ভারতকে বলা হয় স্পিনারদের স্বর্গরাজ্য। এক সময় ভারত বিদেশের মাটিতে নাকাল হয়ে ফিরে ঘরের মাঠে স্পিনারদের স্বর্গরাজ্য বানিয়ে জয়ের ধারায় ফিরতো। তবে কপিল দেবের আগমণের পর খানিকটা বদলে যায় সে দৃশ্য। শুরুর দিনগুলোতে নতুন বলে তাঁর সাথে জুটি বাঁধতেন কারসান ঘারভি। দুজনে মিলে ত্রিশের দশকের মোহাম্মদ নিসার এবং অমর সিং জুটিকে স্মরণ করিয়েছেন বারবার। তবে কপিল যত এগিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের মহীরুহ হওয়ার পথে, কারসন ঘাউড়ি যেন ততই হারিয়ে গেছেন বিস্তৃতির আড়ালে।
কারসন ঘাউড়িকে বলা হয় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক ক্রিকেটার। লম্বা রানআপে মিডিয়াম পেস ডেলিভারিতে দারুণ সুইং করানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর। এমনকি বল পুরনো হওয়ার পরও ছোট রানআপে দারুণ গতিতে বাঁহাতি স্পিন করাতে জানতেন তিনি। এছাড়া মিডল অর্ডারে নেমে বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ম্যাচের গতি প্রকৃতি বদলে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।
ভারতের ইতিহাসে মাত্র ছয় জন পেসার টেস্টে ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করতে পেরেছেন, ঘারভি তাঁদের একজন। যদিও ৩৩.৫৪ গড়ে ১০৯ উইকেট খুব আহামরি শোনাচ্ছে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে ঘারভিকে বেশিরভাগ সময়েই বল করতে হয়েছে ভারতের স্লো পিচে। তাঁর দারুণ গতির বাউন্সার বেশ ভীতির কারণ ছিল ব্যাটসম্যানদের কাছে। একবার তো ঘরোয়া ক্রিকেটের এক ম্যাচ শেষে দিলীপ ভেংসরকার সোজা ঘারভির পায়ে স্পর্শ করেন এবং বলেন ঘাউড়ি যেন তাঁকে আর বাউন্সার না মারেন।
ব্যাটসম্যান হিসেবে বেশ আক্রমণাত্নক ছিলেন ঘাউড়ি। ২১.২৩ গড়ে টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ৯১৩ রান। বেশিরভাগ সময়েই দ্রুত রান তুলতে গিয়ে আউট হয়ে গিয়েছেন এই তারকা। অন্যথায় তাঁর রানসংখ্যা দুই হাজার ছাড়ালেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকতো না।
অথচ একপ্রকার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই ক্রিকেটের নেশায় মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান কারসন ঘাউড়ি। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত ভালো খেলার সুবাদেই ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে অভিষেক ঘটে তাঁর। তখনো ভারতে পেস বোলার নিয়নিত খেলানোর সংস্কৃতি চালু হয়নি, অনেক সময় দেখা যেতো সুনীল গাভাস্কার প্রথম দিকে বল করে বলের উজ্জ্বলতা নষ্ট করে ফেলেছেন।
সিরিজের প্রথম দুই টেস্ট হারের পর কলকাতায় তৃতীয় টেস্টে অভিষেক ঘটে তাঁর। অধিনায়ক টাইগার পতৌদি দুই পেস বোলিং অলরাউন্ডার মদল লাল এবংকারসন ঘাউড়িকে একত্রে খেলান। তাঁদের দুর্দান্ত শুরুর উপর ভর করে পরবর্তীতে ভারতকে জয় এনে দেন স্পিনাররা। মাদ্রাসে পরের টেস্টেও ঘারভিতে ভর করে জয় তুলে নেয় স্বাগতিকরা।
এবারে বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটে হাতে ৩৫ রানের ইনিংস খেলে দুই দলের মাঝে ব্যবধান গড়ে দেন এই অলরাউন্ডারই। মুম্বাইতে শেষ টেস্টে মদল লাল না খেলায় একনাথ সোলকারের সাথে নতুন বলে জুটি গড়েন ঘারভি। সেই ম্যাচে ৩৫ ওভার বল করে চার উইকেট তুলে নেন তিনি।
টিম ম্যানেজমেন্ট দারুণ খুশি ছিল তরুণ এই অলরাউন্ডারের পারফরম্যান্সে। কিন্তু ক্যারিয়ারের মোড় বদলের সময়টাতেই ইনজুরির শিকার হয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে যান এই তারকা। ইনজুরি থেকে ফেরার পর পুরনো ছন্দটা ফিরে পাননি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের পাশাপাশি বিশ্বকাপেও গড়পড়তা মানের পারফরম্যান্স করেন। যদিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে তুলে নেন ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট।
