জীবনের মতো টেকসই

ছয় বার যুদ্ধে পরাজিত রবার্ট ব্রুস ধৈর্যের শিক্ষা নিয়েছিলেন একটা মাকড়শার কাছ থেকে।

সপ্তম ব্যর্থতার পরও মাকড়শাটা যখন চেষ্টা চালালো জাল বোনার, ব্রুস বুঝলেন জীবনে ‘না’ বলার সুযোগ নেই। আবার যুদ্ধে চললেন তিনি। এ কালে বেঁচে থাকলে রবার্ট ব্রুসের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারতেন শোয়েব মালিক।

ছয়-সাত বার নয়, দশ বার টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছেন এবং ফিরে এসেছেন। শেষবার ফিরেছিলেন ২০১৫ সালে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আবুধাবিতে ডাবল সেঞ্চুরিও করেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, ওই বছর তিনটি টেস্ট খেলার পর আবার নিজেই অবসর নিয়ে ফেলেন টেস্ট থেকৈ। এর আগ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়েই গেছেন।

আর এই লড়াই ও ফেরাটাই আসলে শোয়েব মালিক।

মালিকের ব্যাপারে আপনার এক হাজার আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু তার যে জীবনটাকে আকড়ে ধরে থাকার প্রবনতা, কিছুতেই হাল না ছাড়া এবং বারবার তাকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা; এগুলোকে আপনি ফেলে দিতে পারবেন না।

আমাদের উপমহাদেশের হিসেবে হয়তো আরেকটু বেশিই হবে। তারপরও মালিক লড়ে যাচ্ছেন। এখনও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শোয়েব মালিককে দলে রাখতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। এখনও শোয়েব মালিক পাকিস্তানকে ম্যাচ জেতান। আর এটাই তার ক্যারিয়ারের বিজ্ঞাপন।

সেই নব্বই দশকের শুরুতে ছোট্ট বেলায় ইমরান খানের ক্রিকেট ক্লিনিকে এসেছিলেন ব্যাটসম্যান হিসেবে। অথচ অনূর্ধ্ব-১৫ দলে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন বোলার হিসেবে। শোয়েব মালিকের এই পরিচয় নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধ যেন তার সারাটা ক্যারিয়ারের প্রতীক হয়ে আছে।

২০০১ সালে ১৯ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হয়েছিলো। ওই অভিষেক টেস্টের পরই বাদ পড়েছিলেন ইনজুরি আর টিম কম্বিনেশন মিলিয়ে। আবার দলে ফিরেছিলেন পরের বছরের মার্চে। এরপর আসলে ক্যারিয়ারে কখনোই টানা এক বছর টেস্ট দলে জায়গা ধরে রাখতে পারেননি। বল বা ব্যাট হাতে তেমন ধারাবাহিকতাও দেখাতে পারেননি। কখনো এক বছর, কখনো দু বছর দলের বাইরে থেকেছেন।

ওয়ানডেতে অবশ্য চিত্রটা ভিন্ন ছিলো। কার্যকর অলরাউন্ডার হিসেবে দলে জায়গা পাকাই ছিলো। এর মধ্যে জাতীয় দলে অধিনায়কত্বও করেছেন। এই ক্যারিয়ারের অস্থিতিশীলতা আরেকটা ব্যাপারের উল্লেখে বোঝা যাবে। ওয়ানডেতে ১ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত ব্যাটিং পজিশনে খেলতে নামার রেকর্ড আছে মালিকের। টেস্টেও পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন পজিশনে ব্যাট করতে নেমেছেন।

২০১০ সালের দিকে শোয়েব মালিকের ক্যারিয়ারের এপিটাফও লিখে ফেলা হয়েছিলো।

২০০৯ সালে তিনি অধিনায়কত্ব হারান। ২০১০ সালের মার্চে দলের ভিতরে গোলমাল করে এক বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা পান। নিষেধাজ্ঞাও শোয়েবের জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগে দলে গোলমাল, ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ পাতানো থেকে শুরু করে বোলিং অ্যাকশন; নানা কারণেই নিষিদ্ধ হয়েছেন। এই দফা নিষেধাজ্ঞাটা ছিলো তাত্পর্যপূর্ণ। এর এক মাস পরই দীর্ঘদিন ধরে গুঞ্জন চলতে থাকা বিয়েটা করে ফেলেন। ভারতীয় টেনিস তারকা সানিয়া মির্জার সঙ্গে তার এই বিয়ে নিয়েও কম পানি ঘোলা হয়নি।

বিয়ের মাস খানেক আগেই নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর শোয়েব মালিক ক্রিকেট থেকে একরকম দূরেই সরে যান। প্রায়শ তাকে দেখা যেতো সানিয়ার খেলা চললে দর্শক সারিতে বসে থাকতে। এমন অবস্থা থেকে আবার কী ক্রিকেটে ফেরা যায়? মালিক ফিরলেন। ছয় মাসের মধ্যেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে ওয়ানডেতে ফিরলেন। নিয়মিত খেলেও চললেন। কিন্তু টেস্ট যেন তার জন্য নিষিদ্ধই হয়ে গেলো।

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর ২০১০ সালেই তিনটে টেস্ট খেলেছিলেন। সর্বশেষ টেস্ট খেলেছিলেন সে বছর আগস্টে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বার্মিংহামে। আবার সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ফিরে এলেন পাঁচটি বছর পর। তাও আবার কী নাটকীয় হলো প্রত্যাবর্তন।

মালিকের ব্যাপারে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে কমপক্ষে ৪৫টা দলের হয়ে স্বীকৃত ক্রিকেট খেলেছেন। এটা সম্ভবত রেকর্ড। এই রেকর্ড বলে দেয়, কতটা বিচিত্র সব পরিবেশে খেলার ক্ষমতা আছে তার।

একটা ব্যাপার ভেবে দেখুন, ২০০০ সালের আগে অভিষেক এমন কোনো খেলোয়াড় এখন আর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট খেলেন না। কিন্তু ১৯৯৯ সালে অভিষিক্ত শোয়েব মালিক এই প্রায় দুই যুগ পার করে এখনও লড়ে যাচ্ছেন আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে। এটাই তার বৈশিষ্ট্য।

শোয়েব মালিক মানেই এই নাটকীয়তা। শোয়েব মালিক মানেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিরে আসা।

আমরা জানি না, শোয়েব মালিকের এই লড়াই আর কতকাল চলবে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এই মানুষটার লড়াই আমাদের ফিরে দাড়ানোর প্রেরণা যোগাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link