জনি বেয়ারস্টোর আউট নিয়ে বলার আগে বেন ডাকেটের আউট নিয়ে কিছু বলি। এখানে ওপরের ছবিটি দেখুন, এই ডেলিভারিতেই ডাকেট আউট হন। অ্যালেক্স কেয়ারির পজিশন দেখেছেন? বাঁহাতি ডাকেটের জন্য এমন পজিশনে তিনি দাঁড়িয়েছেন, যেন ডানহাতির জন্য কিপিং করছেন।
এটা কেয়ারির স্মার্টনেস ও পরিকল্পনার অংশ। ডাকেটের জন্য কৌশল ছিল, তার শরীর তাক করে শর্ট বল করা হবে। সেক্ষেত্রে পুল করতে গেলে বা গ্ল্যান্স করলে বা কোনোভাবে বল তার গ্লাভস কিংবা ব্যাটের কানা স্পর্শ করলে, বল লেগ সাইডের থাকার সম্ভাবনা বেশি। কেয়ারি তাই আগে থেকেই লেগ সাইডে দাঁড়িয়ে আছেন। হতে পারে, এটা আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল। আবার তাৎক্ষনিক ভাবনাও হতে পারে। হতে পারে, বোলার জশ হেইজেলউড আগেই তাকে ইশারা দিয়ে রেখেছিলেন। কিংবা হতে পারে, কেয়ারি নিজেই এটা করেছেন।
যেটাই হোক, পুরোটাই দুর্দান্ত স্মার্টনেস এবং ম্যাচ সচেতনতার প্রমাণ। লেগ সাইডে থাকার পরও একটু লাফিয়ে দারুণ রিফ্লেক্স দেখিয়ে ক্যাচটি নিতে হয়েছে তার। স্বাভাবিক পজিশনে থাকলে নিশ্চিতভাবেই ক্যাচ নিতে পারতেন না। জনি বেয়ারস্টোর আউটও ঠিক একইরকম। কেয়ারির ম্যাচ সচেতনতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফসল।
ম্যাচ শেষে প্যাট কামিন্স বলেছেন, কেয়ারি কয়েক বল আগেই খেয়াল করেছেন যে বেয়ারস্টো বের হয়ে যাচ্ছেন। ব্যস, তিনি চান্স নিয়েছেন এবং দারুণভাবে কাজে লেগেছে। নিচের ছবিতেই পরপর দুটি ফ্রেমে দেখতে পাচ্ছেন, বেয়ারস্টো ক্রিজে থাকা অবস্থায়ই কেয়ারি থ্রো করেছেন।
যদি রিপ্লে দেখে থাকেন, নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, কেয়ারি বল গ্লাভসে নিয়ে কিন্তু একটুও অপেক্ষা করেননি, কোনো বিরতি দেননি, থমকে যাননি। বরং বল ধরে একই গতিশীলতায় আন্ডার আর্ম থ্রো করেছেন। বেয়ারস্টো তখনও ক্রিজেই। বেরই হননি। কিন্তু বারবার যেহেতু তিনি বের হচ্ছিলেন, কেয়ারি স্রেফ একটা চান্স নিয়েছেন। বেয়ারস্টোও ক্যাজুয়ালি বের হয়ে গেছেন। রিপ্লে দেখলে খেয়াল করবেন, বেয়ারস্টোকে বের হতে দেখে বল স্টাম্পে লাগার আগেই কেয়ারি উদযাপন শুরু করে দিয়েছেন।
ক্রিকেটের আইনে এই আউটে কোনো সংশয়, সন্দেহের অবকাশই নেই। বেয়ারস্টো অবশ্যই রান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন না। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তিনি আউট। যেমনটি, আগের দিন মিচেল স্টার্কের হাতে ধরা পড়েও বেঁচে গিয়েছিলেন বেন ডাকেট। বল স্টার্কের মুঠোয় ছিল, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, বল মাটি স্পর্শ করলেও ক্যাচ বৈধ হবে, যদি বল ও শরীর, দুটোই নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখানে বল স্টার্কের মুঠোয় জমা থাকলেও তার শরীর তখনও স্লাইডিংয়ে ছিল। আইনের সৌজন্যে ডাকেট বেঁচে গেছেন, আইনের খাড়ায় বেয়ারস্টো কাটা পড়েছেন। সিম্পল।
ধারাভাষ্যে মাইক আথারটন, ওইন মর্গ্যানরা কিন্তু বেয়ারস্টোর অসাবধানতাকেই দায় দিয়েছেন। এমনকি বেন স্টোকসও বলছেন, ‘আউট।’ তবে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ক্রিকেটের স্পিরিটের প্রশ্ন তুলছেন। কামিন্সের জায়গায় তিনি হলে আপিল তুলে নিতেন বলেও দাবি করেছেন। ইংল্যান্ড কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের মতে, ক্রিকেটারদেরই দায়িত্ব ক্রিকেটীয় স্পিরিটের সুরক্ষা দেওয়া।
