হাফেজ মামুন যখন ছক্কার নায়ক

রংপুরের ওপেনার আবদুল্লাহ আল মামুন সিলেটে বৃষ্টি ভেজা মাঠে ব্যাট হাতে ইতিহাস রচনা করেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সিলেটে ধমকা হাওয়ার সাথে বেশ বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টি জলে ভিজে যায় সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের আউটফিল্ড, সেই আউট ফিল্ড শুকাতে চলে যায় আড়াই দিন।

২৪তম জাতীয় ক্রিকেট লীগের সিলেট ও রংপুর বিভাগের ম্যাচ তাই শুরু হয় তৃতীয় দিন দুপুরে। সিলেটের সেই ভেজা উইকেটের ফায়দা নিতে অধিনায়ক জাকির হাসান টস জিতে বোলারদের হাতে বল তুলে দেন। ইনিংসের শুরুতে সফল হলেও রংপুরের ওপেনার আব্দুল্লাহ আল মামুনের কারণে সেই সাফল্য বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি সিলেটের বোলাররা। সময় যত বাড়ছিল সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের এক নম্বর মাঠের উইকেট তত ব্যাটারদের অনুকূলে যায়। 

খেলা যত গড়িয়েছে মামুন তত উইকেটে থিতু হয়েছেন, ৭৯ রানে অপরাজিত থেকে তৃতীয় দিনের খেলা শেষ করেন। চতুর্থ দিনে সেটাকে ডাবল সেঞ্চুরিতে রুপ দান। সিলেটের বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় প্রথম শ্রেণির ম্যাচে মামুন হাকান ডাবল সেঞ্চুরি, তার অপরাজিত ২১০ রানের ইনিংসে ৪০৫ রান সংগ্রহ করে রংপুর। 

ডাবল সেঞ্চুরির পথে মামুন তৃতীয় উইকেটে জুটিতে নাঈম ইসলামের সাথে ১৫১ রানের জুটি গড়েন। নাঈম উইকেটে থাকাকালীন সময়ে মামুনকে নিজের মতো করে খেলার পরামর্শ দিয়েছেন। নাঈমের পর যারা এসেছেন সবাই তাকে সাহস জুগিয়েছেন। যুব বিশ্বকাপ জয়ী আকবর আলীরও পরামর্শ পেয়েছেন মামুন। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি ডাগ আউট থেকে উৎসাহ দিয়েছেন কোচরাও। বড় ইনিংস খেলতে তাদের উৎসাহ আর সুপরামর্শ কাজে দিয়েছে তাঁকে। 

ক্রিকেটে আসার আগে মামুন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন, সেখানে কোরআন হিফজও সম্পন্ন করেই তার ক্রিকেটে যাত্রা। ক্রিকেটে আসার আগেই হিফজ সম্পন্ন করায় ক্রিকেটার হতে তাঁর পরিবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। যেখানে দেশের প্রায় সব ক্রিকেটারকে পরিবারের বাধা ডিঙিয়ে এই পথে একা হাটতে হয়, সেখানে মামুন পেয়েছেন তার পরিবার পুরো সমর্থন। তার খেলা পরিবারই তাঁকে ভর্তি করে দেন রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে। 

২৪ তম জাতীয় ক্রিকেট লীগের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করা মামুনের ক্রিকেটের শুরু টেপ টেনিস ক্রিকেট দিয়ে। পাড়ার বড় ভাইদের টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলে ভেড়াতেন তিনি, খেলা ভাল পারতেন বলে তার পরিবার রংপুরের ক্রিকেট গার্ডেনে তাকে ভর্তি করে দেন। সেখানে কোচ শাকিলের কাছে তার ক্রিকেটের হাতেখড়ি। 

এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি মামুনকে গাজী ক্রিকেটার্স হান্টে নির্বাচিত হলে দেশ সেরা ক্রিকেট কোচ কাজী সালাউদ্দিনের সান্নিধ্যে আসেন। কোচ সালাউদ্দিনের অধীনেই বিভিন্ন ক্যাম্প করেন মামুন, সেখানে ক্রিকেটের প্রাণে নিজেকে সঁপে দেন। গাজী ক্রিকে।টার্স হান্ট দিয়ে কোচ সালাউদ্দিনে সান্নিধ্য পাওয়া মামুন এখনো আছেন এই কোচের অধীনে। মাস্কো সাকিব একাডেমিতেই মামুন নিজেকে ভবিষ্যতে বড় মঞ্চের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন। যার প্রধান কোচের দায়িত্বে সালাউদ্দিন নিজে।

মামুন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে সর্বশেষ যুব বিশ্বকাপ খেলেছেন। বাংলাদেশ যুব দলের হয়ে ২০২১-২২ সালে ৭ ম্যাচ খেলেন। যেখানে ৬ ইনিংসে ব্যাট হাতে ১০০ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ৪ ইনিংসে নিয়েছেন ৩ উইকেট। মামুনের যুব ক্যারিয়ার এতোটা সম্মৃদ্ধ না হলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করে আলোড়ন তৈরি করেছেন। 

ক্রিকেটের এই পর্যন্ত আসতে মামুনকে কোনো বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি। পরিবারের পাশাপাশি সবসময় রংপুর বিভাগের ক্রীড়াঙ্গনের সবারই সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছেন। মামুন যেমনটা বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটার হতে আমাকে কোনো বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে আসতে হয়নি, শুরু থেকেই আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট দিয়ে আসছে। তাই আমি খুব সহজেই ক্রিকেট খেলতে পারছি, ভাল খেলতাম দেখে আমার পরিবার আমাকে রংপুর ক্রিকেট গার্ডেনে ভর্তি করে দেয়। সেখানে শাকিল স্যারের তত্ত্বাবধানে ক্রিকেটের শুরু, এরপর গাজী ক্রিকেটার্স হান্টে ঠিকি। সেখানে সালাউদ্দিন স্যারের অধীনে বিভিন্ন ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করি। এখনো সালাউদ্দিন স্যারের অধীনে আছি, আমি মাস্কো সাকিব একাডেমিতে অনুশীলন করি। সেখানে সব কিছু সালাউদ্দিন স্যার দেখাশোনা করেন।’

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি হাকানো মামুন অন্য তরুণ ক্রিকেটারদের মতো স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার। তবে সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে চান মামুন। এখন শুধু জাতীয় লীগেই মূল ফোকাস তার, এখানে বাকি ম্যাচগুলোতে ভাল খেলে যেতে চান। জাতীয় দলে খেলাটা পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করে বলে মনে করেন মামুন।

তিনি বলেন, ‘সবার লক্ষ্য তাকে জাতীয় দলে খেলার আমারও আছে। বর্তমানে আমার সব মনোযোগ জাতীয় লিগে এখানে সামনের ম্যাচ গুলো ভাল খেলতে চাই। জাতীয় দলে খেলাটা পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করে, যদি আমি নিয়মিত রান করে যেতে পারি, আল্লাহ চান তো আগামী দুই/তিন বছরের ভিতরে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাব। আগামী দুই/তিন বছরে মধ্যে জাতীয় দলে খেলার সম্পন্ন দেখি।’

দেশের ক্রিকেটে তার আদর্শ সাকিব আল হাসান, দেশের বাইরে ব্যাটিং তার আদর্শ ডেভিড ওয়ার্নার। সাকিব আর ওয়ার্নারের পাশাপাশি তার পছন্দের ক্রিকেটার ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্ট্রোকস। স্ট্রোকসের মতো তাই বাম হাতে ব্যাট করার পাশাপাশি ডান মিডিয়া পেস বোলিং করে থাকেন মামুন।

সাকিব-ওয়ার্নারকে আদর্শ মানা এই ক্রিকেটারের প্রিয় শট কাভার ড্রাইভ ও স্লগ সুইপ। তবে সেটা বোলারের ধরণ বুঝে খেলেন মামুন। পেস বলে কাভার ড্রাইভ, আর স্পিনে স্লগ সুইপ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link