বহুদিন বাদে হেসেছে উইলিয়ামসনের ব্যাট

সুরিয়াকুমার যাদব, ফিন অ্যালেন, ক্যামেরন গ্রিনদের মতো আনকোরা ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাটিংশৈলীর মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে পুরো ক্রিকেট। তাই ফ্যাব ফোরের কেন উইলিয়ামসকে ধরে নেয়া হচ্ছিল, নতুনত্বের নব জোয়ারে ব্রাত্যদের দলেই নাম লেখাবেন তিনি। কিন্তু কেন উইলিয়ামসন কি এত তাড়াতাড়িই চাপের মুখ ভেঙ্গে পড়ার পাত্র?

ব্যাট হাতে বিবর্ণ ছাপের দেখা মিলছিল বিশ্বকাপের শুরু থেকেই। টুকটাক রান আসছিল ঠিকই। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ম্যাচের বিবেচনায় সেই ইনিংসগুলো বড্ড দৃষ্টিকটু। অনেক ক্ষেত্রে ম্যাচ হারার জন্য প্রভাবকও হয়ে উঠেছিল। ক্রিকেট সমর্থকদের এক কূলের মাঝে তাই বদ্ধমূল ধারণাই হয়ে গিয়েছিল, কেন উইলিয়ামসনের পাশে ‘অধিনায়ক’ পরিচয়টা আছে বলেই ব্ল্যাকক্যাপসদের টি-টোয়েন্টি দলে তিনি টিকে আছেন।

এর উপর সুরিয়াকুমার যাদব, ফিন অ্যালেন, ক্যামেরন গ্রিনদের মতো আনকোরা ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাটিংশৈলীর মুগ্ধতায় ডুবে যাচ্ছে পুরো ক্রিকেট। তাই ফ্যাব ফোরের কেন উইলিয়ামসকে ধরে নেয়া হচ্ছিল, নতুনত্বের নব জোয়ারে ব্রাত্যদের দলেই নাম লেখাবেন তিনি। কিন্তু কেন উইলিয়ামসন কি এত তাড়াতাড়িই চাপের মুখ ভেঙ্গে পড়ার পাত্র?

না মোটেও না। নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক ফিরে এলেন একদম মোক্ষম সময়ে। আইরিশদের বিপক্ষে খেললেন ৩৫ বলে ৬১ রানের এক দায়িত্বশীল ইনিংস। যে স্ট্রাইকরেট নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা, সেই সবকিছুকে একদম হাতের তুড়ি মেরে অদৃশ্য করে দিলেন। দায়িত্বের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টির মেজাজ বুঝে তিনি রান করেছেন বহুদিন বাদে। 

ইনিংসের শুরুতে কেন উইলিয়ামসন সাধারণত একটু রয়েশয়েই খেলেন। এই পন্থা অবশ্য তিনি একা অবলম্বন করেন না। বিরাট কোহলি, বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ানদের মতো ব্যাটাররাও এভাবেই খেলে থাকেন। কিন্তু তারা একটি পর্যায়ে গিয়ে খোলস ছাড়াতে শুরু করেন। কিন্তু উইলিয়ামসন এখানেই পিছিয়ে পড়ছিলেন। মন্থর গতিতে শুরু করছিলেন প্রত্যেকটি ইনিংসেই।

কিন্তু রানের গতি বাড়ানোর আগেই আউট হয়ে যাচ্ছিলেন। আর এতে করে দলের উপর চাপও বাড়ছিল বেশ। ৬৫ রানের ইনিংসের আগে এই বিশ্বকাপে তিনি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনটি। সেই তিন ইনিংসে তিনি বল খেলেছিলেন ৭৬ টি। অথচ ১০০ এরও কম স্ট্রাইকরেটে তাঁর রান ছিল ৭৩! এমন ধীর গতির ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন  উঠাটা তাই অনুমিতই ছিল। 

কেন উইলিয়ামসন বিশ্বকাপ শুরুর আগের ম্যাচেও একটি ফিফটি করেছিলেন। রানের ধারাবাহিকতা তাঁর মোটামুটি সব সময়ই ছিল। কিন্তু তাঁর ব্যাটিং নিয়ে প্রশ্ন ওঠার ক্ষেত্রে বিগত দুই বছরের একটি পরিসংখ্যান যে কোনো ক্রিকেট বিশ্লেষককেই ভাবতে বাধ্য করবে। পরিসংখ্যান বলে, ২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর গড় ২৯.৮০ থাকলেও স্ট্রাইক রেট ছিল মাত্র ১১৭। ২০২২ সালে এসে গড়টা ৩০ পেরোলেও এবার তাঁর স্ট্রাইকরেট কমে নিচে গিয়ে ঠেকেছে ১১২ তে। যেটি বর্তমানে এমন চার ছক্কার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বড্ড বেমানান।

