জাতীয় দলের সাবেক কোচ, লেখক কিংবা সংগঠক অনেক পরিচয়ের মাঝেও তিনি নিজেকে ভাবতেন শুধুই ক্রিকেটার হিসেবে।
ক্রিকেটকে নিজের শিক্ষক সমতুল্যই ভেবেছেন আজীবন। ক্রিকেটকেই বড় পরিসরে চিন্তা করতেন তিনি। ধ্যান-জ্ঞান সবটাই দিতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটে। অবশ্য ক্রিকেটের রঙিন পোশাকটা তার পছন্দের ছিলো না। সাদা জার্সিতেই ক্রিকেটকে ধারণ করতেন তিনি। সাদা জার্সি মানেই যে তাঁর কাছে মনের শুদ্ধতা!
জালাল আহমেদ চৌধুরী। কারো কাছে তিনি খ্যাতিমান ক্রীড়া লেখক, কারো কাছে বড় মাপের সংগঠক; কিন্তু নিজের কাছে তিনি শুধুই একজন ক্রিকেটার।
৫০ থেকে ৬০ এর দশকে আজিমপুর কলোনিতে বড় পানির ট্যাংকির সামনের খাম্বাকে উইকেট বানিয়ে খেলা শুরু। এখনকার সময়ে মাঠের বড্ড অভাব দেখা দিলেও সেসময়ে মাঠের কমতি ছিলো না। পাড়ার বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের সাথে খেলেই সময় পার করতেন তিনি। মা ছিলেন বইপ্রেমী; সারাদিন বই পড়তেই ভালোবাসতেন। আর বাবা ছিলেন একজন সরকারি অ্যাকাউন্টস অফিসার।
জালাল নিজেও ছিলেন ভীষণ মেধাবি। তবে, ক্রিকেটকে ধ্যানে-জ্ঞানে ধারণ করতে গিয়ে পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ছিলেন। এতে তাঁর বাবা অবশ্য বেশ রাগই হতেন। জালাল অবশ্য এসবের ধার ধারেনি। স্কুলের জন্য বেরিয়ে পাশেই পল্টন মাঠে গিয়ে বন্ধুদের সাথে মেতে উঠতেন ক্রিকেট খেলায়।
তখন থেকেই মাথায় ভিন্ন কিছু ঘুরপাক খাচ্ছিলো! চেয়েছিলেন ক্রিকেটের সাথেই পুরোদস্তুর মিশে থাকতে। সেখান থেকেই পথচলা ক্রিকেটে! আর একে একে কতক ধাপ পেরিয়ে নিজের সামর্থ্যের সবটা দিয়ে বনে গেছেন একজন ক্রিকেটার, একজন কোচ, একজন ক্রিকেট লেখক – বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন ‘সব্যসাচী’!
সময় পেলেই ক্রিকেটের সাথে সম্পর্কিত বই নিয়ে পড়া শুরু করতেন! হয়তো লাইব্রেরি কিংবা কোনো বইয়ের দোকান। বই কিংবা খেলার মাঠ – সর্বোপরি ক্রিকেটের মাঝেই ডুবে থাকতে চাইতেন তিনি।
ক্রিকেটটা প্রোফেশনালি নেন ১৯৬৫ সালের দিকে। তখন তিনি ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ওপেনিং ব্যাটিংয়ের সাথে সাথে দলে উইকেটরক্ষক হিসেবেই খেলতেন তিনি। উদিতি ক্লাব থেকে খেলার প্রস্তাব পেয়ে গেলেন! আর সেই প্রস্তাব লুফে নিয়ে চটজলদি ব্যাকপ্যাক করে পৌঁছে গেলেন ক্লাবে। ১৯৬৮ এর দিক থেকে ওই ক্লাবে তিন বছর বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালও খেলেছিলেন। জালালের ভূমিকা ওপেনার হলেও তিনি বেশ সাদামাটা ব্যাটসম্যানই ছিলেন। এটা অবশ্য তিনি খোদ মানতেনও।
দলের অধিনায়ক চাইতেন জালাল শুধু ক্রিজে টিকে থাকলেই হবে। খুব কঠিন দায়িত্ব অবশ্য পড়তো না তাঁর ঘাড়ে। কোনো মৌসুমে দুই/তিনেক ফিফটি এলেই সেটাকে সেরা মৌসুম হিসেবে ধরতেন তিনি। এ যেনো বড় কোনো অর্জন করে ফেলেছেন।
এরপর সেখান থেকে যান নতুন ক্লাব ইয়াং প্যাগাসাসে। পাড়ার ছোটভাইরা মিলেই অবশ্য এই দল করেছিলো। পরবর্তীতে এই ক্লাব অবশ্য প্রথম বিভাগে খেলার সুযোগ পেয়ে যায়। এই ক্লাবেরই ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম! এমনকি তার ছেলে জামিও এই ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পরই এই ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করেন তিনি। তবে মোটে এক বছর খেলেছিলেন ইয়াং প্যাগাসাসের হয়ে। দিনে দিনে নিজের পারফরম্যান্সে ভাটা পড়ায় সেখান থেকে আবারো ফিরে যান উদিতি ক্লাবে। পরের এক বছর টাউন ক্লাবের হয়েও ক্রিকেট খেলেন তিনি।
