১ উইকেট, ১৯ রান! রুদ্ধশ্বাস যুদ্ধ!

সত্তর-আশির দশকের পরেও বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের হারানোটা ছিলো যেনো বিশাল কোনো অর্জন। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি দলগুলোর জন্য ক্যারিবিয়ানরা ছিলো আতংকের নাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে তাদেরকে হারানোটা ছিলো অনেক দলের জন্যই দিবাস্বপ্ন। এশিয়ার দলগুলো যেনো পাত্তাই পেতোনা ক্যারিবিয়ান দাপটের সামনে। তবে ২০০০ সালে পাকিস্তানের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সুযোগ এলো টেস্ট সিরিজ জয়ের!

অ্যাম্ব্রোস, ওয়ালশ, চন্দরপলদের সামনে তাদের মাটিতেই তাদেরকে হারিয়ে সিরিজ জয় যেনো বিরাট প্রাপ্তি। তবে কাছে গিয়েই সেই স্বপ্ন সেদিন পূরণ হয়নি পাকিস্তানের। আম্পায়ারের পক্ষপাতিত্ব সহ বেশ কিছু সুযোগ মিসে কাছে গিয়েও হারের আক্ষেপ নিয়ে দেশে ফিরেছিলো পাকিস্তান।

২৯ মে, ২০০০। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিততে পাকিস্তানের দরকার আর মাত্র ১ উইকেট। অপরদিকে, নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ক্যারিবীয়দের প্রয়োজন ১৯ রানের! ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক অ্যাডামস তখনো ক্রিজে। অপরপ্রান্তে কোর্টনি ওয়ালশকে নিয়ে ভীত গড়লেন জিমি অ্যাডামস।

ওভারের পর ওভার মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন দু’জন। আর এক পা এক পা করে অ্যাডামসের ব্যাটে জয়ের দিকেই এগোতে থাকে ক্যারিবিয়ানরা। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, মুশতাক আহমেদরাও ছিলেন এ দুজনের কাছে নিরুপায়। পাকিস্তানের কোনো অস্ত্রই ভাঙতে পারছিলো না এ জুটি।

জিমি অ্যাডামসের ২১২ বলে ৪৮ ও কোর্টনি ওয়ালশের ২৪ বলে অপরাজিত ৪ রানে শেষ উইকেট জুটিতে ৭৩ বল খেলার পথে শ্বাসরুদ্ধকর ১ উইকেটের জয় পায় ক্যারিবিয়ানরা।

প্রথম দুই টেস্টে ড্র’য়ের পর সিরিজ নির্ধারণি তৃতীয় টেস্টে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নামে পাকিস্তান। কোর্টনি ওয়ালশের পেস দাপটে শুরু থেকেই মুখ থুবড়ে পড়ে পাকিস্তানের ব্যাটিং শিবির। তবে ইনজামাম উল হক ও মোহাম্মদ ইউসুফের অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে ঘুরে দাঁড়ায় পাকিস্তান।

ইনজামাম ৫৫ রানে ফিরলেও একপ্রান্তে অসাধারণ ব্যাটিং করে সেঞ্চুরি তুলে নেন মোহাম্মদ ইউসুফ। তবে বাকিদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় প্রথম ইনিংসে মাত্র ২৬৯ রানেই গুড়িয়ে যায় পাকিস্তানের ইনিংস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে কোর্টনি ওয়ালশ একাই শিকার করেন ফাইফর।

জবাবে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শিবনারায়ণ চন্দরপল ও অধিনায়ক জিমি অ্যাডামসের ব্যাটে ৩ উইকেটে ২১৮ রানে পৌঁছে যায় ক্যারিবীয়রা। মনে হচ্ছিলো প্রথম ইনিংসে বড় লিড পাবে স্বাগতিকরা। কিন্তু এরপরই ওয়াসিম আকরামের স্যুইং ভেলকিতে মাত্র ৬৫ রানেই শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে ২৭৩ রানে গুড়িয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ! ৬১ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন আকরাম! ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে চন্দরপল সর্বোচ্চ ৮৯ ও অ্যাডামস করেন ৬০ রান।

মাত্র ৪ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই উইকেট হারাতে থাকে সফরকারীরা। বাকিদের ব্যর্থতার মাঝে এই ইনিংসেও ভীত গড়েন ইনজামাম ও ইউসুফ। ইনজামামের ৬৮ ও ইউসুফের ৪২ ছাড়া কেউই ছুঁতে পারেননি ২৫ রানের কোটা! রিওন কিং ও কার্টলি অ্যাম্ব্রোসের দাপুটে বোলিংয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২১৯ রানেই গুড়িয়ে যায় সফরকারীরা। কিং ৪ ও অ্যাম্ব্রোস শিকার করেন ৩ উইকেট।