স্টোকস, ম্যাককালাম, দুজনই দুর্দান্ত। দুজনেরই অনেক কিছু পছন্দ না করে উপায় নেই। কিন্তু ক্রিকেটীয় স্পিরিটের এই কথাগুলি নিতান্তই হাস্যকর। সেটা নন-স্ট্রাইক প্রান্তে রান আউটের (মানকাডিং) ক্ষেত্রে হোক, বেয়ারস্টোর এই আউটে হোক বা অন্য অনেক আউটে। এসব জায়গায় স্পিরিটের কথা বলা অবান্তর।
হ্যাঁ, ক্রিকেট বা যে কোনো খেলার স্পিরিট অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই স্পিরিট মেলে ধরার অনেক জায়গা আছে। যেটা আইনের মধ্যে আছে, সেটা কখনোই খেলার চেতনার পরিপন্থী হতে পারে না। অনেক অনেক বছর আগে, কোনো এক যুগে, ক্রিকেট যখন অনেকটাই অ্যামেচার খেলা ছিল, কায়দা করে এটিকে ‘জেন্টেলমেন’স গেম’ বলা হতো (দুনিয়ার কোন খেলা জেন্টেলম্যানদের জন্য নয়?), তখন এসব কিছু রীতি চালু হয়েছিল, এখনও সেসবের ‘হ্যাংওভার’ কাটেনি অনেকের। কিংবা আসলে কেটেছে, কিন্তু যখন নিজেদের প্রয়োজন হয়, তখন এটি টেনে আনা হয়।
সেই বডিলাইন থেকে শুরু করে আগে-পরে ইংলিশরা কি ক্রিকেটীয় স্পিরিটের দফারফা করেনি? বেয়ারস্টো যেভাবে আউট হলেন, তিনি নিজেই তো সেটা অনেক সময়ই চেষ্টা করেন। ম্যাচ শেষে কামিন্স তো সেটা উল্লেখও করেছেন যে, এই টেস্টেই প্রথম দিনে বেয়ারস্টো চেষ্টা করেছে এটির, ২০১৯ সালের সিরিজে চেষ্টা করেছেন এভাবে স্মিথকে আউট করতে।
স্পিরিটের ভাবনায় কাতর ম্যাককালাম কি ২০০৬ সালে ক্রাইস্টচার্চে বিতর্কিত ঘটনা ঘটাননি! রান নেওয়া শেষ করে মুত্তিয়া মুরালিধরন ছুটে গিয়েছিলেন সেঞ্চুরি করা কুমার সাঙ্গাকারাকে অভিনন্দন জানাতে। কিন্তু ম্যাককালাম তাকে রান আউট করে দেন। ওই দিন শেষে মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছিলেন, তার গোটা দল এই ঘটনায় হতাশ। তখন নিউ জিল্যান্ডের অধিনায়ক ও আরেক ভদ্র ক্রিকেটার বলে পরিচিত স্টিভেন ফ্লেমিং বলেছিলেন, এভাবে আউট করায় তাদের কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ আইন অনুযায়ী এটা আউট।
সেটিই প্রথম নয়। ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সহজ জয়ের পথে অনেকটা এভাবেই ক্রিস এমপোফুকে রান আউট করেছিলেন ম্যাককালাম। স্পিরিট তখন ঘুমিয়ে ছিল? ম্যাককালাম অবশ্য খেলা ছাড়ার পর এমসিসির স্পিরিট অব ক্রিকেট লেকচারে দু:খপ্রকাশ করেছিলেন সাঙ্গা ও মুরালির কাছে। তবে তাতেও বাস্তবতা বদলাচ্ছে না। আইনে যদি কিছু বৈধ থাকে, সেখানে স্পিরিটের প্রসঙ্গ আনা হলে ক্রিকেট নামক খেলাটিকে এবং এর ভিত হাস্যকর করে তোলা হয়।
বিতর্ক অবশ্য হবেই। এসব ক্ষেত্রে মতের ভিন্নতাও থাকবে। মাঠের ক্রিকেট ছিল দারুণ উপভোগ্য। শুধু তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই নয়, দুই দলের, স্কিল, কৌশল, পরিকল্পনা, সব দিক থেকেই ক্রিকেটীয় মান একদম চূড়ায়। দ্বিতীয় দিনে ন্যাথান লিঁওকে হারানোর পরও অস্ট্রেলিয়ার এই জয় অসাধারণ। তেমনি দুর্দান্ত বেন স্টোকসের ইনিংস।