এরপর সেখান থেকে ১৯৭৮ সালে আবার পাড়ি জমান ধানমণ্ডি ক্লাবে। সেখানে জাতীয় দলের প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপুকে পেয়েছিলেন সতীর্থ হিসেবে। লিপু অবশ্য তখন বেশ জুনিয়রই ছিলো। বেশ বলতে সেই দলের সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন জালাল ও সবচেয়ে জুনিয়র ছিলেন লিপু! এবারে ব্যবধানটা নিজেই আন্দাজ করুন। লিপু যখন লিগে প্রথম সেঞ্চুরি পান তখন ক্রিজে ছিলেন জালাল। ক্লাব বদল করলেও আত্মাটা মিশেল ছিলো ইয়াং প্যাগাসাসের সাথেই!
ক্রিকেট কোচিং করানোর ইচ্ছেটাও ছিলো বেশ। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তখন প্রায় শেষের দিকেই। ক্রিকেটে খেলা অবস্থায়ই ১৯৭৯ সালে দশ মাসের কোচিং ডিপ্লোমা কোর্স করতে পাতিয়ালা গিয়েছিলেন তিনি।
তিনি যে ভীষণ মেধাবী ছিলেন সেটার প্রমাণ আরেকবার করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় রিটেন+ভাইভা দুটোতেই উত্তীর্ণ হন তিনি। অবশ্য বিসিএসটা শেষ অবধি হয়ে উঠেনি। তিনি নিজেও মনে মনে খুশি হয়েছিলেন; ক্রিকেটে থাকতে পারবেন বিধায়! ঢাকা কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে আর বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় যাননি তিনি।
১৯৭৯ এর দিকে ক্রিকেট বোর্ড থেকেও তাঁকেও বলা হলো ক্রিকেট নিয়েই যেহেতু পড়ে থাকবে পাতিয়ালার কোর্সটাই করে এসো! সেই ধাক্কায় হয়তো পাতিয়ালা যাওয়া। ১৬-১৭ জনের মধ্যে হলেন প্রথম! সেখান থেকে ফিরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, আবাহনী, মোহামেডান, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব কত জায়গায় যে কোচিং করালেন। তবে, নিয়মিত ছিলেন ইয়াং পেগাসাসের হয়ে এবং সেখান থেকে পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে ধানমণ্ডি ক্লাবে।
তবে, ইয়াং পেগাসাসের হয়ে দুঃখটাও পেয়েছিলেন বেশ। পাতিয়ালা থেকে ফিরেই দেখেছিলেন দিন রাতে পরিশ্রমের মিশেলে গড়া সেই ক্লাবটার চেহারা-সুরতই পালটে গেছে। দিন রাত শ্রম দেওয়া ক্লাবটার প্রতি অভিমান তো আর করতে পারেননা। কিন্তু কিছু কথা যেনো আর সইতে পারলেন না! ক্লাব কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় তাঁকে মাসিক বেতন ভিত্তিতে কোচ রাখা হবে! এই কথাটা যেনো জালালের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো। যে ক্লাবকে নিজেরটা সবটা দিয়েছেন সেখানেই কি’না বেতন নিয়ে চাকরি করবেন? এও কি সম্ভব!
পরে চিন্তা করলেন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে সরে যাওয়াই শ্রেয়! তাই সেখান থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। অবশ্য ওই আত্মাটা ঠিকই পড়ে ছিলো ইয়াং বয়েসের হয়ে।
মাঝে ১৯৮২ সালে ময়মনসিংহে খেলার জন্য এক দল নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় গিয়ে ছেলের আকিকা করবেন সেটাও ঠিক করে এসেছিলেন। ম্যাচ শুরুর আগে ড্রেসিংরুমে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমার ইচ্ছে, আজ যে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রান করবে, তার নামে ছেলের নাম রাখব।’ পরবর্তীতে নাজিম সিরাজি ওই ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪৮ রান করায় ছেলের নামও রাখেন নাজিম জালাল চৌধুরী!
