টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্টের ‘ফাস্ট ক্লাস’ উত্থান

অথচ চার বছর আগে জাতীয় দলে জাকিরের আগমণ ঘটেছিল টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হিসেবে। সিলেটে সেদিন শ্রীলংকার বিপক্ষে জ্বলে উঠার আগেই আউট হতে হয়েছিল তাঁকে। এরপর নিজের খোলনালচ বদলে ফেলেন তিনি, কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় নিজেকে তৈরি করেন টেস্ট ক্রিকেটের জন্য।

জাতীয় দল তো দূর, ভারত এ দলের বিপক্ষে সিরিজে ঘোষিত দলেই ছিলেন না তিনি। কিন্তু এ দলের নিয়মিত ওপেনার তৌহিদ হৃদয় ইনজুরিতে পড়লে দলে সুযোগ মেলে তাঁর। ভাগ্যের বদৌলতে পাওয়া সে সুযোগ হাতছাড়া করেননি, দারুণ পারফর্ম করে জাতীয় দলের একাদশেও জায়গা করে নিয়েছেন।

অভিষেক টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে আক্সার প্যাটেল, কুলদ্বীপ যাদব, রবিচন্দ্রন অশ্বিনদের মোকাবিলা করে তুলে নিয়েছেন সেঞ্চুরি। বলা হচ্ছিল জাকির হাসানের কথা, চট্টগ্রামে শতরানের ইনিংস খেলে যিনি নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন প্রবলভাবে। 

কক্সবাজারে ভারত এ দলের বিপক্ষেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন জাকির। প্রথম টেস্টে হারের কক্ষপথে থাকা বাংলাদেশ দলকে জয়ের সমান এক ড্র এনে দিয়েছিলেন ১৭৩ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে। ১৬ চার এবং তিন ছক্কায় সাজানো সেই ইনিংস খেলার পথে ক্রিজে ছিলেন প্রায় দশ ঘন্টা।

সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিল বিন্দুমাত্র চিড় ধরাতে পারেনি জাকিরের মনোসংযোগে। ম্যাচশেষে বলেন, ‘আমি যতটা সম্ভব বেশি সময় ক্রিজে থাকতে চেয়েছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমি নিজের মতো করে খেলতে চেয়েছি। আর আমার রান করার পেছনে এটাই মূলমন্ত্র।’

গত বছরের জাতীয় লিগের সেরা পারফর্মার ছিলেন জাকির। প্রায় ৫৬ গড়ে ৪৪২ রান করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। জাতীয় দলের আশেপাশে থাকলেও কোনোভাবেই যেন দরজাটা খুলছিল না জাকিরের জন্য।

এরপর ভাগ্যের ছোঁয়ায় যেন সবকিছু বদলে গেল, প্রথমে তৌহিদের ইনজুরিতে পাওয়া সুযোগে এ দলের বিপক্ষে মহাকাব্যিক সেই ইনিংস। এরপর তো তামিম ইকবালের ইনজুরির সুবাদে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামা। চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি পাওয়া জাকিরের গত কয়েকটা স্বপ্নের মতো কেটেছে সেটা বলাই বাহুল্য।

ভাগ্যের ছোঁয়া থাকলেও জাকির নিজেকে প্রস্তুত রেখেছেন সর্বদাই। এ দলের চার দিনের ম্যাচের সময় ২৪ বছর বয়সী এই তরুণকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্স। তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন জাতীয় দলের আরেক ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়কে নিয়ে, যিনি কিনা বেশ কয়েকদিন যাবত ফর্মের বাইরে। অন্য নেটে জাকির ছিলেন আত্নবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এক ব্যাটার, নেট বোলাররা তাঁর বিন্দুমাত্র পরীক্ষা নিতে পারেননি। 

অথচ চার বছর আগে জাতীয় দলে জাকিরের আগমণ ঘটেছিল টি টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হিসেবে। সিলেটে সেদিন শ্রীলংকার বিপক্ষে জ্বলে উঠার আগেই আউট হতে হয়েছিল তাঁকে। এরপর নিজের খোলনালচ বদলে ফেলেন তিনি, কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় নিজেকে তৈরি করেন টেস্ট ক্রিকেটের জন্য।

জাতীয় দলের হয়ে একটি টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেই দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। বোঝাই যাচ্ছিল কোথাও একটা গড়মিল হচ্ছে। জাকির এরপর শরণাপন্ন হন দেশের সেরা কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের কাছে। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘আমার ধারণা জাতীয় দলের টেস্ট একাদশে জায়গা পেতে সে ভীষণ পরিশ্রম করেছে। তাঁর ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছে দারুণ ফর্মে আছে। গত এক বছরে সে ১০ কিংবা ১১টি সেঞ্চুরি করেছে। এরমাঝে সম্ভবত দুটো ডাবল সেঞ্চুরিও ছিল। তো আমি মনে করি জাতীয় দলে ডাক পাবার যোগ্য ছিল সে। ঘরোয়াতে নিয়মিত রান করেছে জাকির।’