তবে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরের দলে ঘারভি ছিলেন অটো চয়েজ। সেই সফরের তিন টেস্টে ১১ উইকেট শিকার করেন এই তারকা। তাঁর একের পর এক বাউন্সারে অজি ব্যাটাররা ভালোই কুপোকাত হয়েছিলেন। এছাড়া সিডনিতে ব্যাট হাতে ৬৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন এই তারকা। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স দেখান ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে।
ভারত ছয় ম্যাচের সিরিজ ১-০ ব্যবধানে জিতলেও কারসন ঘাউড়ি ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। কপিল দেবকে সাথে নিয়ে দারুণ এক বোলিং জুটি গড়ে তুলেন, ২৩.৪৮ গড়ে শিকার করেন ২৭ উইকেট। যদিও ১৯৭৯ বিশ্বকাপে খুব একটা ভালো করতে পারেননি তিনি। ভারতও কাটায় তাঁদের ইতিহাসের খুব সম্ভবত সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ।
এই সময়টাতে বল হাতে পারফর্ম না করলেও ঠিকই হেসেছে কারসন ঘাউড়ির ব্যাট। মুম্বাইতে অজিদের বিপক্ষে ১২ চার এবং তিন ছক্কায় তাঁর ৯৯ বলে ৮৬ রানের ইনিংসের গল্প আজো শোনা যায় ক্রিকেটপ্রেমীদের আড্ডায়। এছাড়া পাকিস্তানের বিপক্ষে কানপুরে ৬৫ রানে আট উইকেট হারিয়ে ভারত যখন ধুঁকছে, তখন অপরাজিত ৪৫ রানের ইনিংস খেলে দলকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন তিনি। তাঁর এই দুরন্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে জায়গা করে নেন অস্ট্রেলিয়াগামী ভারত দলে।
সিডনিতে সফরকারীরা ইনিংস ব্যবধানে হারলেও ঘারভি ঠিকই পাঁচ উইকেট তুলে নেন। পাশাপাশি নবম উইকেট জুটিতে সৈয়দ কিরমানিকে নিয়ে ৫৭ রানের জুটি গড়েন। অ্যাডিলেডে দ্বিতীয় টেস্টেও শেষ উইকেট জুটিতে প্রায় আধা ঘন্টা ব্যাট করে জয়ের সমান ড্র এনে দেন দলকে। মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টেও দারুণ এক স্পেলে হতবিহবল করে দেন অজি ব্যাটিং লাইনআপ।
অজিদের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল মাত্র ১৪৩ রান। কপিল দেবের ইনজুরির কারণে সন্দ্বীপ পাতিলের সাথে জুটি বেঁধে বোলিং শুরু করেন তিনি। এগারো রানে দুই উইকেট হারানোর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্বাগতিকরা। শেষ দিনে কপিল ফিরলে মাত্র ৮৩ রানে গুটিয়ে যায় অজিরা, ভারত জিতে নেয় ঐতিহাসিক এক টেস্ট।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এরপর মাত্র একটি টেস্টে মাঠে নামেন ঘাউড়ি। তাঁর বদলে একাদশে জায়গা দেয় হয় যোগরাজ সিং এবং রজার বিনিকে। দ্বিতীয় টেস্টে কিউইদের বিপক্ষে দলে ফেরত আসলেও শিকার করেন মাত্র এক উইকেট। জয়ের নেশায় মরিয়া অধিনায়ক গাভাস্কার পরের টেস্টে তিন স্পিনার নিয়ে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিলে কপাল পোড়ে কারসন ঘাউড়ির। আর কখনোই জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামা হয়নি তাঁর।
কপিল দেব অবশ্য একবার জানিয়েছিলেন ফিটনেস জনিত সমস্যা ছিল ঘাউড়ির। ক্রিকেটার হিসেবে অনেক উঁচু মানের হলেও ফিল্ডিং এবং ফিটনেস নিয়ে কখনোই কাজ করতে চাইতেন না তিনি। তাছাড়া ট্রেনিংয়ে আসার ব্যাপারেও অনীহা ছিল এই অলরাউন্ডারের।
মাঠ ছাড়লেও অবশ্য ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন ঘাউড়ি। চন্দ্রকান্ত পন্ডিতের বিদায়ের পর মুম্বাইয়ের কোচের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর অবশ্য বোর্ডের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে সেই দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন।