রাস্তায় হাঁটছেন, হুট করে নিজের অজান্তেই এক কাল্পনিক বাইশ গজ চলে এলো আপনার সামনে। আপনি আপনার পছন্দের বোলারকে অনুকরণ করে করলেন। দারুণ এক ইন সুইংয়ে কুপোকাত ব্যাটার। পুরো বিষয়টা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটে গেল। বাস্তবে এমন ঘটনার কোন অস্তিত্ব নেই। তবে একটা জিনিস বাস্তবে ঘটেছে। ঐ যে আপনি আপনার পছন্দের বোলারের বোলিং অ্যাকশন অনুকরণ করলেন।
এমন ঘটনা আমাদের দেশ তো বটেই উপমহাদেশে অতি সাধারণ একটি বিষয়। এর পেছনে আমাদের ক্রিকেট প্রেমের একটা বিরাট প্রভাব রয়েছে। আমরা ক্রিকেটের মধ্যে বুদ হয়ে থাকি। সেই বুদ হয়ে থাকতে বাধ্য করেছে আমাদের এই উপমহাদেশের সব কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা। এই উপমহাদেশ যেমন উপহার দিয়েছে নান্দনিক সব ব্যাটার। তাছাড়া এই উপমহাদেশ ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছে দুর্ধর্ষ সব স্পিন বোলার এবং বিধ্বংসী সব পেসার।
কিন্তু বিধ্বংসী সেই সব পেসার উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য দাবিদার পাকিস্তান। সত্তর দশক থেকে ক্রিকেটের দারুণ রকম প্রসার ঘটেছে এই উপমহাদেশে। সে সময়ে এই উপমহাদেশে পেস বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন ইমরান খান। নিখুঁত বোলিং আর নতুন অস্ত্র সুইং দিয়ে। উপমহাদেশের উইকেট চিরকাল ছিলো স্পিন সহায়ক।
সেই উপমহাদেশেই ইমরান খান দেখিয়েছিলেন স্পিনের যাদু। সুদীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন দর্শকদের। টেস্টে ও ওয়ানডেতে তাঁর গড় বিশের ঘরে শুরুর দিকে। ২২ লাল বলে আর সাদা বলে ২৬।
বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের বৈচিত্রতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন ইমরান খান। হয়েছেন রোল মডেল। একজন বোলিং অলরাউন্ডার হওয়ার পরও নিজের বোলিং দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন এই উপমহাদেশের আপামর শিশু-কিশোরদের। তাঁকে দেখেই হয়ত অনেক কিশোর হতে চেয়েছিলেন গতি দানব। তাঁদের মধ্যে থেকেই হয়ত একজনকে খুঁজে পেয়েছিলেন খোদ ইমরান খান।
যুব ক্রিকেটারদের এক ক্যাম্প থেকে ওয়াসিম আকরামকে খুঁজে বের করেছিলেন ইমরান খান। বাঁ-হাতি সেই পেস বোলারের তাণ্ডব তো দেখেছে পুরো বিশ্ব। উপমহাদেশের বিরুপ উইকেটে নতুন বলে দুই দিকে সুইং করানোর সক্ষমতায় পাকিস্তান ক্রিকেটকে যেমন মাতিয়ে রেখেছিলেন ওয়াসিম ঠিক তেমনি তাঁর বোলিং উপভোগ করেছে পুরো বিশ্ব।
খুব অল্প বয়সেই তাঁর জাতীয় দলের অভিষেক হয়েছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ১৯৮৫ সালে অভিষেক হওয়া তরুণ ক্রিকেটার চাপ সামলে নিজেকে পরিণত করেছেন সময়ে সাথে। যত দিন গড়িয়েছে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন, হয়েছেন সেরাদের একজন। তাঁর সমসাময়িক সময়েই অভিষেক হয় আরো একজন কিংবদন্তি পেস বোলারেরে। নাম তাঁর ওয়াকার ইউনুস। তারও উৎপত্তি সেই পাকিস্তানেই।
১৯৮৯ সালে ভারত তথা ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটার শচীন টেন্ডুলকারের সাথে একই ম্যাচে অভিষেক হয়েছিলো ওয়াকার ইউনুসের। তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটের পেস বোলারদের সেই ঐতিহ্য়ের আরো একজন ধারকে পরিণত হন। তাঁর গতি এবং ইন সুইং ইয়োর্কার যেন ছিলো একেকটি পারমানবিক বোমা। ব্যাটারদের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার উপক্রম হতো। ওয়াকার আর ওয়াসিম জুঁটি বেঁধে রীতিমত শাসন করলেন বিশ্ব ক্রিকেটকে।
হঠাৎ করেই একটা একটা শঙ্কা জাগে। এই উপমহাদেশে যে একটি পেস সংস্কৃতি তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন ইমরান, ওয়াকার, ওয়াসিমরা সেই সংস্কৃতি এগিয়ে নিয়ে যাবে কে? সেই মুহূর্তে দৃশ্যপটে হাজির গতির রাজা শোয়েব আখতার। ধীর গতির উপমহাদেশের উইকেট যে তাঁর জন্য কোন বিষয়ই না। অনায়াসে দিনভর ১৫০ কিলো/ঘন্টা গতির আশেপাশে বল করে যেতে পারবেন অনন্তকাল।
সবাই ভাবলেন তিনিই বুঝি হবেন যোগ্য উত্তরসূরি। তবে ইনজুরি আর শৃঙ্খলাজনিত নানা কারণে তিনি ইমরান খান ও শেষে ওয়াসিম-ওয়াকারদের মতো ধারাবাহিক হতে পারেননি। শুধু শোয়েব আখতার নন ধারাবাহিক হতে পারেননি পাকিস্তানের আর কোন পেসার। যদিও আসার প্রদীপ যে কেউ জ্বালেনি তা কিন্তু নয়। উমর গুল, মোহাম্মদ আসিফ এরা আশার দেখিয়েছেন।
তবে সেই যে ধারাবাহিকতার অভাব। সেই অভাব ঘুচেনি বহুকাল। তবে হালের সেনসেশন শাহিন শাহ আফ্রিদি প্রত্যাশার মশালে ক্রমশই জ্বালানি সরবরাহ করছেন। হয়ত বাকিদের মতো ভুল না করলে তিনি সেই ঐতিহ্যের মশাল হাতে পৌঁছে যাবেন নতুন দিনের খোঁজে।