রাখি। খেলবো নাকি বাদ পড়বো এটা নিয়ে ভাবি না। নিয়ম অনুযায়ী সব করি; যখন বাসায় থাকি বা খেলার ভিতরই থাকি। এটা আমার নিয়ম হয়ে গেছে যে কয়দিন অনুশীলন করবো আর কয়দিন করবো না। যার জন্যই প্রস্তুত থাকতে পারি মানসিক ভাবে ও শারীরিক ভাবে। আর ফেরার পর ভালো করতে জেদ ও চ্যালেঞ্জ দুটো জিনিস কাজ করে।’
সব বাঁধা বিপত্তি সামলে ইমরুল কায়েস আবারো ফিরতে চান লাল সবুজের জার্সিতে। জাতীয় দলে ফিরতে ইমরুল প্রস্তুত রয়েছেন যে কোন পজিশনে খেলতে। এই ব্যাটসম্যান জানিয়েছেন প্রতিবন্ধকতার কাছে হার মেনে ক্যারিয়ার শেষ করতে চাননা তিনি; বরং নিজে যখন বুঝবেন ক্রিকেট ছাড়ার সময় হয়েছে তখনই তুলে রাখবেন ব্যাট প্যাড।
তিনি বলেন, ‘এখন আর ওপেনিং নিয়ে ভাবছি না, আমি মিডল অর্ডারে খেলি। বিপিএল বলেন বা ডিপিএল বলেন সব জায়গাতেই তিনে বা চারে খেলি এখন। ওপেনিং করতে হবে এমন কিছু না। আমি যে কোন পজিশনে খেলতে পারি। আরো খেলবো, কয়েক বছর খেলার তো ইচ্ছা আছেই। যতো দিন নিজকে ফিট মনে হবে, ভালো লাগবে ততো দিন খেলে যাবো। যখন দেখবো মাঠে দৌড়াতে ইচ্ছে করে না, সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। অনুশীলন করতে ইচ্ছে করে না। তখন বুঝতে পারবো আমার অবস্থা কি।’