জনবহুল দেশের পদকশূন্যতা

জনসংখ্যার দিক থেকে অতি ছোট দেশ বুরকিনা ফাসো। বাংলাদেশের মানুষের কাছে অপরিচিত হলেও ঢাকার ফুটবলের খবরাখবর যারা একটু আধটু রাখেন তাদের কাছে নামটা বেশ পরিচিত। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা ডিফেন্ডার মুনজির কুলদিয়াতি ছোট এই দেশটির ফুটবলার।

যে দেশটি আয়তন কিংবা জনসংখ্যা কোন দিক থেকেই বাংলাদেশের ধারে কাছেও নেই। সেই দেশটিই কিনা এবার টোকিও অলিম্পিকে প্রথম পদক জয় করেছে! ছেলেদের ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ জিতেছেন দেশটির হিউজেস ফাব্রিস জাঙ্গো। এছাড়া রাজধানী ঢাকা কিংবা অন্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় ’অতি’ ক্ষুদ্রাকৃতির দেশ বারমুডা ও সান মেরোনোও এবার পদক জিতেছে।

সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান তলানীতে বললেও ভুল বলা হবে। কারণ এখন পর্যন্ত এবারের আর্চারি ডিসিপ্লিন বাদ দিলে বাকিদের অবস্থান ছিল বাছাইপর্বের মধ্যে আসা-যাওয়া করা। এবার শুধুমাত্র রিকার্ভ একক ও মিক্সড ইভেন্টে বাছাইপর্বের গন্ডি পেরিয়ে মূল পর্বে খেলতে পেরেছেন বাংলাদেশের দুই খেলোয়াড় রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। তাদেরকে নিয়েই ভবিষ্যতের জন্য আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তিন বছর পর কি পরিস্থিতি সেটি তো আর এখনই বলা যাচ্ছেনা। যা বাংলাদেশের জন্য হতাশারও হতে পারে।

তবে যখন রোমান সানা ২০২৮ সালে স্বর্নপদক জয়ের কথা বলেন তখন অনেকেই অট্টহাসি দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ যেখানে বাছাইপর্বের গন্ডি পার হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর সেখানে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখাটা বড়বেশি বাড়াবাড়ি হতে পারে। চারবছর পর পর অলিম্পিক গেমস আসে আর সেখানে অংশগ্রহনেই সীমাবদ্ধ রয়েছে লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। বেশিরভাগই হিটে বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এটি যেমন অলিম্পিকে ঠিক তেমনি এশিয়ান গেমস ও কমনওয়েলথ গেমসেও।

সেখানে ভবিষ্যতে আদৌ পদক জয়ের কোন সম্ভাবনা রয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়। তবে প্রথমবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখা রোমান-দিয়াই স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তবে সেটি বুরকিনা ফাসো, বারমুডা কিংবা সান মেরোনোর মতো করে হতে পারাটা যে দূরের বাতিঘর। ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণাদায়ীও হতে পারে তাদের দুজনের পারফরম্যান্স। সেখানে আবার রয়েছে মাত্র এক পয়েন্টেরও হতাশা। সেটি অলিম্পিকে আর্চারীর রিকার্ভ এককের দ্বিতীয় রাউন্ডে কানাডার ক্রিসপিন ডুয়েনাসের কাছে হেরে যান দেশসেরা আর্চার রোমান। হারে যতটা না আক্ষেপ, তার চেয়ে বেশি আক্ষেপ একটি পয়েন্টের জন্য।

বিষয়টি অনেকটাই সাফল্যের খুব কাছ থেকে ফিরে আসার মতো ব্যপার। অথচ দারুণ শুরু করেও শেষ সেটে এক পয়েন্টের কারণে হার মেনে নিতে হয় রোমানকে। এই এক পয়েন্টের ব্যবধান হয়তো লম্বা সময় ধরে পোড়াবে খুলনার এই তীরন্দাজকে। রোমানের বিদায়ের পরপরই যেন বাংলাদেশের আশার প্রদীপই ধপ করে নিভে গেল। প্রথমবারের মতো অলিম্পিক গেমসে পদক জয়ের স্বপ্ন তো তাকে ঘিরেই দেখছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডেই সে স্বপ্নের সমাধী হয়ে গেল!

অন্যদিকে দিয়া সিদ্দিকীরও ফিরেছেন বাছাইপর্বের গন্ডি পার হওয়ার পর। বাকিদের মধ্যে শুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি, সাতারে আরিফুল ইসলাম ও জুনাইনা আহমেদ ও অ্যাথলেটিক্সে জহির রায়হান ফিরেছেন হতাশ করে। কারণ সবাই থেমে গেছেন বাছাইপর্বের বেড়াতে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত ৪৯ জন অ্যাথলেট ১০টি অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। গ্রীষ্ম কিংবা শীতকালীন কোন আসর থেকেই এখনো পর্যন্ত পদক জয়ের মতো সম্ভাবনাও তৈরি করা যায়নি। রোমান-দিয়ার আগে বাংলাদেশী অ্যাথলেটদের মধ্যে সেরা পারফরম্যান্স করেছিলেন সিদ্দিকুর রহমানের। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে চূড়ান্ত বাছাই পর্বে ৬০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ৫৫তম স্থান অর্জন করেছিলেন তিনি।

