‘সময়টাই শুধু বদলে গেছে’

অন্য সবার মত, যখন বুঝতে পারি মানুষ হঠাৎ করেই আপনাকে পুরাতন ভাবছে তখন বিষয়টা একরকম ধাক্কার মতই লাগে। আজকে আপনার বয়স ২০ হলে, অন্যদিন ৫০। মনে আছে আমার চারপাশে ছিলেন ইয়ান টিম্মান, কাসপারভ, কারপভ এবং তাঁরা সবাই-ই বয়সী ছিলেন তখন।

এক সময়ের তরুণ প্রতিভা বিশ্বনাথন আনন্দ এখন ৫১ পার করে ফেলেছেন। এখনও এই বয়সেও সর্বোচ্চ স্তরের দাবায় লড়ে যাচ্ছেন। নিজের এই লড়াই ও ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলেছেন এই এক সময়ের বিশ্বসেরা দাবাড়ু।

এই ৫০ বছর বয়সেও আপনি শীর্ষ পর্যায়ের দাবায় প্রতিযোগীতা করছেন, সেসব জিতছেনও। ৯০ দশক এবং বিশ শতকে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী যারা ছিল তাঁদের অনেকেই হয় অবসরে গিয়েছেন নয়ত র‍্যাংকিং থেকে পিছিয়ে পড়েছেন। আপনার ক্ষেত্রে বিষয়টা কি?

অন্য সবার মত, যখন বুঝতে পারি মানুষ হঠাৎ করেই আপনাকে পুরাতন ভাবছে তখন বিষয়টা একরকম ধাক্কার মতই লাগে। আজকে আপনার বয়স ২০ হলে, অন্যদিন ৫০। মনে আছে আমার চারপাশে ছিলেন ইয়ান টিম্মান, কাসপারভ, কারপভ এবং তাঁরা সবাই-ই বয়সী ছিলেন তখন।

এমনকি আলিরেজা ফিরৌজার সাথে পরিচিত হয়ে যখন জানতে পারি ২০০০ সালে প্রথমবারের মত বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার ৩ বছর পর তাঁর জন্ম-তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম। আর এখন আমরা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছি।  আমি বুঝি এই জিনিসটা আমাকে কিছুটা কম শক্তিশালী করেছে এবং এজন্য একটা টুর্নামেন্টে ভালো করতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করে দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু এগুলো নিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। হয় আপনি এমনভাবে খেলবেন যেন তা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ অথবা খেলবেন না!

গত বছর আমি আনিশ গিরির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যে আপনার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল, ‘আনন্দ হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি যিনি কিনা, আমি নিশ্চিত, ফোনের সব এপ্লিকেশন নিয়মিত আপডেট করেন’। এবং ‘সে হৃদয়ের দিক থেকে তরুণ’। এটা কি সত্যি?

সেই সাক্ষাৎকার আমি পড়েছিলাম, হেসেছিলাম অনেক। আমি জানি না ফোনের সব এপ্লিকেশন আপডেট করার সাথে তারুন্যের কি সম্পর্ক, কিন্তু কথাটা সত্যিই মনে ধরেছে। আমি আসলেই সব এপ্লিকেশন এবং সফটওয়্যার নিয়মিত আপডেট করি। হয়তো একঘেয়েমি দূড় করার জন্য! সাক্ষাৎকারটি পড়ার পর আমি গিরিকে আমার ফোন দেখিয়ে বলেছিলাম- ‘দেখো সব এপ্লিকেশন আপডেট করা!’

কৈশোরে আপনার অগ্রগতির দিকে তাকালে দেখা যায় আপনি আন্তর্জাতিক মাস্টার হন ১৫ বছর বয়সে, জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন ১৬ বছর বয়সে। দাবাকে পেশা হিসেবে নেয়াই কি একমাত্র বিকল্প ছিল?

দাবাকে পেশা হিসেবে নেয়ার পেছনে কিছু আবেগ কাজ করছিল। এটা এমন একটা জিনিস যা আমি ভালোবাসি, এবং আমি ভাগ্যবান কারণ এটা বেছে নেয়া আমার জন্য খুবই সহজ ছিল। ভারতে ১০ম গ্রেডে গিয়ে একটা মোড়/পরিবর্তন দেখা যায় এবং ১২ তম গ্রেডে গেলে যারা ক্রীড়াতে প্রতিযোগিতায় নামে এবং দ্বিধা বোধ করে এই ভেবে যে- আমি কি আসলেই কোথাও পৌছাচ্ছি? আমার কি বিকল্প নিয়ে ভাবা উচিত? কিন্তু দশম গ্রেডে থাকার সময় আমি জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হই, ১২তম গ্রেডে গিয়ে হই গ্র্যান্ডমাস্টার। বিশ্ববিদ্যালয় যখন পেরোই- তখন আমি বিশ্ব র‍্যাংকিং-এ পাঁচ নাম্বার।

আপনার বাবা-মা’র মন্তব্য কি ছিল এই বিষয়ে? তাঁরা অথবা আপনি কি কখনো দাবাড়ু হিসেবে জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন?

