জেসন হোল্ডার আজকে যেভাবে বোলিং ক্রিজের ব্যবহার করলেন। অ্যাঙ্গেল সৃষ্টি করে ছোট ছোট সুইংকে যেভাবে কাজে লাগালেন, মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। বলা যায়, ধ্রুপদী মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের বিশুদ্ধ প্রদর্শনী।
জেসন হোল্ডারকে যখন প্রথম দেখি, তখন তিনি শুধু দৌড়াতেন। হ্যাংলা-পাতলা একজন মানুষ, শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের বিগ স্ক্রিনের সমান উঁচু (৬ ফুট ৭ ইঞ্চি), যার কাজ ছিল শুধু দৌড়ানো।
২০১২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশকে বেশ ভুগিয়ে ইনজুরিতে পড়লেন টিনো বেস্ট। ওয়ানডে সিরিজের আগে বদলী হিসেবে পাঠানো হলো হোল্ডারকে। এর দুবছর আগে অ-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন হোল্ডার, কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। সেই ইংল্যান্ড দলে ছিলেন রুট-স্টোকস-বাটলার-ভিন্সরা। দারুণ সম্ভাবনাময় ছিলেন বলেই বেস্টের বদলী হিসেবে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল হোল্ডারকে, মূলত সিনিয়র দলের সঙ্গে থেকে শেখার জন্য।
স্বাভাবিকভাবেই খেলার সুযোগ সেবার তিনি পাননি। শুধু দেখতাম, শের-ই-বাংলায় চক্কর দিতেন, ম্যাচের আগে-পরে, প্র্যাকটিসে এসেও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডিয়া ম্যানেজারকে মজা করে বলেছিলাম, ‘তোমাদের এই ছেলেটার কি দৌড়ানো ছাড়া আর কাজ নেই? নেটেও তো বোলিং করতে বেশি দেখি না।’ মিডিয়া ম্যানেজার হেসে বলেছিল, ‘যখন কাজ শুরু করবে, তখন দেখতেই থাকবে।’
পরের বছর হোল্ডারের অভিষেক হলো। ওয়ানডেতে। ‘দেখতেই থাকার’ মতো স্পেশাল কিছু মনে হলো না। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই অবশ্য একটা ওয়ানডেতে দারুণ বোলিং করেছিলেন। তবে সেদিন ৫৫ বলে ৭৬ রান করার পর ১২ রানে ৭ উইকেট নিয়ে সব আলো কেড়ে নিলেন শহিদ আফ্রিদি। পরের বছর হোল্ডারের টেস্ট অভিষেকও হলো। যথারীতি মনে হলো গড়পড়তা একজন।
সেই হোল্ডার মাত্র ৮ টেস্টের অভিজ্ঞতায় অধিনায়কত্ব পেয়ে গেলেন ২৩ বছর বয়সে। মূলত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের নানা বাস্তবতার কারণে। শুরুতে মনে হচ্ছিল, ডোবার মাছকে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিজেই দলে থিতু নন, তার ওপর ভঙ্গুর একটি দলকে নেতৃত্ব দেওয়া, বিভিন্ন দ্বীপের বৈচিত্রময় সময় চরিত্র ও ধরনের ক্রিকেটারদের সামলানো, দলকে ঐক্যবদ্ধ করার ভীষণ কঠিন কাজ, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, ছোট কাঁধে বড় ভার। কিন্তু বোর্ড তাকে ধরে রেখেছে, হয়তো আস্থা রাখায় কিংবা বিকল্প না থাকায়, তিনিও সময়ের সঙ্গে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, পারফরমার হিসেবে যেমন, নেতা হিসেবেও।
