নিজেদের বাজে সময়কে পেছনে ফেলে দুরন্ত-দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা ইতালির জয়ের ধারা অবশেষে থেমে গেল। ৩৭ ম্যাচ পর তাদের পরাজয়ের ‘তেতো স্বাদ’ দিলো স্পেন। উয়েফা নেশন্স লিগের সেমিফাইনালে ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়নদের কাছে হেরে গেছে ২০০৬ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। এই স্বাদটা প্রায় ভুলে যেতেই বসেছিল ইতালিয়ানরা।
ছয় অক্টোবর মধ্যরাতে ১০ জনের ইতালিকে ২-১ গোলে হারিয়ে উয়েফা নেশন্স লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে স্পেন। এরই সঙ্গে রবার্তো ম্যানচিনির দলের বিপক্ষে সর্বশেষ ইউরোর সেমিফাইনালে হারের প্রতিশোধও নেওয়া হলো। দলের জয়ে দুটি গোলই এসেছে ফেরান তোরেসের পা থেকে। সান সিরোতে যদিও ইতালি বল দখলের লড়াইয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল।
আক্রমণে উঠে লুইস এনরিকের দলের গোল পেতে সে কারণে তেমন একটা সময় লাগেনি। ম্যাচ ঘড়ির কাটা যখন ১৭ মিনিটে তখনি এগিয়ে যায় স্পেন। ওয়ারজাবালের ক্রসে তোরেস দারুণ ভলিতে লক্ষ্যভেদ করে দরকে এগিয়ে দেন। ইতালীর জন্য এরপরই যে দু:সংবাদ অপেক্ষা করছিল সেটা আর বোঝা যায়নি। অধিনায়ক বনুচ্চি লাল কার্ড দেখলে ১০ জনের দলে পরিণত হয় আজ্জুরিরা। ৪২ মিনিটে ডাবল হলুদ কার্ডে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাকে। এই ধাক্কাটা সামলে ওঠা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
যদিও রেফারির কাছে প্রতিবাদ জানালেও সিদ্ধান্ত বদল করা সম্ভব হয়নি। ১০ জনের ইতালি আরও ব্যাকফুটে চলে যায় দ্বিতীয় গোল হজম করার পর। বিরতির ঠিক আগ মুহূর্তে যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিটে তোরেস বল জালে দিলে ম্যাচে ফেরার আশাটা ক্ষিণ হয়ে যায় ইতালির। এই গোলেও আগেরটির মতো সহায়তা করেছেন ওয়ারজাবাল।
জাতীয় দলের হয়ে ২১ তম ম্যাচে এটি তোরেসের ১২তম গোল। দ্বিতীয় গোলের পর ৬৩ মিনিটে ওয়ারজাবাল গোল করার সুযোগ নষ্ট করলে স্পেনের বড় ব্যবধানে জেতা হয়নি। দুই গোলে পিছিয়ে থেকে ইতালী ছক বদলে রক্ষন জমাট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
বিশেষ করে ম্যাচটা না হেরে ড্র করার দিকেই বেশি মনযোগী ছিলেন ম্যানচিনির শীষ্যরা। যদিও শেষের দিকে এসে এক গোল শোধও দেয় তারা। ৮৫ মিনিটে পেলেগ্রিনি লক্ষ্যভেদ করলে শুধু ব্যবধানই কমে। চিয়েসার এসিস্টে এই গোলটির কল্যানে শেষ পর্যন্ত ২-১ স্কোর লাইন রেখে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে স্পেন। ভেঙ্গে যায় ইতালীর প্রতিরোধের শক্ত দেয়াল।
বিশ্বরেকর্ড গড়েই বিদায় নিয়ে হয় সর্বাধিক ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডকে। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি, অথচ ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের সর্বশেষ আসরে কোয়ালিফাই করতে পারেনি দলটি। ইউরোপের বিশ্বকাপ বাছাইয়ে পিছিয়ে পড়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট খুইয়ে চরমভাবে হতাশ করে তারা। এরপর নতুন কোচ হিসেবে ইতালির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় রবের্তো মানচিনির হাতে।
