সভ্যতার আদি লগ্ন থেকে যাকে তুমি সভ্যতা বলে মেনে এসেছো, সেটাই কি সভ্যতা? নাকি যাকে তুমি ধারণ করেছো কিন্তু যারা তোমাকে সেই আদি লগ্নে বরণ করেনি, সেটাই আসলে সভ্যতা? এর উত্তর বোধহয় তোমার কাছেই লুকিয়ে ছিল,তুমিই দিয়েছো সে উত্তর – বুঝিয়ে দিয়েছো কি সেই সভ্যতা।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বেঁচে থাকলে তাই নির্ঘাত প্রশ্ন তুলতেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ১৯৯১ থেকে ২০১২ সুদীর্ঘ একুশ বছর বঞ্চনা, উপেক্ষার তাপে পুড়তে পুড়তে জ্বলে ওঠা মানুষটা কোনোদিনই সেই ‘সভ্যতা’র সাথে আপোষ করেননি, সেই সভ্যতাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কখনো তাঁর অস্ত্র হয়ে উঠেছে উইলো কাঠের একটা ব্যাট, কখনো কোকাবুরা বল আবার কখনো বা তাঁর ধুরন্ধর ক্রিকেট মস্তিস্ক।
লড়াই, জেদ, সাহস, দৃঢ়তা এই শব্দগুলো একটা কোলাজ তৈরী করে সমার্থক হয়ে উঠেছিল কলকাতার বেহালায় বীরেন রায় রোডের গাঙ্গুলি বাড়ির ছোট ছেলেটার প্রতিটা কর্মকান্ডে। যাঁর লড়াই, জেদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল তাঁর ইস্পাতকঠিন মানসিকতা টাও। যে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে গেছেন তিনি প্রায় দেড় যুগের বেশি ধরে, তার সঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক হার না মানা মানসিকতা, বঞ্চনা-উপেক্ষার মধ্যে দিয়ে, হাজার ভাঙা-গড়ার মধ্যে দিয়ে মাথাটা উঁচু করে বারবার লড়ে যাওয়ার এক ক্রিকেট সভ্যতা।
হ্যাঁ, তিনিই সে সভ্যতার কারিগর সৌরভ চণ্ডিদাস গাঙ্গুলি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাড়ে আঠেরো হাজার রানের ইমারত, দুই ধরণের ক্রিকেটেই ব্যাট হাতে চল্লিশের বেশি গড়, আটত্রিশ টা আন্তর্জাতিক শতরান, ১৩২ টা উইকেট শিকার, ১৭১ টা ক্যাচ, অধিনায়ক হিসেবে ২১টা টেস্ট আর ৭৬টা একদিনের ম্যাচে জয়ের এই শুকনো পরিসংখ্যান দিয়ে যাকে মাপা যায়না। কাব্যে বারবার উপেক্ষিত থেকেও লুকানো সব কবিতা ঠাসা খাতা যাঁর শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, স্বাধীনোত্তর বাঙালিকে আবার সাহসী হতে শেখায়, তিনিই সৌরভ গাঙ্গুলি।
ছোটবেলার প্রেম ছিল তাঁর ফুটবল, ময়দানি তারকা মজিদ বাসকার তাঁকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। কিন্তু ঐ যে বলে প্রথম প্রেম দীর্ঘস্থায়ী হয়না, আপন দাদার ক্রিকেট কিট্স্ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে প্রেমের চরিত্র বদলালো, কিন্তু তাঁর প্রেমের সংজ্ঞা বদলালো না। ভিভ রিচার্ডস, ডেভিড গাওয়ার, কপিল দেবদের দুচোখ ভোরে দেখতে দেখতে ব্যাটবলের ওপর প্রেম তীব্রতা পেলো।
দুখিরাম কোচিং সেন্টার থেকে ধীরে ধীরে ফুলের কুঁড়ি ফুটতে লাগলো,পরে তা আরো খানিক প্রস্ফুটিত হলো কৈলাস ঘাটানির স্টার ক্রিকেট দলের হয়ে বিলেত যাত্রায়। সৌরভের মোহময় সুবাসে তখন ধীরে ধীরে আবিষ্ট হচ্ছে কলকাতা ময়দানও। বাইশ গজের প্রথম বড়ো লড়াই রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে নন্দনকানন ইডেনের বুকে ২২টা রান দিয়ে শুরু হলেও ওটুকুই জাত চেনানোর জন্য ছিল যথেষ্ট। ঘরোয়া ক্রিকেটে রঞ্জি ট্রফিতে ৩৯৪ রান আর ১৪ টা উইকেট, ১৯ বছরের এক বাঙালিকে ভারতীয় দলের হয়ে ১৯৯১-এর অস্ট্রেলিয়া সফরে সুযোগ করে দিলো।
তো সেই ডনের দেশে প্রায় ঘুরতে নিয়ে গিয়ে মাত্র একটা একদিনের ম্যাচ খেলিয়ে, তাঁর নাকি ‘মহারাজকীয় হাবভাব’, তিনি নাকি ‘জল বইতে চান না’, এমন সব নানা অপবাদ দিয়ে ক্যারিয়ারের বারোটা বাজানোর চেষ্টা, মানে অ‘সভ্যতা’র শুরু তখন থেকেই। কিন্তু দমানো যায়নি তাঁকে, হাতের ব্যাট তাঁর হয়ে উঠছিলো অপমানের জবাব দেওয়ার জন্য জ্বলন্ত তরবারি। তা সত্ত্বেও নানা অছিলায় চার বছর ভারতীয় দলের অন্দরমহলে জায়গা হলো না তাঁর।
নাহ, আবারো দমানো যায়নি এই দামাল ছেলেকে, ইংল্যান্ডের মাইনর কাউন্টি ব্রুন্ডসবেরি তে খেলতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানী মাইক স্টুয়ার্টের পরামর্শ আর পরে কোচ দেবু মিত্রের ব্যাটিং পরামর্শ টনিকের মত কাজ করলো। ঘরোয়া ক্রিকেটে কখনো রঞ্জি ট্রফি, কখনো দুলীপ ট্রফি আবার কখনো বা ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে রানের ফোয়ারা ছোটানো বাংলার ব্যাটসম্যানটির জন্য ১৯৯৬-এর ইংল্যান্ড সফরের আগে ভারতীয় দল নির্বাচনে আঁটঘাট বেঁধে নেমেছিলেন পূর্বাঞ্চলের সম্বরণ ব্যানার্জি।
দল নির্বাচনে বাকি দের অনেক ওজর আপত্তি সত্ত্বেও ইংল্যান্ডের বিমানে ওঠার টিকিট পাকা করলেন সৌরভ। চারপাশে শুরু হলো সমালোচনা, বলা হলো ‘কলকাত্তা কা রসগুল্লা’ বা ‘কোটা’ সিস্টেমে ইংল্যান্ডে বেড়াতে যাচ্ছেন সৌরভ নামের একটি ছেলে। অ‘সভ্যতা’র নমুনা আরেকরকম আর কি, প্রথম থেকেই এক তরুনের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টা, দলেও সেইসময় সেভাবে পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কিন্ত নাহ, আবারো বাঙালির কলজের জোরটা বিলেতের বুকে উঠে এলো, লর্ডসের মাটিতে জীবনের প্রথম টেস্টেই ঝকঝকে ১৩১ করে জানিয়ে দিলো সে থাকতেই এসেছে।
ডমিনিক কর্ক, অ্যালেন মুলালি, ক্রিস লুইসদের বল গুলো তার ব্যাট নামক তরবারির মাঝখানে লেগে বাধ্য ছাত্রের মতো সবুজ গালিচা দিয়ে বাউন্ডারির বাইরে নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল, নটিংহ্যামে নিজের দ্বিতীয় টেস্টেও মণিমাণিক্য ছড়ানো ১৩৬ এলো আবার। সেই ইংল্যান্ড সফরে সৌরভের ব্যাটিং যেন লিওনার্দোর তুলির টান, সবুজ গালিচাকে ক্যানভাস করে সৌরভ নামের এক শিল্পী যেন সৃষ্টির খেলায় মেতে উঠছিলেন। দুহাত ভরে দেওয়া সেই বিলেত সফরে সিরিজ সেরা হওয়া আর এরপর একদিনের ক্রিকেটেও দ্রুত জায়গা করে নেওয়ায় আর ফিরে তাকাতে হয়নি সৌরভকে।
