তখন রক্ত টগবগ করা সময়।
প্রথম আলোর সব ফিচার পাতায় সমানে লিখছি। অধুনালুপ্ত স্টেডিয়াম পাতায়ও টুকটাক লিখে ‘ক্রীড়াবিশেষজ্ঞ’ বলে নাম করার চেষ্টা করছি। সাংবাদিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু না হলেও মোহাম্মদ আশরাফুলের বাসায় গিয়ে তাঁর মাকে নিয়ে ফিচার লিখেছি।
আমি তখন জিওফ বয়কটের মতো ঠোটকাটা, রিচি বেনোর মতো পণ্ডিত বিশেষ!
একদিন ঠিক করলাম, তখনকার সিনিয়র দুই ক্রিকেটার জাভেদ ওমর বেলিম ও খালেদ মাহমুদ সুজনকে নিয়ে একটা মতামত লিখবো। লিখলাম; যাচ্ছেতাই লিখলাম। আমাকে তখন বেঁধে রাখে কে?
না আছে ক্রিকেট জ্ঞান, না আছে কৃতজ্ঞতা বোধ, না আছে ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা। এই ভাসা ভাসা, ধোয়াশা ধোয়াশা বোধ নিয়েই লিখে ফেললাম-কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আর কতোদিন!
যেদিন লেখা ছাপা হলো, পরদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে দলবদল। একটা ফিচার করার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গেছি। একেবারে ঢোকার পথে দেখা হলো আশরাফুলের সাথে। চিরাচরিত একটা দুষ্টুমির হাসি আছে আশরাফুলের। সেটা মুখে ঝুলিয়ে বললেন, ‘আপনারে জাভেদ ভাই খোজে।’
জাভেদ ভাই মানে যাকে নিয়ে যাচ্ছেতাই লিখেছি? যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে লেখা প্রকাশ করেছি!
ভয়ে ভয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকলাম। পেছন থেকে আশরাফুল বললেন, ‘সাবধানে থাইকেন। জাভেদ ভাই কিন্তু ভয়ানক সব বিদেশি কুকুর পোষে। বাসায় নিয়ে…’
আসলেই ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো।
চুপেচাপে দলবদল রুমের এক কোনায় দাড়িয়ে আছি। দেখছি, জাভেদ ভাই আছেন। এর ওর সাথে কথা বলছেন। আমাকে দেখছেন না। চেনেন না, ফলে বিপদের সম্ভাবনা নেই। হঠাৎ দেখি টেংকু ভাইয়ের (সামসুল হক টেংকু, ক্রীড়া ফটো সাংবাদিকতার কিংবদন্তী) সাথে কথা বলছেন। টেংকু ভাই আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলেন।
আমি পেছন ফিরে দেখলাম, মাটি থেকে কতোটা ওপরে আছি। লাফ দিয়ে কী দৌড় দেবো?
জাভেদ ভাই কাছে এসে ঘাড়ে হাত রাখলেন। আমি ঘামছি। বললেন, ‘চলেন, চা খাই।’
আমার ‘না’ বলার শক্তি নাই। জাতীয় দলের এক সুপার স্টার কাঁধে হাত রেখে চা খেতে ডাকছে। আমি নিশ্চিত এখন গাড়িতে তুলে বাড়ি নিয়ে বিদেশি কুকুরের সামনে ছেড়ে দেবে।
কোথায় এসেছি, বুঝতে পারছি না। দেখি একটা রেস্টুরেন্ট। চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে বসেই আমাকে বললেন, ‘আমি খুব মন দিয়ে লেখাটা পড়েছি। কিছু জিনিস আমার মনে হয় রিথিংক করার সুযোগ আছে। স্ট্রাইক রেট নিয়ে আপনার কিছু কথায় আমার দ্বিমত আছে। তবে দাদা, আপনার লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। আমি বাকি যে কয়দিন খেলবো, এটা আমার কাজে দেবে।’
দিস ইস জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা। বা গুল্লু। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রতিভাধর ব্যাটসম্যানদের একজন নন তিনি। তবে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশ্রমী, সবচেয়ে চিন্তাশীল এবং সবচেয়ে বেশি সমালোচনা গ্রহণ করতে পারার ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রিকেটারদের একজন জাভেদ ওমর।
বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে, যখন একটা দল হয়ে ওঠার চেষ্টায় প্রানন্ত লড়ছে বাংলাদেশ, সেই সময়ে দিনের পর দিন হেড ডাউন করে একা ব্যাটিং লিইন আপ ধরে রাখা জাভেদ ওমর। বাংলাদেশকে একটু হাসি, একটু মান বাঁচানোর উপলক্ষ এনে দেওয়া জাভেদ ওমর।
জাভেদ ওমর হকি খেলোয়াড় হতে পারতেন; সেটাই স্বাভাবিক ছিলো।
বড় দুই ভাই হকি খেলোয়াড়। এক ভাই জাতীয় দলে খেলেছেন, এক ভাই আম্পায়ার হয়েছেন। পুরোনো ঢাকার ছেলে জাভেদও হকি খেলোয়াড় হতে পারতেন। কিন্তু হয়ে গেলেন ক্রিকেটার।
বকশী বাজার থেকে উঠে আসা জাভেদের মূল সম্পদ ছিলো ব্যাকফুটে অসম্ভব একজন শক্তিশালী খেলোয়াড়। একটু শর্ট, ওয়াইড বল পেলে কাট করায় জুড়ি ছিলো না। ওয়ানডে ক্রিকেটার বলতে যা বোঝায়, নব্বই দশকজুড়ে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে সেই রূপটা কখনোই দেখাতে পারেননি। বলা হতো, জাভেদ একজন টেস্ট ক্রিকেটার। অথচ ভাগ্য দেখুন, সেই জাভেদ প্রথম টেস্টে সুযোগ পেলেন না।
হকি খেলতেন। হকি ব্যকগ্রাউন্ড থেকে আসা সব ক্রিকেটারই দারুণ অ্যাথলেট হয়ে থাকেন; জাভেদও তাই ছিলেন। তার সময়ে সেরা ফিল্ডার ছিলেন।
প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিলেন বুলাওয়েতে। সে সময়ের জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিক, ব্লিগনট, এনকালাদের রিয়েল ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে জোড়া হাফ সেঞ্চুরি ছিলো; দ্বিতীয় ইনিংসেই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারি থ্রু দ্য ব্যাট করলেন। মানে আদ্যপান্ত অপরাজিত ছিলেন। এই কীর্তি ওয়ানডেতেও করেছেন।
নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে পেশোয়ারে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোনো টেস্টে লিড নিয়েছিলো।
জাভেদকে নিয়ে সমালোচনা ছিলো ওয়ানডেতে। বল নষ্ট করেন, পিটিয়ে খেলতে পারেন না, চার-ছক্কার ফুলঝুরি ছোটে না। একদিকে তাঁর হাটুর বয়সী আশরাফুল, আফতাবরা ছক্কা মারছেন; অন্য দিকে জাভেদ মাটি আকড়ে পড়ে আছেন। অথচ ক্যারিয়ার শেষে দেখা গেলো, সেই সময়ের বেশিরভাগ বাংলাদেশি টপ অর্ডারের চেয়ে জাভেদের স্ট্রাইক রেট বেশি। কারণ, দৌড়াতে পারতেন। তিন বল বসে থেকে একটা চার নয়, চার বলে চারটে ডাবল; এই হলো তাঁর ফিলোসফি।
আর সে এমন একটা সময় যখন দুটো চার মেরে আউট হয়ে যাওয়াই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের বৈশিষ্ট্য ছিলো যেনো। সেই সময়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক ম্যাচের আগে বলতেন, পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলতে চাই। আর এই চাওয়াটা পূরণ হলে সেটা ওই জাভেদের কল্যানেই হতো।
জাভেদ ভাই অবশ্য এসব কথা বলতে চান না। হাসতে হাসতে বলেন, ‘ভাই, আমার তো বাকীদের মতো প্রতিভা ছিলো না। পরিশ্রম করে খেলতাম।’
একদিন দেশের সেরা ক্রিকেটার বাছাই করার জন্য তাঁর সাথে আলাপ করছিলাম। লিস্টে নিজের নাম দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘আমাকে কোথায় রাখবেন? সেকালে অপি, বিদ্যুৎ, এই সময়ে তামিমরা আছে। এদের কাছে আমার তো কোনো প্রতিভাই নেই। এদের মতো প্রতিভাধর হলে তো আরও কয়েক হাজার রান করতে পারতাম।’
দরকার নেই, জাভেদ ভাই। যা রান করেছেন, ওর প্রতিটা কথা বলেছে। আপনার ব্যাট থেকে আসা প্রতিটা রান আজকের এই বাংলাদেশকে গড়ে দিয়েছে। হ্যা, আপনার ক্যারিয়ার চলা অবস্থায় আপনাকে সম্মানটা দিতে পারিনি আমরা।
আজ স্যালুট করে বলছি, এই আপনি এবং আপনারা তৈরী করে দিয়েছেন আজকের তামিমদের পথ। এই ক্রিকেট আপনাদের ওপরই দাড়িয়ে আছে।