বাবা-মা’র হয়ত সন্দেহ ছিল কারণ আমার বাবা রেইলওয়েতে চাকরি করতেন। তাঁদের কোনো ধারণা ছিল না দাবা সম্পর্কে। তবুও তাঁরা স্রোতের সাথে গা ভাসিয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন দাবা আমি ভালোবাসি, সুতরাং বিরূপ কোনোকিছু বলা থেকে তাঁরা বিরত ছিলেন।

চাকরির নিশ্চয়তার কথা যদি বলতেই হয়, আমি অনুভব করি যেকোনো পেশার চেয়ে দাবা কোনো অংশে কম কিংবা বেশি ঝুকিপূর্ণ নয়। ইদানীং আমি মানুষকে বলি, ঠিক কোন পেশায় এই নিশ্চয়তাটুকু আছে? এই সময়ে আমাদের পায়ে আমাদেরই দাঁড়াতে হয়।

১৯৮৮ সালের বিয়েল টুর্নামেন্টের একটা বিখ্যাত খেলা আছে, যেখানে আপনি আলোনসো সাপাতা’র কাছে হেরে গিয়েছিলেন মাত্র ছয় চালে। সেই খেলাটা সম্পর্কে কিছু বলুন।

সেই মুহুর্তে আমি আসলে পুরোপুরি আবেগপ্রবণ ছিলাম। আমার মনে আছে পাঁচ নম্বর চালে কালোর Bf5 চেলেছিলাম খুব দ্রুত। এবং সাথে সাথে বুঝতে পারি মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। কারণ ছয় নম্বর চালে সাদার Qe2-র পর যুতসই আর কোনো প্রতিউত্তর পাচ্ছিলাম না।

আমি নিরন্তর ঘামছিলাম। আমার প্রতিপক্ষ এতটাই অবাক হয়েছিল যে সে বারবার বোর্ডের দিকে তাকাচ্ছিল। সে সম্ভবত এক থেকে দুই মিনিট চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে বসে ছিল কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল অনেক দীর্ঘ একটা সময়। শেষতক, সে ছয় নম্বর চালে Qe2-ই খেলে এবং সাথে সাথে আমি রিজাইন দিয়ে বের হয়ে আসি দ্রুত মানুষেরা কোনোকিছু বুঝবার আগেই। কারণ আমি সত্যিই অনেক অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম।

আমার ব্যাখ্যা ছিল এরকমঃ এমন একটা ভ্যারিয়েশন দেখেছিলাম যেখানে সাদা c4 এবং Nc3 চালে এবং এরপর আমি কালোর Bf5 খেলেছি, আর গুলিয়ে ফেলেছি। সেই টুর্নামেন্ট থেকে কোনোভাবে গা বাঁচাতে পেরেছি, অত খারাপ হয়নি। কিন্তু এই খেলাটা পরবর্তী অনেক বছর বেশ খোঁচায় এবং ‘কেন’- সেটা দেখতে পারিনি। মনে হয়েছিল, একটা খারাপ দিনই তো! কিন্তু যখন একগাদা নতুন উঠতি তরুণ খেলোয়াড় সেই খেলাটা আবিষ্কার করে নতুন করে- আমাকে আবার পুরোটা মনে করতে হয়েছিল! এর থেকে বিরক্তির কিছু আছে?

আপনি দুটো বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, ১৯৯৫ আর ২০১৪ সালে- এদের মাঝে প্রায় ২০ বছরের ফারাক। দুইটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা কিরকম?

আমার জন্য এই বিষয়টা খুব আকর্ষণীয়, যে কাজটা করতে চারজনের একটা দলের এক/দুই সপ্তাহ লেগেছে- কম্পিউটার সেটা করেছে বরাবর দুই সেকেন্ডে! ১৯৯৫ সালের ম্যাচ প্রস্তুতিতে যেকয়টা চালের জন্য আমি গর্ব করি, সেই চালগুলিও এসেছে তৎক্ষণাৎ! এই সময়ের কনিষ্ঠ যারা আছে, তাঁদের কাছে আমি অনেক সময় ধরে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি যে- উক্ত চালগুলি সেই সময়ে খুঁজে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা বৃদ্ধ মানুষের মত, খুব দ্রুত হাল ছেড়ে দেয়!

