আমি কাইল মেয়ার্স, নামটা এখন একটু শোনা শোনা লাগছে তাই তো? আমি নিশ্চিত, আমার নামটা সেভাবে কেউ শোনেননি ২০২১ সালের আগে। আসলে শুনবেনই বা কি করে, শোনার মতো তেমন আহামরি কিছু তো আমি এতকাল করিনি। আমি এখনো কেমন একটা ঘোরের মধ্যেই রয়েছি, জানেন তো?
আসলে চারপাশে সবাই বলছে আমি নাকি এক বিরাট রেকর্ড করে ফেলেছি, টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেকেই দ্বিতীয় ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করেছি প্রথম ক্রিকেটার হিসাবে, তায় আবার চতুর্থ ইনিংসে ৩৯৫ রান তাড়া করতে নেমে।
ম্যাচ জেতার পর থেকে তো অভিনন্দন আসাও শেষ হচ্ছে না, ওদিকে বার্বাডোজে বসে আমার বাবা শারলি ক্লার্ক ও বলছেন সেখানেও দ্বীপের অসংখ্য মানুষ নাকি অভিনন্দন জানিয়েই চলেছেন, বাবা ও নাকি ফোন ধরে ধরে ক্লান্ত। এসব চারপাশে ঘটলে ঘোর লাগবে না বলুন?
ছোটবেলায় বাবা যখন বার্বাডোজে কার্লটন ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে আমায় ভর্তি করিয়ে দিলেন আমি জানি বাবা একটা স্বপ্ন দেখতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেরুন টুপিটা যাতে আমার মাথায় চড়ে, যেন দাপিয়ে খেলতে পারি আমি, ঠিক যেমনটা ডেসমন্ড হেইন্স করেছিলেন, যিনি ওই অ্যাকাডেমির গর্ব। আমি যদিও মজাতেই খেলতাম।
ভালো খেলতে খেলতে রাজ্য দলে সুযোগ পেয়ে গেলাম, কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট কোথাওই তেমন দাগ কাটতে পারছিলাম না, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও (সিপিএল) ম্যাচের পর ম্যাচ বসে কাটিয়েছি ডাগআউটে। ২০১৯ মৌসুমেও এসে অবশেষে নিজেকে মেলে ধরলাম, তখন উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ড এর হয়ে গোটা মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ৬০০-এর ওপর রান করলাম, লিস্ট এ ক্রিকেটেও সেঞ্চুরি এলো, সিপিএলেও ২০০’র ওপর রান করে ফেললাম।
তারপর ২০২০ সালে ইংল্যান্ড সফরে ডাক এলো, খেলার সুযোগ না পেলেও হোল্ডার, চেসদের থেকে শিখলাম অনেককিছু। এরপর বাংলাদেশ সফরে যখন দলের সেরা ক্রিকেটাররা কেউ তেমন আসবেননা বললেন আমার শিকে ছিঁড়লো, একদিনের সিরিজে মেহেদী হাসানের বোলিংয়ের সামনে আমরা তো দাঁড়াতেই পারলাম না, কিন্তু সেদিনের চট্টগ্রাম সত্যিই আমার জীবনটা বোধহয় একটু অন্যরকম করে দিল। সে গল্পটাই একটু বলি।
টেস্টের চতুর্থ দিন থেকেই শুনছিলাম বাংলাদেশ জিতে যাবে, আমরা একদম আত্মসমর্পণ করবো, এইসব নিয়ে ম্যাচ রিপোর্ট, ভেতরে ভেতরে আগুনটা তখন থেকেই জমছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে বিশাল স্কোরের সামনে ব্যাট করতে নেমে আমাদের দ্রুত তিন উইকেট পড়েও গেল, আমি ব্যাট করতে নামার সময় যদিও ঠিক করেছিলাম দিনের শেষ বল পর্যন্ত লড়বো, আমার মনের ভাবটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো আমার আগে নামা বোনার।
দু’জনে মিলে ঠিক করলাম আজ যা থাকে কপালে, লড়ে যাবো। অনেকে আমার এই লড়ার শক্তি বা মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলছেন, এটা আসলে আমি পেয়েছি একটা ঘটনা থেকে সেটা আগে বলে নি। সেবার একটা ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দিতে ডোমিনিকাতে গিয়েছি, আর হ্যারিকেন মারিয়ার কবলে পড়লাম, উফফ!
সে এক মারাত্মক অবস্থা, এর মধ্যে যেখানে ছিলাম সেখানে মাথার ওপরে ছাদটাও ভেঙ্গে পড়ল, কিভাবে যে বেঁচে গেলাম সেদিন জানিনা, তবে কয়েকদিন খাবার ও জল কিচ্ছু পাইনি, তারমধ্যে বন্যার কবলেও পড়লাম। এরকম অসহনীয় অবস্থা থেকে বেঁচে ফেরা সত্যি বলতে জীবনে চলার পথে অনেক অনেক মানসিক জোর দিয়েছিলো সেবার।
তা যেকথা বলছিলাম, আমি আর বোনার মিলে সেদিন ২০০র বেশি রানের পার্টনারশিপ করে ফেললাম, বোনার তো দুর্দান্ত খেললো, সেঞ্চুরিটা পেলো না বেচারা, ও আউট হবার সময় ও অনেক রান বাকি তখন, ব্ল্যাকউড বরাবর ভালো চেস করে, সেদিন পারলো না।
এরপর জোশুয়া নামলো, ওর মুখ দেখেই মনে হলো খুব আত্মবিশ্বাসি, দুজনে মিলে খোলা মনে দিব্বি ব্যাট করছিলাম, ওভারের শেষে জোশুয়া এমনিতেই মজার মজার সব কথা বলছিল, তখন মাথার ওপর পাহাড় প্রমাণ রানটা আর রানই মনে হচ্ছিলো না। জোশুয়া আউট হবার পরেও নিশ্চিত ছিলাম ম্যাচ আমি জেতাবোই।
ওদের তাইজুল আর মেহেদী দুদিক থেকে চেপে ধরছিল ক্রমশ, কিন্তু পারেনি, আসলে সেদিনটা আমাদেরই ছিল, আর ওদের অধিনায়ক মুমিনুলকে দেখে মনে হচ্ছিলো সাকিবকে খুব মিস করছে ওরা। তাও এশিয়ার মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে এতো রান তাড়া করলাম আমরা সেটাতো মুখের কথা নয়, বলুন!
আমাদের কিংবদন্তি ব্রায়ান লারার শৌর্য কিংবা গেইলের মত ব্যাট হাতে ধ্বংসলীলা চালানোর মানুষ কিন্তু আমি নই, আমি শুধু লড়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখি। আমি এখনো অখ্যাত এক ক্রিকেটারই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যদি ধারাবাহিক না হই দুদিন বাদেই লোকে আবার ভুলে যাবে আমায়।
সিনিয়র ক্রিকেটাররা ফিরলে আবার হয়ত জায়গা পাওয়া নিয়ে টানাটানিও হবে আমার। কিন্তু আমি লড়ে যাবো, যেভাবে লড়ে গিয়েছিলাম হ্যারিকেন মারিয়ার কবলে পড়ার সময়ে কিংবা কদিন আগের চট্টগ্রামে। লড়তে লড়তেই মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে চাই আর বলতে চাই, – আই অ্যাম কাইল মেয়ার্স, রিমেম্বার দ্য নেম!