পারফরমার হিসেবে দলের শ্রদ্ধা আদায় করে নেওয়া জরুরি ছিল। সময় লেগেছে, তবে হোল্ডার পেরেছেন। প্রথম ২১ টেস্টে তার ছিল মোটে ৩২ উইকেট। অধিনায়ক তো বটেই, দলের একজন স্পেশালিস্ট বোলারের জন্য ভীষণ বিব্রতকর। ৫ উইকেট কেবল ১ বার। সেই হোল্ডার পরের ২০ টেস্টে (চলতি টেস্টসহ) নিয়েছেন ৮০ উইকেট। ৫ উইকেট নিয়েছেন আরও ৬ বার, ম্যাচে ১০ উইকেটও পেয়ে গেছেন।
এই টেস্টসহ সবশেষ ১০ টেস্টে তার উইকেট ৫৬টি, বোলিং গড় ভয়ঙ্কর, ১১.৮৩। স্ট্রাইক রেটও দুর্দান্ত, ২৯.০০।
ব্যাটিংয়ে শুরু থেকেই তিনি মোটামুটি ধারাবাহিক। তবে এখন আরও উন্নতি হয়েছে। গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আটে নেমে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন ২২৯ বলে। রানের চেয়েও বড় কথা, তার ধরন। টেকনিক বেশ ভালো, তার চেয়ে ভালো টেম্পারামেন্ট। খুবই আত্মবিশ্বাসী, নিজের খেলাটা বোঝেন ও জানেন। আমার মতে, এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তিনি স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেও খেলতে পারেন। তার উচিত নিয়মিত পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করা।
পারফরম্যান্সের প্রতিফলন পড়েছে র্যাঙ্কিংয়ে। টেস্টের শীর্ষ অলরাউন্ডার তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই।
অধিনায়ক হিসেবেও এখন তিনি অনেক পরিণত। পারফর্ম করছেন, দলকে উজ্জীবিত করতে পারছেন। তার কথায়, মাঠের ভেতরে-বাইরে শরীরী ভাষায় আত্মবিশ্বাস ও কতৃত্বের ছাপ ফুটে উঠছে। তার মানে, ক্রমেই নেতা হয়ে উঠছেন।
দলও জিততে শুরু করেছে। টেস্ট অধিনায়ক হোল্ডারের রেকর্ড এখন মোটেও ফেলনা নয়।
বোলার হিসেবে উন্নতিটা চোখে পড়ার মতো। তিনি এক্সপ্রেস বোলার নন, সব কন্ডিশন দারুণ সুইং করানোর মতো শিল্পীও নন। তার মতো বোলারদের নিয়মিত একটা পর্যায়ে পারফর্ম করে যেতে হয়, সাপোর্ট করতে হয়। এটা তিনি খুব ভালোভাবে করছেন। এই বোলারদের জ্বলে উঠতে হলে মূলত সহায়ক কন্ডিশন ও উইকেট প্রয়োজন। এই সহায়তা পেলে যে তিনি ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারেন, সেটি তিনি দেখাচ্ছেন।
শুরুতে যেটা বলেছি, আজকে ক্রিজের ব্যবহার অসাধারণ করেছেন। কখনও স্টাম্পের দূর থেকে, কখনও কাছ থেকে, কখনও মাঝামাঝি, এভাবে নানা অ্যাঙ্গেল সৃষ্টি করে ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলেছেন। বিশেষ করে বেন স্টোকসের আউটে, যেভাবে ওয়াইড অফ দা ক্রিজ ডেলিভারিটা প্রায় পারফেক্ট জায়গায় পিচ করালেন এবং সেখান থেকে স্ট্রেইট করালেন, অসাধারণ! জস বাটলারের ক্ষেত্রে, ক্রিজের দূর থেকে বল করে অ্যাঙ্গেলে বিভ্রান্ত করেছেন। জ্যাক ক্রলিকে আউট করেছেন দারুণ সেট আপ করে, আউট সুইঙ্গার করতে করতে একটা ভেতরে ঢুকিয়েছেন আচমকা, ক্রলি জবাব পাননি। এসব কিছুই বলছে, বোলার হোল্ডার পরিণত হয়ে উঠছেন।
এক দল ক্রিকেটার আছেন, সহজাত সামর্থ্যের ঝলক দিয়ে মন ভরাবেন। আরেক দল আছেন, হোল্ডারদের মতো, ঠেকে শিখবেন, নিজেকে ভেঙে গড়বেন, পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাবেন। দুই দলকেই দেখা আনন্দময়, বিশুদ্ধ ক্রিকেট ব্যাপারটিই অদ্ভূত আনন্দময়।
– ফেসবুক থেকে