ক্রিকেট খেলা দেখছি কমদিন হল না। একদিকে বেশ কিছু অসাধারণ পারফর্মেন্স দেখেছি, দেখে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠেছি, তেমনই অন্যদিকে দু:খজনক মুহূর্তও স্মৃতিতে জমা রয়েছে বেশ কিছু। দু:খজনক মুহূর্তের প্রায় সবক’টার সঙ্গেই ভারত জড়িয়ে রয়েছে – মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কা, কপিলের ওভারে ইমরানের ১৯ রান নেওয়া, ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ সালের সেমিফাইনালে পরাজয়, ইত্যাদি। তবে, এই সবকিছু ছাপিয়ে একটা দৃশ্য মনে রয়ে গেছে – ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল শেষ হওয়ার পরের দৃশ্য।
মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ছেন ল্যান্স ক্লুজনার। চার বলে এক রান প্রয়োজন – এই পরিস্থিতি থেকে দলকে জয় এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি সেদিন। শুধ্য ব্যর্থ নয়, মুহূর্তের মস্তিষ্ক বিভ্রমে এমন একটি রান নিতে ছুটে গেছিলেন, যে রান ছিল না। ক্রিকেট বিশ্ব সেই মুহূর্তকে মনে রেখে দিয়েছে। সেই ম্যাচের পর থেকে সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকা দলটির ওপর ‘চোকার্স’ ট্যাগ আরও গভীরভাবে চেপে বসেছে। যে ট্যাগ থেকে তারা আজও মুক্তি পায় নি।
অথচ সেই বিশ্বকাপে ক্লুজনারের যা পারফর্মেন্স ছিল তার সম মানের পারফর্মেন্স অন্য কোনো বিশ্বকাপে অন্য কোন ক্রিকেটারের দেখিনি। প্রথমে কিছু স্টাট – ১৪০.৫০ গড়ে ২৮১ রান, স্ট্রাইক রেট ১২২; ২০.৫৮ গড়ে ১৭ উইকেট। ৪টি ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার – তার মধ্যে তিনটি পরপর। তবু বলবো, এই তথ্য গুলি যথেষ্ট নয় সেই বিশ্বকাপে ক্লুজনারের ইমপ্যাক্ট বোঝাতে।
সেই বিশ্বকাপে একের পর এক প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে তার দলকে তুলে ধরেছিলেন ক্লুজনার। কখনও ব্যাট হাতে, কখনও বা বল হাতে। কয়েক ক্ষেত্রে দুটোতেই। দুর্দান্ত দল ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। গিবস, ক্যালিস, কালিনান, ক্রনিয়ে, জন্টি, ক্লুজনার, বাউচার, পোলক, ডোনাল্ড সমৃদ্ধ লাইন আপ ব্যাটিং, বোলিং এবং অবশ্যই ফিল্ডিংয়ের দিক দিয়ে কারও চেয়ে পেছিয়ে ছিল না শক্তির দিক দিয়ে। তবু কোনও এক অজ্ঞাত কারনে বারবার ভেঙ্গে পড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং সেই বিশ্বকাপে।
তারপর ক্লুজনার নামতেন। যে বোলারদের ক্লিনার্সে পাঠিয়ে ক্লুজনার এই রানগুলো তুলে একের পর এক ম্যাচ জিতিয়েছিলেন তার দলকে তার মধ্যে কয়েকটি অল টাইম গ্রেট বোলারের নাম রয়েছে – আকরাম, ম্যাকগ্রা, ভাস, মুরালি, সাকলাইন, গফ, ফ্লিনটফ, শোয়েব। সাধারণত এই বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাট করার সময় আতঙ্কে থাকতেন ব্যাটসম্যানেরা। কিন্তু সেবার কোনো না কোনো সময় এদের প্রত্যেককেই মনে হয়েছে তারাই ক্লুজনারকে বল করতে ভয় পাচ্ছেন।
চাপের মুখে দুরন্ত বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এরকম ক্লিন হিটিং আমি আজ অবধি দেখি নি। কয়েকটি বিশাল ছক্কা তো ছিলই, কিন্তু ক্লুস্নারের শটের জোর ঠিকঠাক বোঝা যেত তার গ্রাউন্ড স্ট্রোকগুলি দেখে। আক্ষরিক অর্থেই নড়ার সময় পেতেন না ফিল্ডাররা। হয়ত নড়তে চাইতেনও না। কে আর ওই শটগুলি থামাবার চেষ্টা করে হাতে-পায়ে ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি নেবে?
অনেকটা বেসবল খেলার মতো করে ব্যাট ধরতেন ক্লুজনার। ব্যাট ঘোরাতেনও বেস বোলারদের মতোই। তার ব্যাটও ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভারী ব্যাট। তাকে ব্যাট করতে নামতে দেখার সময় ‘গদা হস্তে ভীমের প্রবেশ’ বাক্যাংশটি মনে পড়ে যেত।
কোনও এক অজ্ঞাত কারনে বেশ কয়েকবার ৮ বা ৯ নম্বরে নেমেছিলেন ক্লুজনার। হ্যান্সি ক্রনিয়ে সেই সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃত বলে সেদিন এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে নি। কিন্তু পরবর্তীকালে তার সম্বন্ধে যা কিছু আমরা জানতে পেরেছি তাতে এই প্রশ্ন নতুন করে উঠতেই পারে – ক্লুজনারের লড়াই কি শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই ছিল সেই বিশ্বকাপে?
তবে ক্লুজনারের আত্মবিশ্বাস কোন পর্যায়ের ছিল সেটা বোঝা যায় একটা ঘটনা থেকে। পাকিস্তানের ২২০ রানের উত্তরে ১৩৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে রীতিমত কোণঠাসা দক্ষিন আফ্রিকা। তবে ব্যাট করতে নামার আগে ক্লুজনার নাকি ডোনাল্ডকে বলে যান, ‘এক্ষুনি ফিরছি অ্যাল! আমার জন্যে শ্যাম্পেন আর বরফ তৈরি রেখ।’ তারপর আকরাম, শোয়েব এবং সাকলাইনদের ঠেঙিয়ে ৪১ বলে ৪৬ করে এক ওভার বাকি থাকতেই দলকে জয় এনে দিলেন ক্লুজনার। ডোনাল্ড সম্ভবত তৈরি ছিলেন শ্যাম্পেন হাতে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া – দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ম্যাচ বিখ্যাত স্টিভ ওয়াঘের ঐতিহাসিক ১২০ রানের ইনিংসটির জন্যে। সেই ইনিংসের মাঝপথে গিবস তার ক্যাচ ফেললে ওয়াহ নাকি বলছিলেন, ‘বিশ্বকাপটাই তো ফেলে দিলে বন্ধু!’ (ওয়াহ সত্যি সত্যি এই কথা বলেছিলেন কিনা এই নিয়ে অবশ্য পরবর্তী কালে বিতর্ক উঠেছে। তবে সেটা আলাদা প্রসঙ্গ।) তবে অনেকেরই হয়ত সেই হতভাগ্য বোলারটির নাম মনে নেই।
ঠিকই ধরেছেন – ল্যান্স ক্লুজনার।