তারপর গল্পটা এতটাই বদলে যায় যে, মানচিনির হাত ধরে ইতালিয়ান সাম্রাজ্যের নবজাগরণের শুভ সূচনা হয়। একের পর এক জয়ে বিশ্বকে নিজেদের জাত চেনাতে থাকেন দেয় তারা। এবার সেই দলটিই ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য গৌরব অর্জন করেছে। ২০১৮ সালের ১৫ মে ইতালীর সে সময়কার কোচ লুইজি দি বিয়াজোকে ব্যর্থতার দায়ে বরখাস্ত করার পর দলের দায়িত্ব নেন সাবেক ম্যানচেস্টার সিটির কোচ মানচিনি।
৫৬ বছর বয়সী এই হেড মাষ্টারের অধীনে অবিশ্বাস্য রকমের অ্যাটাকিং ফুটবল খেলছে আজ্জুরিরা। চিরচেনা সেই জমাট রক্ষণ ধরে রাখার পাশাপাশি ছোট ছোট পাসে করে আক্রমণের মালা গেঁথে প্রতিপক্ষের রক্ষণেও কাঁপন ধরাথে থাকে।
ধীরে ধীরে উন্নতিটা হওয়ার পর এখন তো রীতিমতো মহীরুহ হয়ে পড়েছে পাওলো রসির দেশ। প্রতিটা ম্যাচেই বানের জলের মতো আক্রমণ শানাচ্ছে দল। অনেকটাই পুরোনো রুপে ফিরে গেছে আজ্জুরিরা। ধ্বংসস্তুপ পড়া ইতালীকে নিয়ে রবার্তো ম্যানচিনির ঘুরে দাড়ানোর গল্পটা ফুটবলবিশ্বের জন্য অনেক বেশি অনুকবরণীয় হয়ে আছে। যার ধারাবহিকতায় আন্তর্জাতিক ফুটবলে যেন হারতেই ভুলে গিয়েছিল তারা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অপরাজিত ছিল ইউরোপরে দলটি। অবশেষে প্রায় আড়াই বছর পর হারের মুখ দেখলো ইতালি, তার সাথে থেমে গেল ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের অজেয় যাত্রাও। এই নিয়ে রেকর্ড ৩৭ ম্যাচ পর হারের মুখ দেখলো ইতালিয়ানরা। এই সময়ে দেশটি আন্তর্জাতিক ফুটবলে টানা সর্বোচ্চ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ার সাথে সবচেয়ে বেশি সময় নিজেদের জাল অক্ষত রাখার রেকর্ডও গড়েছিল।
সব মিলিয়ে ১১৬৮ মিনিট নিজেদের জালে কোন গোল ঢুকয়ে দেয়নি রক্ষণের জন্য সুখ্যাতি পাওয়া সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দেশটি। ৩৭ ম্যাচের অজেয় এই মিছিলে রবার্তো ম্যানচিনির দল ২৮ ম্যাচ জয় ছাড়া বাকি ৯ ম্যাচ ড্র করে মাঠ ছেড়েছে। ২০১৮ সালে এই উয়েফা নেশন্স কাপে পর্তুগালের কাছে হারের পর ইতালিকে কোন দল হারের স্বাদ দিতে পারেনি।
বাছাইসহ উয়েফা ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছে টানা ১৭ ম্যাচ। ৫৩ বছর পর জিতেছে ইউরোপ সেরার খেতাব। তারপরও কোন ম্যাচ হারেনি ইতালি। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র করে ব্রাজিল ও স্পেনকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়ে এই সময়।
তিন মাস আগে এই ইতালির কাছে পরাজিত হয়েই ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসরের শেষ চার থেকে ছিটকে গিয়েছিল লা রোজারা। একই আসর না হলেও সেই সেমিফাইনালেই এবার যেন সেই হারেরই মধুর প্রতিশোধ নিলো লুইস এনরিকের শিষ্যরা।
১৯৯৮ সালের পর এবারই প্রথম ইতালির মাঠে দুই গোল করে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল স্পেন। ১৯৯৯ সালের পর প্রথমবার ঘরের মাঠে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে পরাজয়েল বেদনাঁয় নীল হলো আজ্জুরিরা। ইউরোরের সেমিফাইনালের সঙ্গে এই লড়াইয়ের মিল একটা জায়গায় ছিল অবশ্য।
সেই ম্যাচে বলের দখলে ছিল স্পেনের রাজত্ব, বলের দখলে ছিল ম্যাচের ঠিক ৭১.২ শতাংশ সময়। স্পেন দলও এদিনও বলের দখল রাখল সত্তরেরও বেশি শতাংশ সময় ধরে। বরং এদিন তা বাড়ল আরও কিছুটা, স্পেনের পায়ে বল ছিল ৭৪.২ শতাংশ সময়! কোচ মানচিনির অধীনে ইতালির বিপক্ষে এর চেয়ে বেশি বলের দখল নেই অন্য কোন দলে!