শেষ দিনের প্রথম সেশনে খুব সতর্কতায় ব্যাট করছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বাউন্ডারি মারেননি, খেলাটাকে গভীরে টেনে নিতে চাইছিলেন। স্ট্রাইক রেট পঞ্চাশের নিচে ছিল। বেয়ারস্টো আউট হওয়ার পর যখন বুঝলেন বাকি কাজ একাই করতে হবে, চোখের পলকে ফার্স্ট গিয়ার থেকে ফিফথ গিয়ারে চলে গেলেন। যেটা তিনি আগেও করেছেন, নানা সময়ে। ক্যারিয়ারে যতগুলি স্মরণীয় ইনিংস তিনি খেললেন, অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটারের ক্যারিয়ারে তা নেই বা খুব বেশি নেই। মানদণ্ড যদি হয় ‘ইম্প্যাক্ট’, ব্যাটে-বলে স্টোকস তাহলে ক্রিকেট ইতিহাসের সেরাদের একজন।
২-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেও অস্ট্রেলিয়ান সমর্থক হিসেবে নির্ভার থাকতে পারছি না। একটি কারণ, লিঁওর না থাকা। ইংল্যান্ডেরও প্রথম পছন্দের স্পিনার জ্যাক লিচ নেই। তবে অস্ট্রেলিয়া দলের জন্য লায়নের ভূমিকা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। লায়ন শুধু দলের সেরা স্পিনারই নয়, সেরা বোলারও। তিনি রান আটকে রাখেন, নিয়ন্ত্রণ রাখেন এবং একই সঙ্গে আগ্রাসীও, উইকেট এনে দেন। সব কন্ডিশনে, সব দলের বিপক্ষে। এবারও তো প্রথম টেস্টে ৮ উইকেট তার। টড মার্ফি আসবেন এখন একাদশে। তিনি দারুণ প্রতিভাবান এবং হয়তো ভবিষ্যতের লিঁও। তবে লিঁও তো নন! এই কন্ডিশনে ও ইংল্যান্ডের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের সামনে মার্ফির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষায়। ইংল্যান্ড নিশ্চিতভাবেই তাকে টার্গেট করবে দ্রুত রান তুলতে।
নির্ভার থাকতে না পারার মূল কারণ অবশ্য, ‘বাজবল’ ও এই ইংল্যান্ড দলের মানসিকতা। ‘বাজবল’ নিয়ে কিছুদিন আগে অতি রোমাঞ্চ দেখেছি। এখন আবার চারপাশে অতি তাচ্ছিল্যও দেখছি। আমার মতে, দুটিই বাড়াবাড়ি।
বাজবল অবশ্যই দারুণ কিছু। বিশেষ করে, ইংল্যান্ডের মতো দল, একসময় যারা ছিল চরম বিরক্তিকর টেস্ট দল, যারা ছিল বাড়াবাড়ি রকমের ঐতিহ্য ও প্রথাপ্রিয়, তাদের জন্য বাজবল একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এবং দারুণ কার্যকরও। যে দল ১৭ টেস্টের মধ্যে স্রেফ ১টি জিতেছে, তারা বাজবল জমানায় একের পর এক ম্যাচ জিতেছে। আর বাজবল মানে তো শুধু জয়-পরাজয়ই নয়, এটির উদ্দেশ্য হলো খেলাটাকে গতিময় করে, খেলাটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ম্যাচ জেতা। এই পথে জয় আসবে, পরাজয় আসবে। কিন্তু খেলাটা গতিময় ও ঘটনাবহুল থাকবে।
তবে বাজবল দিয়ে টেস্ট ক্রিকেট আমূল বদলে যাবে বা সব দেশই এটা অনুসরণ করবে, দেশে দেশে নতুন ধারা শুরু হবে, এই ভাবনাও ঠিক নয়। অন্যান্য দেশে তো বহুদূর, পারিপার্শ্বিকতা বদলে গেলে ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড দলই এটা অনুসরণ করবে কি না, কে জানে! স্কিল থাকলে যে প্রথাগত টেস্ট ক্রিকেটও কার্যকর, আকর্ষণীয় ও উপভোগ, এটা তো অস্ট্রেলিয়া দেখাচ্ছেই! আরও অনেক দলই দেখাচ্ছে ও দেখাবে।
তো, সবই চলুক না! একটিকে মাথায় তুলে আরেকটিকে আছড়ে ফেলতে হবে কেন? হ্যাঁ, বাজবলের মতো অভাবনীয় কিছু এত দারুণভাবে চলতে থাকলে হইচই, আলোচনা হবেই। কিন্তু এটাই চূড়ান্ত বা এটিই একমাত্র পথ, সেটা ভাবার কারণ নেই। ক্রিকেটীয় মানের দিক থেকে দারুণ একটি সিরিজ হচ্ছে। চলুক এভাবেই। ইংল্যান্ড বাজবল বাজাতে থাকুক, অস্ট্রেলিয়া প্রথার পূজা করুক, আমরা উপভোগ করি। ব্যস!
– ফেসবুক থেকে