বছর খানেকের মধ্যেই ভারতীয় দলের অপরিহার্য হয়ে যায় বাংলার দামাল ছেলেটি।কখনো টরেন্টো তে বল হাতে বা কখনো পদ্মাপাড়ের দেশে স্বাধীনতা কাপে ব্যাট হাতে ভারতীয় দল কে রক্ষা করার তুরুপের তাস হয়ে যান সৌরভ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টানা চার ম্যাচে সেরা হওয়া বা ৩১৪ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানোর মধ্যে তৈরী হয় এমন এক ক্রিকেট সভ্যতা যার রেশ চলেছিল বহু বছর। এ এমন এক সভ্যতা যেখানে পোলক, ডোনাল্ড, ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, ভাস, মুরালি, অ্যামব্রোস, ফ্লিনটফ, বন্ডদের বিরুদ্ধে ছাড়াও খেলতে হত ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি, দেশের ক্রিকেট রাজনীতির সাথেও।
কিন্তু কোনো প্রতিপক্ষই টলাতে পারেনি খেলোয়াড় সৌরভকে, কারণ সৌরভ নামটা শুধু ভারতীয় ব্যাটিংয়ের এক মূলস্তম্ভ ছিল না, ছিল প্রাদেশিকতার ভেদাভেদ টপকে দেশকে সবার আগে তুলে ধরা, সাহস আর লড়াই দিয়ে বিপক্ষ শিবিরে ভয় ধরিয়ে দেওয়া আর নিজের ব্যাটিংকে সিম্ফনির সুরে বেঁধে বিপক্ষ বোলার কে মোহমুগ্ধ করা। হ্যাঁ, এটাই সৌরভ গাঙ্গুলি!
রানীর দেশ ইংল্যান্ডে বরাবরই বাংলার মহারাজ সৌরভ স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন। ১৯৯৯ সালে সেবার বিশ্বকাপটাকে সৌরভ যেন বেছে নিয়েছিলেন এটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য যে বিশ্বের সেরা মঞ্চেও তিনি লাবণ্য ছড়াতেই এসেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৯৭টা রান করেও সমালোচনা শুনতে হলো তিনি নাকি দলের জন্য খেলেননি, শ্লথগতির ব্যাটিং করেছেন। কুচক্রীদের যে সমালোচনা তাঁর ক্রিকেট সভ্যতাকে ধাক্কা দিতে চেয়েছিলো, পরের ম্যাচে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যাটে বলে দুর্ধর্ষ খেলে আর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে টওন্টনে কাউন্টি গ্রাউন্ডে অতিমানবীয় ১৮৩ করে সেই কুচক্রী অ‘সভ্যতা’কে যেন ব্যঙ্গ করে টনটনের টোন নদীর জলে ফেললেন।
শেষমেশ বিশ্বকাপটা সৌরভের দুর্দান্ত যাওয়ার পর বছর খানেকের মধ্যেই বেটিং কেলেঙ্কারি তে যখন জর্জরিত ভারতীয় ক্রিকেট তখনই দেশের হাল ধরার জন্য ডাক পড়লো তাঁর, তার আগেই যদিও শচীনের সহকারী হয়ে গিয়েছিলেন। না, এবার আর কোটার খেলোয়াড় কেউ বলেনি, চারটে বছর বিশ্ব ক্রিকেট কে ছেলেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলো ভারতীয় দলের হাল ধরতে পারার জন্য যদি যোগ্য কেউ হয় তবে এই দামাল বাঙালি ছেলেটাই সে। হ্যাঁ, এবার একদম দলের নেতা হয়ে।
ভারতীয় ক্রিকেট সাম্রাজ্যে এমন এক চক্রব্যূহ তৈরি করে দিলেন সৌরভ ও তাঁর দলবল, যে ক্রিকেট ফিক্সারদের লোলুপ দৃষ্টিও সেই ব্যূহ ভেদ করতে পারেনি। সেই প্রাদেশিকতার বেড়া টপকে জলন্ধর, দিল্লী, এলাহাবাদ, বরোদা, হায়দ্রাবাদ, রাঁচি এসব জায়গা থেকে উঠে এলো হরভজন, জাহির, যুবরাজ, কাইফ, শেবাগ, ধোনি, নেহরা দের মতো কিছু প্রাণশক্তিতে ভরপুর তরতাজা যুবক, পরিচিত হল সৌরভের ব্রিগেড নামে। তারা ছিল অধিনায়কের নিবেদিত প্রাণ, হবে না ই বা কেন, যাদের পিঠে হাত রেখে পাশে থেকে, বা কখনো তাদের জন্য তার অধিনায়ক নিজের সাধের ব্যাটিং পজিশন ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করেননি।