এর আগে অবশ্য ১৯৭৯ সালে তিনি আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের কোচ হয়ে গিয়েছিলেন সেবার। তিনি টাইম পাস বলুন আর প্রোফেশন জীবনের মানেটাই বুঝতেন শুধু ক্রিকেট। এবার সেটা হতে পারে খেলার মাঠে নয়তো কলমের কালিতে – তিনি মিশে ছিলেন ক্রিকেটেই।
পাতিয়ালা থেকে ফেরার পর বছর খানেকের মধ্যেই সাংবাদিকতায় আসা। প্রথমে নিউ নেশন এরপর টাইমস। সব মিলিয়ে সাংবাদিকতায় ঢোকাটা বেশ সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাঁর বাবাও। অন্তত শিক্ষার মধ্যে যে আছে সে কারণেই! তবে, ইংরেজি মাধ্যমেই গেলেন সাংবাদিকতার জন্য।
সে কারণটাও জানিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে – প্রথম সুযোগটা ইংরেজিতে এসেছিলো বিধায়ই, তিনি সেই পথে হেঁটেছিলেন। অবশ্য এরপর দৈনিক বাংলার ক্রীড়া সম্পাদক ওস্তাদ মুনিরুজ্জমানের হাত ধরেই বাংলায় লিখা শুরু। প্রথমবার লিখা দেওয়ার পর থেকে তাঁর উপর প্রত্যাশা এতো বেড়ে যায় যে, নিয়মিত লিখার তাগাদা দেওয়ায় তিনি নিজেও পড়েন বিপাকে! সেখান থেকেই হয়ে উঠা ক্রীড়া লেখক হিসেবে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।
কিছু ক্ষেত্রে দুঃখ-কষ্টও আছে মনে। ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে গর্ডন গ্রিনিজের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তবে, বিসিবি দেওয়া সংবর্ধনায় দাওয়াত না পেয়ে বেশ আক্ষেপ করেছিলেন তিনি। বেতন না নিয়েও জাতীয় দলের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন অনেক সময়। সাংগঠনিক পর্যায়েও তিনি নিজের সেরাটা দিয়েছেন বিসিবির প্রয়োজন হলেই তাকে পাশে পেয়েছে, আবার প্রয়োজন শেষে খোঁজ নেয়নি বলেও একটা সময় বেশ আক্ষেপ করেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই খ্যাতিমান কোচ।
তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন না কখনোই। ক্রিকেটের সাথে থাকতে পারলেই যেনো ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন তিনি। সাংবাদিকতা খুব বেশি উপভোগ করতেন এমনটাও নয়। দু’কলম লিখতেও আলসেমি লাগতো। তাঁর পাড়াতেই থাকতেন কিংবদন্তি কবি ‘নির্মলেন্দ গুণ’।
কবির বাসায় কত আড্ডা দিয়েছেন ইয়ত্তা নেই, ক্রিকেটের বাইরে এই আড্ডা টাই উপভোগ করতেন বেশ। লেখার আগ্রহটা হারিয়েছিলেন নাকি ১৯৯৬ সালে! ‘কয়েক ছত্র ক্রিকেট’ নামে একটি রচনা সংকলন বের করেছিলেন সেসময়। এতো প্রিন্টিং মিস্টেক হয়েছিলো যে তিনি ভেবেছিলেন প্রথম যাত্রাতেই সব শেষ! আর সাহসে কুলায়নি নতুন কিছু সম্পাদনা করবেন।
তবে, ভেবেছিলেন কখনো পারলে আবারো লেখবেন। এবার হয়তো ভিন্ন কিছু। কিন্তু ক্রিকেটের বাইরে যে তিনি চিন্তাই করতে পারেনি কিছু। অবশ্য কলম ধরার আর সময় পেলেন কোথায়। পরপারে পাড়ি জমালেন এর আগেই! হয়তো বড় কোনো ভাবনা ছিলো! জীবনের শুরু থেকে শেষ পুরোটা কাটিয়ে গেলেন ক্রিকেটেই। যে ক্রিকেটকে শিক্ষক সমতুল্য করে মাথায় রেখে হেঁটেছেন দীর্ঘসময় সেই ক্রিকেট তাঁকে মনে রাখবে আজীবন।
বিদায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘সব্যসাচী’।