যদিও তিনি এটা জানাতে রাজি হননি জাকিরের ব্যাটিংয়ের ঠিক কোন জায়গাগুলো নিয়ে তাঁর সাথে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন আপনি বড় রানের ইনিংস খেলবেন, তখন নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাস বাড়বে। কারণ দিনশেষে রান করাটাই জরুরি, প্রতিপক্ষ কিংবা পিচ নয়। নিজের নামের পাশে রান না থাকলে আপনি কখনোই প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে টিকতে পারবেন না। টেকনিক্যালি সে অনেক উন্নতি করেছে। এখন দেখা যাক সে টেস্ট ক্রিকেটে কতদিন টিকতে পারে। তাঁর ডিফেন্স আগের চাইতে অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। জাকিরের ম্যাচ টেম্পারমেন্টও বেশ ভালো।’

জাতীয় দলের নির্বাচক হাবিবুল বাশারও জাকিরের লিমিটেড ওভার স্পেশালিস্ট থেকে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে নিজেকে তৈরি করা নিয়ে মুগ্ধ। তাঁর মতে জাকির ধীরে ধীরে তিন ফরম্যাটেই জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার সামর্থ্য রাখে। তিনি বলেন, “সে টি টোয়েন্টি দিয়ে শুরু করেছিল। দুই বছর আগেও আমাদের হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াডে লিটন, আফিফ, শান্তদের সাথে ছিল। সেই সময়টাতে সে ভালোই খেলছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দুটো বাজে মৌসুম কাটায়। কিন্তু তাঁর স্ট্রোক মেক করার সামর্থ্য ছিল, সে কারণেই আগে আমরা তাঁকে সাদা বলের ক্রিকেটে বিবেচনা করেছিলাম যে কিনা পাওয়ার প্লে ব্যবহার করতে জানে।’

তাঁর ভাষায়, ‘আমার ধারণা বাজে কাটানো সেই দুই মৌসুম জাকিরকে আরো পরিণত করেছে। সে আগে এলোমেলো শট খেলতো। সে পুল শট খেলতে দারুণ পছন্দ করে। সে আগে আলতো করে খেলতে জানতো না, সবসময় জোরে মারার চেষ্টা করতো। এখন সে ডিফেন্স করতে জানে। এসব ছোটখাটো ব্যাপারগুলো তাঁর ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলেছে। আমার ধারণা সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য প্রস্তুত এবং আমাদের তাঁকে মানিয়ে নেবার সুযোগ দিতে হবে।’

জাতীয় দলের আরেক নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাকও জাকিরকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, ‘আমি ভারত এ দলের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং দেখেছি। তাঁর ১৭৩ রানের ইনিংসই বলে দেয় ব্যাটসম্যান হিসেবে সে কতোটা লড়াকু মানসিকতার। কেবল এ দলের বিপক্ষে নয়, জাতীয় লিগেও সে দারুণ ব্যাটিং করেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘টেম্পারমেন্ট অনুযায়ী সে দারুণ ফর্মে আছে এবং তাঁর মধ্যে বড়  রান করার ক্ষুধা আছে। অনেক ক্রিকেটারই আছেন যারা ৫০ কিংবা ১০০ করার পর সন্তুষ্টি অনুভব করেন। কিন্তু জাকির যতক্ষণ সম্ভব ক্রিজে সময় কাটাতে চায় এবং বড় ব্যাটসম্যান হয়ে উঠার পূর্বশর্ত এটা। প্রতিটা ব্যাটসম্যানের মাঝে এমনটা দেখা যায় না।’

‘পূর্বে সে ৫০ কিংবা ১০০ করার পর আত্নতুষ্টি অনুভব করতো। নিজের দায়িত্ব শেষ ভেবে নিতো এবং এলোমেলো শট খেলে আউট হয়ে যেতো। কিন্তু এখন সে নিজেকে বদলে নিয়েছে। সে এখন বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্য রাখে।’, বলেন রাজ্জাক।

সাত বছরে আগে প্রথমবারের মতো জাকির জাতীয় লিগে মাঠে নেমেছিলেন। সেবার ৫১ গড়ে ৩৬১ রান করে অভিষেক মৌসুম স্মরণীয় করে তুলেছিলেন। সাত বছরে তাঁর রানের ক্ষুধা আরো বেড়েছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২১৩, ভারত এ দলের বিপক্ষে ১৭৩ কিংবা অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি – তাঁর ক্রমাগত উন্নতির পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।

ঘরোয়া ক্রিকেটে এর মাঝেই চার হাজার রান হয়ে গেছে জাকিরের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও শুরুটা করেছেন দারুণভাবেই। এখন দেখার বিষয় জাকির  লম্বা দৌড়ের ঘোড়া হিসেবে টিকে থাকতে পারেন কিনা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...