খালেদ দ্য নিউ লিডার

ওর আগে খেলেছেন মাত্র তিন টেস্ট। অবশ্য নিজেকে প্রমাণের জন্য তিন টেস্ট নেহায়েৎ কম নয়। কিন্তু বাংলাদেশের তরুন পেসার খালেদ আহমেদ নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। বরং একশোর বেশি গড় আর চার টেস্টে মাত্র দুই উইকেট নিয়ে হয়েছেন হাসির পাত্র।

ক্যারিয়ারের শুরুটাই হতশ্রী পারফরম্যান্সে। যে সম্ভাবনা নিয়ে জাতীয় দলে এসেছিলেন তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি খালেদের বলে। তাই খালেদকে নিয়ে সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদটা একেবারে তলানিতে। খারাপ পারফরম্যান্সের পরই বাদ পড়েন দল থেকে। সমালোচনা, ট্রল এসব নিয়েই শুরু করেন নতুন উদ্যমে।

সুযোগ পেলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। প্রথম টেস্টের একাদশে ডাক পাবার পর খালেদকে নিয়ে আবারও সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। খালেদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তো ছিলই। সাদামাটা শুরুর পর প্রোটিয়াদের ডেরায় তিনি কতটা কার্যকর হবে সে নিয়ে চলছিল আলোচনা-সমালোচনা। প্রথম দিনের প্রথম সেশনে ছন্নছাড়া বোলিংয়ের পর শুধু খালেদই নয় পেসারদের নিয়ে তীব্র সমালোচনা সমর্থকদের। আগের চার টেস্টের পারফরম্যান্সের কারণে খালেদকে নিয়ে সমালোচনাটা একটু বেশিই ছিল। ঠিক কিসের ভিত্তিতে তিনি একাদশে সে নিয়েও ছিল প্রশ্ন।

তবে প্রোটিয়া অধিনায়ক ডিন এলগারকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে ব্রেক থ্রুটা এনে দিয়েছিলেন এই খালেদ। এরপরই পালটে যায় ম্যাচের চিত্র। একের পর এক উইকেট হারিয়ে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে প্রোটিয়ারা। প্রোটিয়াদের হঠাৎ বিপর্যয়ের পেছনেও অবদান খালেদের। ১৮০ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর যখন বাভুমা-ভেরেইনের ব্যাটে পঞ্চম উইকেটে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা! ঠিক তখনি পর পর দুই বলে ভেরেইনে ও উইয়ান মালডারকে ফিরিয়ে প্রোটিয়াদের ব্যাকফুটে ঠেলে দেন খালেদ।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা বন্ধু ইমরান আলির হাত ধরে যখন সিলেটের রান মিয়া অ্যাকাডেমিতে এলেন তখন ছিলেন একজন টেপ টেনিস স্পেশালিষ্ট। বছর কয়েকের মধ্যেই সিলেটের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর সেখানে আরেক বাংলাদেশী পেসার এবাদতের সাথে পরিচয়। দু’জনই পরবর্তীতে ২০১৫-১৬ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পেস বোলিং হান্টে অংশ নেন। সেখানেই পেস আর লাইন-লেন্থের কারণে নজরে আসেন নির্বাচকদের।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) খেললেও সেখানে সেরাটা দিতে পারেননি। তবে ওই মৌসুমে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ১৭ উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন এই পেসার। ২০১৮ সালে বিসিবির হাই পারফরম্যান্স দল, এরপর সেখান থেকে এ দলেও জায়গা করে নেন খালেদ।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে এ দলের হয়ে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর খুলে যায় জাতীয় দলের দরজা। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে প্রথমবারের মতো ডাক পেলেন তিনি। তবে অভিষেকে দেখা পাননি উইকেটের! এরপর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্টেও পেলেন সুযোগ। সেখানেও ছিল হতশ্রী পারফরম্যান্স! এক ইনিংসে ১৪৯ রান দিয়েও ছিলেন উইকেটশূন্য! এরপর বাদ পড়লেন দল থেকে।

প্রায় দুই বছর পর ২০২১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে সুযোগ পেয়ে শিকার করেন মেইডেন টেস্ট উইকেট! প্রথম তিন টেস্টে মাত্র এক উইকেট। হাসাহাসি, ট্রল কিংবা সমালোচনা বেশ স্বাভাবিক। প্রথম তিন টেস্টে প্রায় দেড়শোর কাছাকাছি বোলিং গড়! সাদা পোশাকে টানা দুই টেস্টে সারাদিনজুড়ে বল করেও উইকেট না পেলে সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজটা তাই খালেদের জন্য ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে এখন অবধি সঠিক পথেই আছেন এই পেসার। প্রথম ইনিংসে ৮৪ রানের বিনিময়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ের পথে খালেদের হাত ধরেই প্রোটিয়াদের চাপে ফেলতে পেরেছে বাংলাদেশ। একদিনের ব্যবধানে সমালোচনা ছাপিয়ে প্রোটিয়াদের মাটিতে এই টেস্টে বাংলাদেশের সফল বোলার খালেদ।

অবশ্য এমন প্রত্যাবর্তনটা কিছুদিন আগেই দেখিয়েছিলেন আরেক সিলেটি পেসার এবাদত হোসেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লর্ড, স্যার এসব নামেই ডাকা হত এবাদতকে। ইতিহাসে প্রথমবার নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়ের নায়কটা সেই সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা এবাদতই! পেসার হিসেবে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের হয়ে সেরা স্পেল করে ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছেন দলকে। বন্ধ করেছেন সমালোচকদের মুখ। আপাতত তিনি টেস্টে পেস বোলিংয়ে সবার আস্থা হতে পেরেছেন।

এবাদতের পর প্রত্যাবর্তন এবার খালেদেরও। পেরেছিলেন এবাদত, পারলেন খালেদও। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের পেস বিভাগে উন্নতির ছোঁয়াটা এখন স্পষ্ট। মাউন্ট মঙ্গানুই থেকে ডারবান, এবাদত থেকে খালেদ – বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের পেস বোলারদের দাপট যেন সমর্থকদের জন্য স্বস্তি আর নতুন আশার আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link