দেশের মাটিতে ঐতিহাসিক রোমহর্ষক টেস্ট সিরিজে থামিয়ে দেওয়া গেল অস্ট্রেলিয়ার অশ্বমেধের ঘোড়া, প্রথমবার সিরিজ জেতা হলো ওয়াঘার ওপারে, ইংল্যান্ডে আর অস্ট্রেলিয়া তে টেস্ট সিরিজ ড্র আর ইংল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয় হল, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে টেস্ট জেতা হল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে একবার রানার্স আর একবার যুগ্মজয়ী ও হলো। সৌরভের ব্যাট ও ফুল ফোটাতে থাকলো, গলে মুরালির স্পিন ছোবল সামলে অনবদ্য ৯৮ রানের সঙ্গী হলো হেডিংলির সবুজ পিচে ইংলিশ সুইং সামলে ১২৮ বা নটিংহ্যামের ৯৯ কখনো বা ডনের দেশে উলুন গাব্বায় অস্ট্রেলিয়ান চিন মিউজিক সামলে প্রকৃত নেতার মত একটা ১৪৪।
আর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যাটিং রেকর্ডের প্রায় বেশীরভাগটা নিজের নামেই খোদাই করে ফেলতে লাগলেন সৌরভ। দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত সব গোলাগুলি সামলে রুদ্ধশ্বাস সব শতরান যেন আরো সুরভিত করলো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিকেই। টাট্টু ঘোড়ার মত চলতে শুরু করা দাদার ব্রিগেড স্বপ্নভঙ্গের রাত ও দেখালো। বিশ্বকাপে প্রথমে ধাক্কা খেয়ে অসাধারণ ভাবে ফিরে এসে বিজয়রথ স্তব্ধ হল ফাইনালে গিয়ে দুর্ধর্ষ অজিদের কাছে। যদিও বিশ্বকাপও সুরভিত হলো সৌরভের তিন শতরানের সুবাসে। যখন তিনি হাল ধরেছিলেন তখন দেশ ৱ্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে, আর যখন অধিনায়কত্ব শেষ হলো তখন বিশ্বের দু নম্বর দল।
হ্যাঁ, অধিনায়কত্ব শেষ হলোর বদলে কেড়ে নেওয়া হলোই বলা যায়, আর তার সাথে এক গোমড়ামুখো মাস্টার এর ষড়যন্ত্রে, নাটকীয় চক্রান্তে দল থেকেও বাদ পড়তে হল, তাও কিনা বিদেশের মাটিতে হিথ স্ট্রিকদের জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে লড়াকু শতরানের পর!! অ’সভ্যতা’র আরেক নমুনা বলা যায়। কিন্তু এই বাঙালি ভদ্রলোক যে অন্য ধাতুতে গড়া। ৩৩-৩৪ বছর বয়সে বাদ পড়ে কারোর যখন ক্রিকেট জীবনই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা তখন শুরু হলো জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকার জন্য এক চূড়ান্ত সংগ্রাম। বারংবার রক্তাক্ত হতে হতেও হাল না ছাড়ার এক রোমাঞ্চকর লড়াই। যেখানে যা সুযোগ পেয়েছেন দুহাত ভরে গ্রহণ করেছেন ভারতীয় দলে ফিরে আসার জন্য।
নিভৃতে ফিটনেস ট্রেনিং করেছেন, গত পাঁচ বছরের ভারত অধিনায়ক হয়েও ইকোনমি ক্লাসের বিমানে চড়ে জামাডোবা, বরোদা, গুয়াহাটির মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, আরো শানিত করে তুলেছেন তাঁর ধনুর্বানকে। আর গোমড়ামুখো গুরুর যুবনীতি যখন প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ছে, গোটা দেশ জুড়ে স্লোগান শুরু হয়েছে ‘ব্রিঙ ব্যাক সৌরভ’, এসময় ভারতীয় দলের অন্দরমহলে ব্রাত্য হতে হতে আবার তিনি ফিরলেন, আর ফিরলেন একদম ছাই চাপা আগুন হয়ে। ফিরলেন না বলে বাদ পড়ার সময়ে তাঁর ঘরোয়া ক্রিকেটে অসাধারণ সব পারফরমেন্স আর দলের দুরাবস্থা তাঁকে ফেরাতে বাধ্য করেছিল বলা যায়। আর কি, সবাই ব্যর্থ যখন আবার হাল ধরো!
