কেন উইলিয়ামসনকে নিয়ে সবাই খুব শ্রদ্ধাশীল। ২০১৯ বিশ্বকাপ জিততে না পারায় কেন উইলিয়ামসনের প্রতি সহানুভূতি রয়েছে আমাদের সবার, আর এই বছর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে তিনি যেন সেই অপ্রাপ্তি কে ভুলিয়ে দিলেন। অনেক লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে, তিনি কিভাবে একাগ্রতার সাথে পরিশ্রম করে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছেন, কিভাবে তার ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ সকলের কাছে শিক্ষণীয় ইত্যাদি।
এখানে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, প্রশ্নগুলি সম্পূর্ণভাবে ক্রিকেটীয় এবং উত্তরগুলিও আশা করি সেই আঙ্গিকেই হবে, আমার পোস্ট ভালো না লাগলে দয়া করে এড়িয়ে যাবেন, অহেতুক তর্ক-বিতর্ক গালাগালি করবেন না। কেন উইলিয়ামসনকে আমি নিজে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি, ক্রিকেটার হিসেবে পছন্দ করি। আমার প্রশ্ন বা কৌতূহল গুলো কোনোটাই কেন কে ছোট করে দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়।
১.
২০১৯ বিশ্বকাপ নিউজিল্যান্ড জেতেনি, হারেওনি তাঁরা। ম্যাচ নির্ধারিত ৫০ ওভারে টাই হয়, সুপার ওভারও টাই হয় এবং অদ্ভুত নিয়মে, বেশি বাউন্ডারি মারার জন্য ইংল্যান্ড কে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। মোটামুটি আমার চেনাশোনা সবাই এটা নিয়ে ইংল্যান্ডকে দুয়ো এবং নিউজিল্যান্ডকে বাহবা দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, এখানে ইংল্যান্ডের দোষ কোথায়? আইসিসি যুগ্মজয়ী ঘোষণা করতে পারতো, কিন্তু বাউন্ডারির নিয়ম টি অদ্ভুত হলেও সেটা আগে থেকেই টুর্নামেন্ট এর নিয়মাবলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফাইনালের ফলাফল দেখে ইংল্যান্ড কে চ্যাম্পিয়ন করার জন্য হঠাৎ করে সেটাকে তৈরি করা হয়নি। তাহলে ইংল্যান্ডকে একতরফা ভাবে গালাগালি বা ব্যঙ্গ করার কারণ কি? তারাও কিন্তু নিউজিল্যান্ড এর সমপরিমাণ রান করেছে, এবং বাউন্ডারি বেশি মেরেছে। এর থেকে অনেক হাস্যকর নিয়মে দক্ষিণ আফ্রিকা কে ৯২ বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যেতে হয়।
একটা সময়ে ওয়ানডেতে কম উইকেট হারানো, নেট রান রেট এবং এরকম অনেক নিয়মে জয়ী বা পরাজিত নির্ধারণ করা হতো। এখনকার ডাকওয়ার্থ লুইস মেথড ও অনেক সময় একটি দলের প্রতি অনাবশ্যক সুবিধা দিয়ে থাকে এটা অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তাহলে বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে সবার এরকম এক পেশে মতামতের কারণ কি?
২.
কেন উইলিয়ামসন এইরূপ অদ্ভুত নিয়মের ফলে চ্যাম্পিয়ন না হলেও, তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব প্রশ্নের ভদ্রভাবে উত্তর দিয়েছেন। এটা একটা মহৎ দৃষ্টান্ত হলেও, ক্রিকেটের মতো একটি তথাকথিত ভদ্রলোকের খেলার একটি জাতীয় দলের অধিনায়কের থেকে কি এই আচরণই প্রত্যাশিত নয়?
নাকি আমরা অভদ্রতা এবং ঔদ্ধত্য দেখতে দেখতে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি, যে ভদ্রতা সভ্যতা দেখলেই সেটা আমাদের কাছে অভাবনীয় ভালো কিছু বলে মনে হয়? আমাদের কি কারুর একবার মনে পড়ে না বেন স্টোকস এর প্রায় মহাকাব্যিক ইনিংসটার কথা, যা ইংল্যান্ডকে প্রায় হারা ম্যাচ টাই করতে সাহায্য করেছিল? স্লগ ওভারে নিউজিল্যান্ড এর থেকে ইংল্যান্ড অনেক ভালো বোলিং করেছে, যে কারণে নিউজিল্যান্ড আরো অনেক বেশি রান করার মতো পরিস্থিতি থেকে ২৪১ এ আটকে যায়, আর ইংল্যান্ড একটা সময় নিশ্চিত হারের দোরগোড়া থেকে টাই করে ফেলে এবং ভুলে যাওয়া উচিত নয়, শেষ দু বলে দুটো রান আউট না হলে ইংল্যান্ড ক্রিকেটীয় নিয়মেই হয়তো ৫০ ওভারে ম্যাচটা জিততো।
নির্মোহ ভাবে যদি ম্যাচ টি আবার দেখেন, কেন উইলিয়ামসনের প্রতি আবেগ সরিয়ে রেখে, দেখবেন ইংল্যান্ড ওই ম্যাচে জেতার বেশি সুযোগ তৈরী করেছিল, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বেশি ভালো খেলেছিল এবং বেশিরভাগ সময়ে ইংল্যান্ড ই জিততে পারে বলে মনে হয়েছিল। বিশেষ করে বেন স্টোকস এর ইনিংসটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা না হওয়া আমাকে সত্যিই অবাক করেছে।
৩.
উইলিয়ামসন ভদ্র মানুষ, আজকের দিনে হয়তো সেটা একটা বিরল প্রজাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তার শ্মশ্রুগুমফসমন্বিত যিশুখ্রিস্ট সদৃশ চেহারাও হয়তো তাঁর প্রতি ভক্তিভাব জাগ্রত করার আরেকটা কারণ, কিন্তু আজকের দিনেও, গোটা পৃথিবীতে ভদ্র মানুষ, ভদ্র ক্রিকেটের, ভদ্র ক্যাপ্টেন কি এতটাই বিরল? আমাদের ক্যাপ্টেন বাদেও আরো অধিনায়ক বা ক্রিকেটার আছেন বা কিছুদিন আগেও ছিলেন।
গ্রায়েম স্মিথ, অ্যালিস্টেয়ার কুক, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, হাশিম আমলা, এরা কি মাঠে বা মাঠের বাইরে অভদ্রতা করতেন? কিন্তু ক্রিকেটের বাইরে এদের নিয়ে তেমন আলোচনা দেখি না, যে এরা ভদ্র ছিলেন, সৎ ছিলেন ইত্যাদি। আমার এখানেই হালকা আপত্তি যে মানুষ উইলয়ামসন এবং তার ভদ্রতা, সৌজন্য, বিনয় ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করতে করতে আমরা হয়তো তার ক্রিকেটীয় দিকটা কমই গুরুত্ব দিচ্ছি। আর যদি সেটাই বিচার্য হয়, তাহলে অন্যেরা নয় কেন? এই মাপকাঠিতেই অন্যান্য ক্রিকেটারদের নিয়েও আলোচনা হোক তাহলে?