২০০৩ বিশ্বকাপের আগে ও পরে কিংবদন্তি জাভাগাল শ্রীনাথের অবসরের ভারতীয় ক্রিকেটে কিছু প্রতিশ্রুতিশীল পেসারের আর্বিভাব হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে টিনু যোহানান, আভিস্কার সালভি, লক্ষ্মীপতি বালাজি ও ইরফান পাঠান অন্যতম। যদিও তখন জহির খান ও আশিষ নেহরার মতো তরুণ পেসাররা নিজেদের ছাপ ছড়ানো শুরু করে দিয়েছেন।
যাই হোক, তাঁদের মধ্যে বালাজি এবং পাঠান নির্বাচকদের ও সংবাদ মাধ্যমের মন জয় করতে পেরেছিল, তার খবর আমরা পেতাম বিভিন্ন সংবাদপত্রের খেলার পাতায়। বালাজি এবং পাঠান – দু’জনেরই গতি এবং দুই দিকেই স্যুইং করবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ডাউন আন্ডারে রাহুল দ্রাবিড়ের সেই বিখ্যাত টেস্ট দ্রাবিড় ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার অসাধারণ ব্যাটিং লাইন আপকে দ্বিতীয় ইনিংসে একাই গুড়িয়ে দিয়ে ভারতকে অসাধারণ জয় এনে দিয়েছিলেন অজিত আগরকার।
কিন্তু, এই টেস্টেই আগরকারের নতুন বলের সঙ্গী হয়েছিল ইরফান পাঠান। সেদিন অভিষিক্ত বাঁ-হাতি তরুণ পেসার ভবিষ্যতে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের এই শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক, হোক না সেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত।
অভিষেকের বছর দুয়েকের মধ্যেই তাঁর ‘স্যুইং ও সিমে’ প্রভাবিত হয়ে অনেকেই তাঁকে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল তারকা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল। ব্যাটিংয়ের হাতটিও ভাল ছিল তাই ওই সময় মহান কিংবদন্তি কপিল দেবের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে ভাবাও শুরু হয়েছিল। কে জানে, এই ভাবনাই হয়তো কাল হয়েছিল।
২০০৬ সালের পাক সফরে করাচি টেস্টে প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিক (এখনও রেকর্ড হয়ে টিকে আছে) কিংবা আগের ফয়সালাবাদ টেস্টে মহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে ষষ্ঠ উইকেটে ২১০ রানের জুটি-সহ আরও কিছু উদাহরণ সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম ‘পোস্টার বয়’ হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু ‘ভবিষ্যতের কপিল’ বললেই হয় না, কপিল দেবের কয়েক শতাংশ হতে গেলেই নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়। প্রতিভা অবশ্যই ছিল, কিন্তু ক্রমাগত চোটের কবলে পড়া, চাপে নুইয়ে পড়া প্রভৃতি বিষয় গুলোতে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিলেন।
এইসব ছাড়িয়েও যখন তাকে ব্যাটিং অর্ডারে তুলে আনা হল খুব ভাল সাফল্য না পেলেও তা কার্যকরী হচ্ছিল। যদিও ওই অসাধারণ হ্যাট্রিকের পর বোলিংয়ের গ্রাফ ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছিল। ২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলে জায়গা না পেলেও, ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ম্যাচ প্রতি ভাল করেন এবং ফাইনালে সেই অসাধারণ স্পেল সবার মনে আবার সেই আশা ফিরিয়ে এনেছিল।
পেস কমে গেলেও তখনও স্যুইংয়ের ধার কিন্তু কমেনি। যখন সেই সময় আমরা ধরে নিয়েছি এবার তিনি দীর্ঘদিন ভারতীয় সীমিত ওভারের দলের সেবা করতে পারবেন, সে হোক না দলের তৃতীয় পেসার হিসেবে; কিন্তু একের পর এক চোট ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের এক গৌরবান্বিত সদস্য হিসেবে থাকার আশার সাথে নিজের ক্যারিয়ারই অস্তাচলে চলে যায়।
২০০৮-১২ বিশ্ব ক্রিকেট থেকে যেন মুছে গিয়েছিলেন। অন্য অসাধারণ পেস বোলারদের উত্থানে ২০১২ সালে যখন দেশের হয়ে ভবিষ্যত একবারে সমাপ্তি ঘটলো তখন তার বয়স মাত্র ২৮, সে বয়সেও অনেক ক্রিকেটার স্বপ্ন দেখেন দেশের হয়ে খেলবেন।
স্যুইং এবং সিমের এমন অসাধারণ কম্বিনেশন খুব কম বোলারদের মধ্যেই দেখা গিয়েছে। পাঠান আর বালাজির জুটি এক সময় মুগ্ধ করতো। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতের অন্যতম সেরা জহির খানের সফল সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু, অলরাউন্ডার বানাতে গিয়ে টিম ম্যানেজমেন্ট নিজের পায়ে কুড়াল মারে।
যখন সমসাময়িকরা দিব্যি খেলে যাচ্ছেন, তখন ইরফান পাঠান তখন ধারাভাষ্যে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। হয়তো সিনিয়র ও টিম ম্যানেজমেন্টের পরিচর্যা ও দিক নির্দেশনা পেলে তাঁর ক্যারিয়ারের গল্পটা ভিন্ন রকম হত।
আজও কখনো কখনো তাঁকে দেখা যায়। হয় লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল) খেলেন, কিংবা খেলেন লিজেন্ডস ক্রিকেট। সেখানে ব্যাট বলে ঝলক দেখান। তাতে হারানোর বেদনায় কোনো মলমের প্রলেপ পড়ে না, বরং আক্ষেপটা আরও বাড়ে।