বর্তমান সময়ে সবচে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তথ্যের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। যা ঘটছে সেসবের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা কারণ কম্পিউটারের সাহায্যে আপনি অনেকরকম বিষয়াদি তৈরি করতে পারেন। কিন্তু যদি বোর্ডে অর্থ না তৈরি হয়, তাহলে সেসব কোনো কাজেই আসবে না। যেকোনো জটিল অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।

প্রস্তুতি নেবার এই নতুন পন্থা আপনাকে বেশ সাহায্য করেছে, বিশেষত ২০০৮ সালে ক্রামনিকে সাথে চ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমরা আগে থেকে ভালো প্রস্তুতি নিতে পেরেছিলাম কারণ কিছু ভালো হার্ডওয়ারের প্রবেশাধিকার আমরা পেয়েছিলাম। ঝুঁকি নেয়ার মানসিকতায় যেমন ছিলাম, তেমনি নতুন কিছু করার এবং শেখার আগ্রহটাও সমানভাবে ছিল। হুট করে প্রযুক্তিটাও হাতে এসে যায়। এই জিনিসগুলো এত সুন্দরভাবে মিলে গিয়েছিল, আমি মনে করি, এটাই অন্যতম বড় একটা অংশ যার কারণে ম্যাচে ভালো ফলাফল আসে।

২০০৮ সালের জয়টা নিশ্চয়ই আপনার জন্য খুব আনন্দদায়ক ছিল, কারণ ২০০০ সালে আপনি ফিদে টাইটেল জয় করেন এবং ২০০৭ সালে মেক্সিকো সিটিতে হওয়া টুর্নামেন্টে অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন হন। ২০০৮ সালের ম্যাচটা অনেক রাজনীতির অবসান ঘটায় যা দাবাকে অনেক বছর ধরে শাসন করে আসছিল।

২০০০ সালে নয়া দিল্লিতে আমার পারফরম্যান্সের বিষয়ে আমি গর্বিত। যদিও ফিদে টাইটেল কিছুটা অম্লমধুর ছিল কারণ সবসময়েই কেউ না কেউ বলতো- যদি দুইজন চ্যাম্পিয়ন থাকে তবে আসলে কেউই চ্যাম্পিয়ন না। এটা একদিক থেকে সত্যি। ক্রীড়ায় এটা একদমই বোকাটে অবস্থা তৈরি করেছিল। কিন্তু এটা আমার বা ক্রামনিকের কিংবা সুনির্দিষ্ট কারোর দোষ না।

২০০৭ সালে টাইটেল জিততে পেরেছিলাম, এটা অনেক বড় একটা বিষয় ছিল আমার জন্য। প্রথমবারের মত, কোনো বোঝা আমাকে বইতে হবে না ভেবে খুশি হয়েছিলাম। আমাকে আর কারোর ‘কোন টাইটেল জিতেছি’ এই বিষয়ক তুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না!

২০১৬ সালে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে আপনি যুগ্মভাবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন, ৪৬ বছর বয়েসে। আপনি কি মনে করেন একদিন আরেকটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাচের লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন অথবা হয়ত আবার চ্যাম্পিয়ন হবেন?

অস্বীকার করছি না, তবে যাত্রাটা অনেক বড়। প্রথমে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টের জন্য যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে, এরপর ক্যান্ডিডেটস জিততে হবে, এবং অবশেষে চূড়ান্তভাবে প্রতিযোগিতা করতে হবে শিরোপার জন্য। যতখানি ধাপ, ততখানি কঠিন। কোথাও কোনোভাবে হয়ত একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটবে এই আশা করতে পারেন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটা পেতে হলেও আমাকে অন্তত দুটি বা তিনটি ধাপ পেরোতে হবে।

সুতরাং আমি এই বিষয়টা নিয়ে খুব একটা অস্থির হই না। যদি নিজেকে ক্যান্ডিডেটস টুর্নামেন্টে খুঁজে পাই- তাহলে সুযোগটা আমি নেবো। যদি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ম্যাচে হয়য়- তবে সেটা মোকাবেলা করবো। কিন্তু আমি নিজেও অন্য সবার মত আশ্চর্য বা অবাক হবো। আমি খেলেই যাবো এবং প্রতিযোগিতা করবো- অন্তত এইটুক বলতে পারি!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...