২০১২ সালে জিমন্যাট কাজী সায়িক সিজার পুরুষদের প্যারালাল বারে ৭১ জনের মধ্যে ২৭তম স্থান দখল করেন। একই আসরে এয়ার রাইফেল শুটিংয়ে শারমিন আক্তার রত্না ৫৬ জনের মধ্যে ২৭তম হয়েছিলেন। এদের মধ্যে সিদ্দিকুর রহমান কেবল চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পেরেছিলেন। সিদ্দিক-রোমান ছাড়া বাকি ৪৭ জন প্রতিযোগীর সবাই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির বদান্যতায় ওয়াইল্ড কার্ডের কল্যানে অলিম্পিকে খেলতে পেরেছিলেন।

অংশগ্রহনের আগে প্রতিবারই আশার বেলুন ফোলানো হয়, কিন্তু কোনোবারই পদক ছুঁয়ে দেখা হয় না। অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ ৭২টি দেশের মধ্যে একটি দেশ, যারা কখনও কোনো অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। সর্বাধিক জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে সবার উপরে, যারা কখনও অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। ফিলিপাইন এবং বারমুডাও দীর্ঘসময় ছিল এই তালিকায়। কিন্তু এই টোকিও অলিম্পিকে এই দুই দেশই স্বর্ণ পদক জিতেছে।

এদিকে আবার কম্বোডিয়া দ্বিতীয় জনবহুল দেশ, যারা কখনও অলিম্পিক পদক জিততে পারেনি। দেশটির জনসংখ্যা ১ কোটি ৫৭ লাখ, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসাবে ১০ ভাগের এক ভাগ। বাহরাইন, বার্বাডোস, বারমুডা, বোতসোয়ানা, বুরুন্ডিসহ আরও অনেক দেশ রয়েছে, যারা অন্তত একটি করে পদক জিতেছে। কিন্তু সেখানে এখনো পর্যন্ত নাম ওঠাতে পারেনি লাল সবুজ প্রতিনিধিত্ব করা খেলোয়াড়রা। সে কারণেই বাংলাদেশের অলিম্পিক যাত্রার গল্প এদের চেয়েও বেশি হতাশার।

এখনো অংশগ্রহনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ক্রীড়াবিদদের পথচলা। টোকিওতে সবচেয়ে ছোট দেশ হিসেবে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতেছে বারমুডা। ফ্লোরা ডাফি অনন্য এই অর্জনে দেশিটিকে নিয়ে যান। ৩৩ বছর বয়সি ডাফি প্রমীলা ট্রায়ালথনে (সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড়) স্বর্ণপদক জয় করেন। অথচ বারমুডার জনসংখ্যা মাত্র ৬৩ হাজার আর আয়তন মাত্র ২০.৫ বর্গমাইল! সবচেয়ে ছোট দেশ বা অঞ্চল হিসেবে অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ের রেকর্ড এখন ক্রিকেটে একসময় বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্ধী দেশটির দখলে।

ফ্লোরা ডাফি প্রায় এক মাইল উন্মুক্ত পানিতে সাঁতার কেটে, ২৫ মাইল সাইক্লিং করে এবং ৪.৬ মাইল দৌড়ে জয়ী হয়ে এই সম্মান নিজের করে নিলেন। ডাফিসহ মাত্র দুজন বারমুডিয়ান টোকিও অলিম্পিকে অংশ নিয়েছেন। আটলান্টিক মহাসাগরের ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর দূরত্বও ৬০০ মাইল। এর আগে অলিম্পিকে বারমুডার একমাত্র পদকটি ১৯৭৬ সালেপুরুষদের হেভিওয়েট বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জ জেতার মাধ্যমে। বারমুডা ছাড়াও মাত্র ৩৪ হাজার জনসংখ্যার দেশ পেরিলির হাত ধরে সান মেরোনো তৈরি করে নতুন এক ইতিহাস।

ইউরোপের ছোট্ট এই দেশটির জনসংখ্যা যেখানে মাত্র ৩৩ হাজার ৮৬০ আর আয়তন ২৪ হাজার বর্গমাইল। এই দেশটিই টোকিও অলিম্পিকে ইতিহাস গড়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। দেশটির ৩৩ বছর বয়সী শুটার আলেহান্দ্রা পেরিলি নারী ট্র্যাপ ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছেন। অলিম্পিকে সান মেরোনো নামের দেশটির এটিই প্রথম পদক জয়। সবচেয়ে কম জনসংখ্যার দেশ হিসেবে অলিম্পিক পদক জেতার রেকর্ডটি এতদিন ছিল লিচেনস্টেইনের দখলে।

দেশটি ১০টা অলিম্পিক পদক জয় করেছে। আয়তনের দিক থেকে যদিও রেকর্ডটি বারমুডার দখলে। এবারের টোকিও অলিম্পিকে সান মারিনোর পাঁচজন অংশগ্রহন করেছেন। এদিকে বুরকিনা ফাসোর হয়ে প্রথম পদক জিতেছেন হিউজেস ফাব্রিস জাঙ্গো। ছেলেদের ট্রিপল জাম্পে ব্রোঞ্জ জিতে দেশটির ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক পদক জিতেছেন। কিন্তু সেখানে উঠছেনা বাংলাদেশের নাম, কবে উঠবে সেটিও বলা যাচ্ছেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link