কেন উইলিয়ামসন এখানে অন্যান্য ক্রিকেটারদের তুলনায় কতটা পিছিয়ে গেছেন সেটারও কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। যেমন বিরাট কোহলির কথাই যদি ধরা যায়, এ বছরে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ছিল ১৪১! এমনকি টি-টোয়েন্টি প্রায় অনিয়মিত হয়ে যাওয়া স্টিভ স্মিথের এ বছরে স্ট্রাইকরেট ১২০ ছিল। আর এ কারণেই তিনি এখন পর্যন্ত ঘরের মাটিতে হওয়া বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলতে পারেননি। কারণটা অতি সোজা। স্মিথ টি-টোয়েন্টি বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া একাদশে আসলে মানানসই না।

একই হিসেবে কিউই অধিনায়কও কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে ঠিকঠাক যান না। অধিনায়ক বলেই তিনি দলে আছেন, এ কথাটার প্রাবল্যতা আরো বাড়ে আরেকটি কারণে। টি-টোয়েন্টিতে কিউইদের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছেন মার্টিন গাপটিল। গত বছরেও ছিলেন দারুণ ফর্মে। কিন্তু এ বছরে নিজের ছন্দপতনের কারণে বিশ্বকাপের একাদশে ফিন অ্যালেনের কাছে তিনি জায়গা হারিয়েছেন। অথচ এ বছরের বিবেচনাতেও গাপটিল কেন উইলিয়ামসনের চেয়ে আরো দ্রুত গতিতে রান তুলেছিলেন। 

বিশ্বকাপের মতো আসরে অধিনায়ককে একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার উদাহরণ ক্রিকেট ইতিহাসে নেই বললেই চলে। মূলত সেই চিরায়ত প্রথার কারণেই ম্যানেজমেন্ট থেকে তেমন চাপ পাননি কেন উইলিয়ামসন। যা অভিযোগের তীর এসেছে তা সবই মাঠের বাইরের। কিন্তু মাঠের বাইরের সে আলোচনাটা ঠুনকো নয়, অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিকও বটে। 

৩৫ বলে ৬১ রানের ইনিংস। তাও আবার সেমিফাইনালে ওঠার ম্যাচে। দুর্দান্ত কামব্যাকের জন্য এর চেয়ে ভাল মঞ্চ আর হতে পারে না। তবে এক ইনিংস দিয়েই যে কেন উইলিয়ামসনকে নিয়ে বাইরের সব আলোচনা দমে যাবে সেটিও নয়। কারণ এমন বিধ্বংসী উইলিয়ামসনকেই  সবাই দেখতে চায়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও এমন ইনিংসের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে চায়। একশো কিংবা একশোর কিছু বেশি স্ট্রাইকরেট নিয়ে কোনো ইনিংস আর এখন দর্শক দেখতে চায় না। পরিস্থিতি বিবেচনায় মন্থর কিছু ইনিংসের গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেগুলোর সংখ্যা খুবই নগণ্য। 

বিরাট কোহলি এশিয়া কাপের আগেও তেমন লাইম লাইটে ছিলেন না। সমালোচনার সরব সরলরেখার মধ্যে দিয়ে তিনিও গিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আলোটা আবার নিজের করে নিয়েছেন। আজকের ৬৫ রানের ইনিংসের মাধ্যমে কেন উইলিয়ামসনও ফিরলেন। ফেরাটাও হলো রাজকীয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এর আগে কিউই ক্রিকেটারদের মধ্যে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের করা সর্বোচ্চ ৬৩৭ রানের রেকর্ডটি টপকে গেলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সব আসর মিলিয়ে কেন উইলিয়ামসের এখন রানসংখ্যা ৬৪৩। যা নিউজিল্যান্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ।

নিজের ফেরার দিনে রানের দিক দিয়ে শীর্ষে উঠলেন। ক্রিকেট পাড়ার সমর্থকরা এমন শীর্ষে থাকা কেন উইলিয়ামসকেই দেখতে চায়। শীর্ষে থাকা ক্রিকেটারের অবনমনের দৃশ্য কখনো মোহনীয় হয় না। সে সব দৃশ্য হয় আক্ষেপে ভরা, আফসোসে পূর্ণ। কেন উইলিয়ামসও নিশ্চয়ই আক্ষেপ ভরা গল্প লিখতে চাইবেন না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...