এতদিন যেটা আঁচ করা যেত, তা এখন প্রকাশ্য সত্য। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্দরমহলে একটা বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। দলের সেরা দুই তারকার মধ্যে রোষানল। গুঞ্জন আছে, তাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের জেরেই দলও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন দলের পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রকার বোমাই ফাটিয়েছেন। এমন কিছু সত্য তিনি অকপটে বলে গিয়েছেন, যা রীতিমত বিব্রতকর। ব্যাপারটা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, যে পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে দেশের মানুষের গর্বের শেষ ছিল না, সেই তারাই এখন সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হচ্ছেন।
হ্যাঁ। নাজমুল হাসান পাপনের ভাষ্যে ঠিক এমন কিছু তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। সাকিব-তামিম দ্বন্দ্বের খবরটা এতদিন ছিল টপ সিক্রেট। কিন্তু এখন আর সেই খবর গুঞ্জন কিংবা গোপনীয়তায় আটকে নেই। নাজমুল হাসান পাপনের মন্তব্যে তা এখন প্রকাশ্য সত্য। একই সাথে, তামিম ইকবাল ইনিয়ে বিনিয়ে ইস্যুটা স্বীকারও করে নিয়েছেন। ইংল্যান্ড সিরিজের আগে প্রেস কনফারেন্সে চলমান বিতর্ক নিয়ে তামিম যে বেশ বিব্রতকর অবস্থাতেই পড়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ এই সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় দলের ভিতর কি কোনো প্রভাবই পড়বে না? শুধু তাই নয়। বিসিবি সভাপতি মুশফিকের অধিনায়কত্বের সময়কালীনও কিছু টপ সিক্রেট প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক থাকাকালীন মুশফিক নাকি ৩/৪ বছরের মধ্যে কোনো তরুণ ক্রিকেটারকে দলেই ভেড়াতে চাইতেন না! এত বছর বাদে কেন এসব তথ্য ফাঁস করলেন পাপন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু এত বছর আগের ঘটনা এখন ফাঁস হওয়ায় নিশ্চিতভাবেই বিব্রতকর মুহূর্তে পড়েছেন মুশফিক। সব কিছু মিলিয়ে দলের ভিতরে অবস্থা ভাল, এমনটা বলা মানে অনেক কিছু আড়াল করে যাওয়া।
এর সাথে আরেকটি অনুরূপ প্রশ্নের উদয় হয়, এই যে বিসিবি সভাপতি বারংবার কোনো লাগাম ছাড়াই অন্দরমহলের খবর প্রকাশ করেন। এতে করে বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের সম্পর্কের উন্নয়ন কি আদৌ ঘটে? নিশ্চিতভাবেই না। হ্যাঁ। তামিম বরাবরই বলেছেন, মাঠে গেলে সব ঠিক হয়ে যায়। সবার ম্যাচ জয়ের দিকেই চোখ থাকে। তারপরও এই যে বোর্ড আর ক্রিকেটারদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, এটা দিন শেষে দুই গ্রুপের মাঝে একটা দেয়াল তৈরি করে।
একই দলের দুই ক্রিকেটারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি, নতুন কিছু নয়। এমন ঘটনায় জড়িয়েছেন অনেক কিংবদন্তী ক্রিকেটাররাও। শোনা যায়, অস্ট্রেলিয়ার জমজ ভাই মার্ক ওয়াহ আর স্টিভ ওয়াহর সম্পর্ক নাকি ভাল ছিল না। ওয়াকার ইউনিস আর ওয়াসিম আকরাম দ্বন্দ্বের ইতিহাস তো প্রায় সবার জানা। সেই হিসেবে এক সময়কার পরম প্রিয় বন্ধু সাকিব-তামিমের বন্ধুত্বে ফাটল দেখাটা খুব বিস্ময়কর কিছু নয়। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। তাদের দ্বন্দ্বে ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা কেমন থাকছে? স্বাভাবিক থাকছে নাকি ক্ষুণ্ন হচ্ছে?
তামিম প্রেস কনফারেন্সে এসে সব ‘ঠিকঠাক’ বলেছেন। বলেছেন বললে ভুল হবে, দাবি করেছেন। কিন্তু বিসিবি সভাপতি আগেই বলেছেন, দলের মধ্যে কিছু একটা সমস্যা আছে। একই সাথে গ্রুপিং তৈরি হওয়া নিয়েও বিস্ফোরক এক মন্তব্য করেছেন।
তামিম এখন দলের অধিনায়ক। তিনি হয়তো দলের ভিতরের সমস্যাটা প্রকাশ্যে আনতে চান না। সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু দলের ভিতরে কিছুটা যে ভঙ্গুর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা এক প্রকার নিশ্চিত করেই ধরে নেওয়া যায়। এখন এখান থেকে উত্তরণের পথ কিভাবে খুঁজে পাবে বাংলাদেশ?