ফিরেই জোহানেসবার্গে পোলক, এনটিনি, স্টেইন দের দুর্গে তাঁর ব্যাট থেকেই এলো সর্বাধিক রান। একদিনের ক্রিকেটেও ফিরলেন রাজার মতো, লারাদের বিরুদ্ধে ৯৮ করে। স্বপ্নের ফেরা যাকে বলে!! রানের ফুলঝুরি ছুটতে লাগলো আবার বিশ্বজুড়ে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বিশ্বকাপে ভারত ভগ্নহৃদয়ে ফিরলেও খানিক লড়াই দিয়েছিলেন সৌরভই, টেস্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এলো ২৩৯, নিজের প্ৰিয় ইডেনে সেঞ্চুরি ছিল না এতদিন, সে সাধ ও পূর্ণ হলো শোয়েবদের চূর্ণ করে, মেলবোর্নে খেলা হলো শততম টেস্ট আর ইংল্যান্ডের মাটিতে ৩০০তম একদিনের ম্যাচ।
কামব্যাকের পরের বছর ধরে টেস্টে দলের সর্বাধিক ও একদিনের ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বাধিক রানসংগ্রহকারী তখনো জানেন না তাঁর ক্রিকেট সভ্যতা আরো একবার ধাক্কা খেতে চলেছে! বছরভোর একদিনের ক্রিকেটে রান করেও অস্ট্রেলিয়ার ত্রিদেশীয় সিরিজে বাদ পড়তে হলো তৎকালীন অধিনায়কের ‘যুবনীতি’র জন্য। টেস্টেও আস্তে আস্তে ললাট লিখনটা বোধহয় পড়তে পারছিলেন তিনি, তাই ২০০৮ এ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ শুরু হবার আগের দিন বিদায় জানালেন এই ক্রিকেট বিশ্বকে।
সেদিন ছিল দুর্গাপুজোর অষ্টমী। আর অষ্টমীতেই বাঙালির মনে সেদিন বিসর্জনের বাজনা। যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার মতোই শেষ সিরিজেও উজ্জ্বল তাঁর ব্যাট, অসিনিধন করে আবার শতরান এলো মোহালিতে, এমনকি শেষ টেস্টেও ৮৫ এলো ব্যাট থেকে, কিন্তু শেষ ইনিংসে রূপকথা আর হল না, ফিরতে হলো শূন্য হাতেই।
এরপর আইপিএলের দুনিয়া, যে কর্পোরেট দুনিয়ার ক্রিকেটে শুধুই অর্থের ঝনঝনানি। কলকাতা নাইট রাইডার্স দলের অধিনায়ক হয়ে প্রথম বছরে দলকে শেষ চারে নিয়ে যেতে না পারলেও প্রায় সাড়ে তিনশো রান আর গোটা ছয়েক উইকেট শিকার করে কুড়ি বিশের ধামাকাদার খেলাতেও নিজের জাত কিছুটা চেনাতে ভুল করেননি। কিন্তু তাল কাটলো দ্বিতীয় বছরের লিগেই, কর্পোরেট জগতের মানুষজন সৌরভ আবেগকে পুরোপুরি গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করে আগের বছরের সেরা পারফরমারের হাত থেকে নেতৃত্ব ভার কেড়ে নিয়ে ব্ল্যাকক্যাপ তারকা ম্যাককালামের হাতে তা তুলে দিলেন, সে টুর্নামেন্টে পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়লো দল।