মাত্র ২১৬ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে দলীয় ৩১ রানেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে বিপাকে পড়ে ক্যারিবীয়রা। এরপর ওয়াইন হাইন্ডস ও চন্দরপলের ৫৩ রানের জুটি বিপর্যয় সামাল দেয়। দলীয় ৮৪ রানে চন্দরপল ফিরলেও অধিনায়ক অ্যাডামসের সাথে জুটির পথে একপ্রান্তে ফিফটি তুলে নেন হাইন্ডস।

ধীরে ধীরে জয়ের দিকেই এগোচ্ছিলো স্বাগতিকরা। চতুর্থ দিনের একবারে শেষদিকে দলীয় রান তখন ৩ উইকেটে ১৪৪। জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ৭২ রান, হাতে তখনো ৭ উইকেট। ওই ১৪৪ রানেই দিনের কয়েক বল বাকি থাকতে ওয়াসিম আকরামের বলে হাইন্ডস ব্যক্তিগত ৬৩ রানে বোল্ড হয়ে ফিরেন! ৪ উইকেটে ১৪৪ রান নিয়ে দিন শেষ করে ক্যারিবীয়রা।

শেষ দিনে ব্যাট করতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে স্বাগতিকরা। রামনারেশ সারওয়ান, রিডলি জ্যাকবস, ফ্র‍্যাংলিন রোজরা দ্রুত ফিরলে দলীয় ১৭৭ রানেই ৭ উইকেট হারায় ক্যারিবিয়ানরা। তবে ক্রিজে তখনো একপ্রান্তে থিতু অ্যাডামস।

পাকিস্তানের প্রয়োজন ৩ উইকেট, আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার ৩৯ রান! অষ্টম উইকেটে কার্টলি অ্যাম্ব্রোসের সাথে ১৭ রানের জুটির পথে আবারো জয়ের আশা জাগে ক্যারিবিয়ানদের। জয়ের থেকে মাত্র ২২ রান দূরে থাকতে সাকলাইন মুশতাকের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে আউট অ্যামব্রোস!

ম্যাচে তখন টান টান উত্তেজনা! এক ওভার বাদেই ওয়াসিম আকরামের বলে শূন্য রানেই আউট রিওন কিংও। ১৯৭ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে তখন ম্যাচে ধুঁকছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাকিস্তানের প্রয়োজন মাত্র ১ উইকেট, আর স্বাগতিকদের দরকার ১৯ রান! ওয়াসিম আকরাম, সাকলাইন মুশতাকদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তখন বড় দায়। তবে একপ্রান্তে তখনো জয়ের চেষ্টায় মত্ত অ্যাডামস। শেষ উইকেটে কোর্টনি ওয়ালশকে নিয়ে নতুন শুরু করেন ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক।

ওয়াসিম, মুশতাকদের সামনে ১৩ ওভারের বেশি মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন দু’জনে। আর এক পা এক পা করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আকরাম-মুশতাকরা শেষ উইকেটে দমাতে পারেননি অ্যাডামস-ওয়ালশদের। অ্যাডামসের অপরাজিত ৪৮ রানে অ্যান্টিগায় ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

শেষ ৫ রান নিতে প্রায় ৪০ মিনিট খেলেছিলো অ্যাডামস-ওয়ালশরা। তাদের ধৈর্য্যশীল ব্যাটিংয়েই ১-০ তে সিরিজ নিজেদের করে স্বাগতিকরা। তবে দুই ইনিংসেই দুর্দান্ত বোলিংয়ের কারণে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হন ওয়াসিম আকরাম।

তবে সহজ দুই রান আউট সহ কোর্টনি ওয়ালশ ও জিমি অ্যাডামস দুইজনই এজ হয়ে ক্যাচ আউট হয়েছিলেন। তবে আম্পায়ার বিলি ডক্ট্রভ মোটেও নিজের জায়গা থেকে নড়েননি। তার দেওয়া নট আউট সিদ্ধান্তেই জীবন পায় দু’জন। পুরো সিরিজেই আম্পায়ারের বেশ কিছু পক্ষপাতিত্বমূলক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সেবার বেশ কিছু দৃষ্টিকটু সিদ্ধান্তে ক্যারিবিয়ান মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ পায়নি পাকিস্তান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link