দলে নতুন কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটা দীর্ঘ সময়ের সাফল্যের অগ্রযাত্রার নেপথ্যে তিনি ছিলেন। সামনে ইংল্যান্ড সিরিজ দিয়েই আবারো বাংলাদেশের সাথে তাঁর নতুন যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। তবে হাতুরু যখন দায়িত্ব নিলেন, ঠিক তখনই শত সমস্যায় জর্জরিত দল।
আগের বারে দল হিসেবে উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন হাতুরু। সে যাত্রায় তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু এবারে তাঁর জন্য কাজটা আরেকটু কঠিন। মাঠের ক্রিকেট নিয়ে ভাবনা ছাড়াও তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে মাঠের বাইরের পরিস্থিনি নিয়েও। কিন্তু যে সব সিনিয়র নিয়ে এই সব সমস্যার অবতারণা, সেই সিনিয়রদের সাথেই আগের মেয়াদে তিক্ততায় শেষ করেছিলেন হাতুরু। তাই হাতুরুর জন্য চ্যালেঞ্জটা এবার অনেকখানি।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ কখনোই সিরিজ জেতেনি। ঘরের মাঠে বরাবরই ফেবারিট টাইগাররা। কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড আসলেই বারবার পা হড়কেছে বাংলাদেশে। ২০১১ ও ২০১৫, টানা দুই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এ বাদে সুখস্মৃতি বলতে গেলে ২০১০ সালে ব্রিস্টলে, আর সবশেষ ২০১৬ সালে মিরপুরে জয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ২১ ওয়ানডেতে জয় এই চারটিতেই।
তবে সময়ের ব্যবধানে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন অনেক পরিণত। সবশেষ ঘরের মাটিতে ভারতকে হারিয়েছে তারা। তাই আসন্ন ইংল্যান্ড সিরিজ যে একপেশে হবে না, তা বলাই যায়। কারণ ৭ বছর আগে যেবার, ইংল্যান্ড বাংলাদেশে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে আসলো, তখনও কাঠখড় পুড়িয়েই ইংল্যান্ডকে সিরিজ জিততে হয়েছিল।
তবে এবারের সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আগের সব ম্যাচ জয়ের নায়কদের মধ্যে অধিকাংশই দলে নেই। ব্রিস্টলে প্রথম জয় এসেছিল ইমরুল, মাশরাফি, শফিউদের বীরত্বে। এরপর ২০১১ সালে বিশ্বকাপের ম্যাচেও ইংল্যান্ডকে হারানোর নেপথ্যে ছিলেন ইমরুল আর শফিউল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া শেষ জয়ের নায়ক মাশরাফিও এখন দলে নেই। তাই ইংল্যান্ডকে হারাতে হলে এবার নতুন কাউকেই নায়ক রূপে আবির্ভূত হবে।
কিন্তু দিনশেষে আশঙ্কার বিষয়টা হলে, দলের এখনকার পরিস্থিতি। বিস্ফোরক সব খবর ফাঁসে হঠাতই সরগরম ক্রিকেট পাড়া। সে সব খবর এতক্ষণে নিশ্চয় ক্রিকেটারদেরও অজানা থাকার কথা নয়। তাই কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা তো থাকছেই।
তবে এ সব কিছুই এক নিমেষে শেষ হয়ে যাবে, যদি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এত দিনে ধরে সিরিজ না জেতার আক্ষেপটা ঘুচানো যায়। আগের বার যখন বাংলাদেশ দলে হাতুরু দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখন বলতে গেলে জাদুকর ভূমিকায় দলকে পাল্টে দিয়েছিলেন। জাদুকর হাতুরু কি তবে এবার সেই পাল্টে যাওয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবেন? আপাতত এ প্রশ্ন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘প্রশ্ন’ হয়েই থাক। উত্তরটা নাহয় সিরিজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তোলা থাকলো। তবে হাতুরুর হাতুড়ির আঘাতে যদি সব বিতর্ক ভেঙে ফেলা যায়, মন্দ কী!