ফলত: পরের বারে আবারো নেতৃত্বের মুকুট উঠলো মহারাজের মাথাতেই। সেবারেও দলের ব্যাটিং, বোলিংয়ের চরম ব্যর্থতার মধ্যে একা লড়ে গেলেন তিনি, প্রায় ৫০০’র কাছাকাছি রান করে লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হয়ে বুঝিয়ে দিলেন এতটুকু মরচে পারেনি তাঁর তরবারিতে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সৌরভীয় সভ্যতা তুমুল ধাক্কা খেলো নিলামে অবিক্রিত থাকায়, দলের সেরা পারফর্মারকে অবলীলায় ছেঁটে ফেলে অ’সভ্যতা’র চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হলো, পরের বছরে পুনের হয়ে আইপিএল খেললেও অসহ্য হয়ে উঠছিলো তাঁর এই উপেক্ষা। নিষ্ঠুর আইপিএলের ঢক্কানিনাদ থেকে তাই সরে আসাকেই শ্রেয় মনে করলেন বাংলার মহারাজ। হাতে তুললেন কমেন্ট্রির মাইক্রোফোনটা, ‘দাদাগিরি’ চলতে থাকল ধারাভাষ্যকক্ষেও।
না, ‘পরাজয়’ শব্দটা তাঁর অভিধানেই নেই..নেই তাঁর প্রচুর আইসিসি ট্রফি, তিনি ক্রিকেটের ঈশ্বর ও নন, তিনি দেওয়াল ও নন, হায়দ্রাবাদি কব্জির মোচড় ও তাঁর নেই। তাঁর যা আছে টা হলো ভ্যান গগের তুলির টানের মত কভার ড্রাইভ, স্পিনার কে বাউন্ডারির বাইরে ‘বাপি বাড়ি যা’ বলে ছুঁড়ে ফেলার সাহস, ব্রেট লির বাউন্সার গায়ে মাথায় লাগার পর ও উঠে দাঁড়িয়ে ‘পরের বল টায় চার মারবো’ ভাবার সাহস বা লর্ডসের ব্যালকনিতে ইংরেজ ঔদ্ধত্য কে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে জার্সি টা বনবন করে ঘোরানোর নিখাদ ভারতীয় ঔদ্ধত্য। তিনিই পারেন বিপক্ষের চোখে চোখ রেখে চলতে, মাইন্ড গেমে বাজিমাতও তিনিই করতে পারেন, স্টিভ ওয়াহর অশ্বমেধের ঘোড়াকে থামিয়ে দিতে পারেন বা নিজের দলের কোনো এক শেবাগ, হরভজন, যুবরাজ দের পিঠে ভরসার হাত রেখে বলতে পারেন ‘চিন্তা করিস না, তুই দলে থাকবি, চাপমুক্ত হয়ে খেল’, বা কোনো এক নবাগত মহেন্দ্র সিং ধোনি কে বলতে পারেন ‘পরের ম্যাচে তুমি তিন নম্বরে আমার জায়গায় নামবে।’
আবার এই লোকটাই পারেন কোনো এক অনিল কুম্বলেকে অস্ট্রেলিয়া সফরে দলে নেওয়ার জন্য নিজের অধিনায়কত্ব কে বাজি রাখতে, তিনিই পারেন অবসর নেওয়ার ভাবনায় থাকা কোনো এক জাভাগাল শ্রীনাথকে বলা ‘বিশ্বকাপে তোমাকে চাই’, কোনো এক হরভজন সিংয়ের জন্য নির্বাচনী বৈঠকে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রাণপাত করতেও তিনিই পারেন, আবার কোনো এক রাহুল দ্রাবিড়কে একদিনের দলে নিয়মিত জায়গা দিতে উইকেটরক্ষক বানিয়ে দিতেও তিনিই পারেন। হ্যাঁ, দেশের জন্য, দলের জন্য সর্বস্ব দিতে তিনিই পারেন।
যিনি যোদ্ধার থেকে কম কিছু নয়, ক্রিকেট মাঠ যাঁর কাছে ছিল যুদ্ধ ক্ষেত্র, আর ব্যাট বলের মাধ্যমে সেই যুদ্ধে তরবারি আর গোলা বারুদ চালানোয় তিনি সেই যুদ্ধের সুদক্ষ সেনাপতি। কখনো কখনো তাঁর কর্ণের রথের চাকা বসে গেছে, কিন্তু আবারো তিনি ফিরে এসেছেন অর্জুনের রূপে। যাঁর জন্য শচীন টেন্ডুলকার বলতে পারেন – সৌরভের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা হলো তাঁর মানসিকতা, ফলে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে তিনি ফিরে আসতে পারেন, যাঁর জন্য রাহুল দ্রাবিড় বলতে পারেন – অফসাইডে সবার আগে ঈশ্বর, তারপরই সৌরভ, যাঁর জন্য তাঁর প্রিয় যুবরাজ বলতে পারেন- এমন অধিনায়কের জন্য মরতেও অসুবিধা নেই।
যাঁর জন্য বিপক্ষ শিবিরের সেনাপতিরাও সমান শ্রদ্ধাশীল, স্টিভ ওয়ার মতো দুর্ধর্ষ অস্ট্রেলিয়ান ও তাই বলতে পারেন- সৌরভ কে পছন্দ না করলেও কিছু যায় আসে না, তাঁকে সম্মান করতেই হবে। যাঁর জন্য একটা ছুটকো আইপিএলের ম্যাচকে কেন্দ্র করে বাঙালী জাতিটাই দুভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারে তিনিই সৌরভ গাঙ্গুলী। যাঁর জন্য ২০০৮ এর নভেম্বরের পর বহু মানুষের কাছে ক্রিকেটটা আর আবেগ নেই, তার চিরকালীন রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ-স্পর্শ শুষে নিয়েছে নাগপুরের মাঠে অখ্যাত জেসন ক্রেজার নিরীহ বলটা।
যাঁর অফুরান গতিশীল মন, আবেগ আর উদ্যমে ভরপুর এক সত্তার সাথে কঠিনতম সব চ্যালেঞ্জ জেতার তাড়না এক অপ্রতিরোধ্য ক্রিকেট সভ্যতার রূপ দিয়েছে, তিনিই সৌরভ গাঙ্গুলি। যাঁর ব্রিসবেনে একটা ১৪৪ দেখার জন্য মানুষ ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখতো, যাঁর ইডেনে সেঞ্চুরি দেখার জন্য লোকে অফিস কামাই করতো, যাঁর হাতে বিশ্বকাপটা দেখতে চেয়ে মানুষ যজ্ঞ করতো, যাঁর নাইরোবিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৪১ দেখার জন্য প্রেমিক তার প্রিয়তমার সাথে ডেটিং ও মিস করতো।
তিনিই সৌরভ গাঙ্গুলি, সেই সযত্নে লালিত এক ক্রিকেট সভ্যতার অধীশ্বর, যাঁর কাছে ‘তোমার চাকরিতে যদি কোনো সমস্যা না থাকে, সেটা কোনো চাকরিই নয়’ এই অমোঘ উক্তি আজও ততটাই দামি, যতটা ছিল তাঁর খেলোয়াড় জীবনে। সেই তিনিই আজকের দেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, যাঁর অফিসঘরে কর্মজীবনের শুরুর দিন ধুলোঝেড়ে সেই পুরোনো ক্যাপ্টেনের ব্লেজারটাই পরে যান। আজও তিনি কোথাও গিয়ে যেন ক্যাপ্টেনই, আমাদের অধিনায়ক, দেশের ক্রিকেট কে পথ দেখানোর অধিনায়ক তিনি আজও। যাঁর ওই ঢলঢলে ক্যাপ্টেনের জোব্বাটা আজও তাঁর কভার ড্রাইভ গুলোর সুরে যেন বলে যায় –
‘মহারাজ ও একি সাজে, এলে হৃদয় পুরো মাঝে!’