এই একটা ম্যাচ জিতলেই নাকি আপনি…

প্রিয় লিও,

নীল-সাদা এই গ্রহের যে কোনও কোণে কান পাতলে… না, না, তা কেন, কান না পেতেও দিব্যি শোনা যাচ্ছে, এই একটা ম্যাচ জিতলেই নাকি আপনি…

জিতলেই দিয়েগোর মুকুট, জিতলেই ক্রিশ্চিয়ানো যোজন-যোজন পিছনে, জিতলেই সাত-সাতখানা ব্যালোঁ-ডি-ওর নিয়েও হল-অফ-ফেমের এক কোণে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, জিদান, রোনাল্ডোদের চোখে চোখ রেখে মধ্যমণি হয়ে বসে পড়া যাবে। জিতলেই, নীল-সাদা গায়ে জড়িয়ে বার্সার মেসি হতে না পারার যে অস্বস্তিকর দাগ, যা কোপা জিতেও পুরোপুরি যায়নি, পুরোপুরি মুছে গিয়ে মাঘীপূর্ণিমার আকাশের মতো ঝকঝক করবে জার্সি!

সবাই বলছে, জিতলেই আপনি গ্রেটেস্ট, আপনিই সর্বোত্তম, মেনে নিতেই হবে। না নিয়ে উপায় নেই।

একজন ভাল ক্রীড়াবিদ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে জয়লাভ করতে সক্ষম হন। একজন অতি কুশলী ক্রীড়াবিদ জিততে-জিততেও নয়নমনোহর হয়ে ওঠেন। একজন মহান ক্রীড়াবিদের প্রভাব, তাঁর স্পর্শ শুধুমাত্র সেই খেলার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না।

মহম্মদ আলি ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধী প্রচারের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন এবং সেখানেই থেমে থাকেন না। ডন ব্র্যাডম্যান যে কোনও পেশাদারের পারফেকশনের মাপকাঠি হয়ে ওঠেন। চে’র ট্যাটু আর আর্জেন্টিনার হৃদয়চিহ্ন শরীরে ধারণ করে মারাদোনা এবং হেলমেট ছাড়া চ্যুয়িংগাম চিবোনো ঔদ্ধত্যে সাদা-চামড়ার ফাস্টবোলারের দিকে শীতল চাউনি ছুঁড়ে দিতে দিতে ভিভ সমস্ত বৈষম্যের বিরোধিতার, সমস্ত বিপ্লবের ম্যুরাল হয়ে যান আর রজার ফেডেরার নাক-উঁচু ব্রিটিশদের ডেরায় দাঁড়িয়ে তাঁদেরই গর্বের আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ার সম্মানটুকু নিজের করে নেন অনায়াসে।

অত দূরেই বা কেন, আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকেই দেখুন। নীরবে বহুজাতিক কোলা কোম্পানির বোতল সামনের টেবল থেকে নামিয়ে রেখে বিশ্ব জোড়া ঝড় তুলে দেন (না, যতই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করুক, রোনালদোর ওই নীরব জেশ্চারের জন্য কোকাকোলার শেয়ার প্রাইসে ধ্বস নামেনি, তার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে!) – এমনই তাঁর সামাজিক প্রভাব।

আপনি? আপনার সৃষ্টিধারা সভ্যতার প্রাচীন নোনা-ধরা দেওয়াল চুঁইয়ে কতটা পৌঁছল অন্যান্য ঘরে? আদৌ পৌঁছল কি?

নিয়ম মেনে চলা সুশীল ফার্স্টবয় মতোই আপনি কি ক্যাবিনেট ট্রফিতে ভরিয়ে তুলতেই ব্যস্ত রইলেন, নাকি বদলে দিতে চাইলেন আপনার আশেপাশের দুনিয়াকে? যে দেশের পনের পার্সেন্টের বেশি লোক দৈনিক সাড়ে পাঁচ ডলারের কম উপার্জন করেন, যে দেশ ৪০ বছর আগে অব্দি দীর্ঘ আট দশকের একনায়কতন্ত্রের প্রভাব কাটিয়ে গণতন্ত্রের বেসিক সুবিধেটুকু এখনও সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে ছড়িয়ে দিতে পারেনি, সেই দেশের প্রতিভূ হয়ে আপনি কি অনুপ্রাণিত করতে পারলেন দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ-তরুণীদের? বস্তি থেকে বেরিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখার সাহস জোগাতে পারলেন বেলেঘাটার যুবকের বুকে? যেমন করে আপনি শরীরের বাঁদিকে বল আগলে রাখেন বিপক্ষের সেরা সাইডব্যাকের থেকে, তেমনই পুলিশের লাঠির সামনে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা কি নিজের অনুগামীদের আগলে রাখতে সাহস পাচ্ছেন?

আজকের ম্যাচ আপনি জিতুন বা হারুন, আপনার সিংহাসনের স্তম্ভ এক ইঞ্চিও উঁচু বা নিচু হবে বলে মনে হয় না। জিতলে কীভাবে জিতেছেন, বিপক্ষকে কতটা সম্মোহিত করে; হারলে কতটা মরিয়া লড়াই করে হার স্বীকার করছেন, এবং শেষমেশ তাও করছেন না— সেই দিয়েই বিচার করা হবে, মেসি-ম্যাজিক শুধুমাত্র চৌকোণা ঘেসো জমিতেই সীমাবদ্ধ নাকি তার উড়াল আরও বিস্তৃত, আরও গভীর!

উল্টোদিকের দশ নম্বর, তারুণ্যের আস্ফালনে, তীব্র সর্পিল গতির আর উদ্দাম শক্তির বারুদ পাঁজরে ভরে আপনার সিংহাসনের পাদদেশে অপেক্ষা করছে। সে জানে, সে শরীরের সমস্ত রোমকূপ দিয়ে বিশ্বাস করে, the throne belongs to him, the time belongs to him!

ভুলেও ভাববেন না, সে আপনাকে অনুরোধ করছে সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার। অরিন্দম মুখার্জীর মতোই টেবিল চাপড়ে সে নিজের দাবি জানাচ্ছে এবং সেই দাবির সমর্থনে, সময়ের সমর্থনে ক্রমশ জোরালো হচ্ছে তার আশেপাশের কণ্ঠস্বর।

দাবি মেনে ভীরুর আত্মসমর্পণ নাকি জিতে গিয়েও জয়ীর ঔদার্যে, স্মিত হাস্যে সিংহাসন ছেড়ে দেওয়ার গৌরব – কোনটা বেছে নেবেন লিও?

নীল-সাদা এই গ্রহের যে সম্মিলিত ক্যাকোফোনি, জিতে গেলেই সিদ্ধিলাভ, হেরে গেলে – তাতে কান দেবেন না। মনে রাখবেন, কীভাবে জিতলেন বা কীভাবে হারলেন, সেটাই আপনার শেষ বিচারের চার্জশিট।

আপনার ফুটবল আমরা অনেক দেখেছি, দু’ চোখ ভরে। মানুষ হিসেবে আপনার ভিতরের ধাতুটি কেমন, সেটাই এবারে দেখার।

শুভমস্তু!

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link