পুরো নাম গ্লেন ডোনাল্ড ম্যাকগ্রা। জন্মেছিলেন ১৯৭০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, নিউ সাউথ ওয়েলসের ডাবো নামক এলাকায়। তাঁর বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটের প্রথম পাঠ সবকিছুই সেখানে। ছেলেবেলায় ম্যাকগ্রার ভেতরে প্রথম বোলিং প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলসের কোচ ও সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার ডগ ওয়াল্টার্স।
ছেলেবেলা থেকেই ম্যাকগ্রার মধ্যে শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। একটা পানিভর্তি ড্রামকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে টার্গেট করে ঘন্টার পর ঘন্টা বোলিং অনুশীলন করতেন ম্যাকগ্রা। এটা তার ছেলেবেলার পুরনো অভ্যাস।
পেশাদার ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে ১৮ বছর বয়সে নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে সিডনিতে পাড়ি জমান ম্যাকগ্রা। সিডনির প্রতিযোগিতামূলক স্থানীয় টুর্নামেন্ট ‘গ্রেড ক্রিকেটে’ অংশ নেন সাদারল্যান্ড ক্লাবের হয়ে।
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে জন্মভূমি নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক। মাত্র ৮ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৩ সালে পার্থে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক; মার্ভ হিউজের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে। অভিষেক টেস্টে ম্যাকগ্রার শিকার ছিল ৩ উইকেট।
মাসখানেক পরই রঙিন পোশাকে আন্তর্জাতিক অভিষেক প্রোটিয়াদের বিপক্ষে, এমসিজিতে। খুব দ্রুতই ঘটে গিয়েছিল সবকিছু, ঠিক যেন স্বপ্নের মত।
ম্যাকগ্রার ডাক নাম ‘পিজিয়ন’ মানে কবুতর। সাদা কবুতরের মতই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেলে দুলে বল করতেন তিনি। এই নামটা তাঁকে দিয়েছিলেন সাবেক কোচ ব্র্যাড ম্যাকনামারা। তিনি বলতেন, ‘You’ve stolen a pigeon’s legs, Mcgrath.’
১৯৯৫ সালে ক্যারিবিয়ান সফরে ৩-২ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ওই সিরিজ হারটাকে দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা ক্যারিবীয় সাম্রাজ্যের পতন হিসেবে দেখেন অনেকে। ১৭ উইকেট নিয়ে তাতে বড় অবদান ছিল ২৫ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার ম্যাকগ্রার।
ওই সিরিজের পর থেকেই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক ম্যাচ জিততে থাকে অস্ট্রেলিয়া, ম্যাকগ্রাও ধীরে ধীরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন বিশ্ব ক্রিকেটের শীর্ষ বোলারদের একজন হিসেবে।
১৯৯৫, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০১ ও ২০০৫ – টেস্টে এক পঞ্জিকাবর্ষে ৫০ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন ৫ বার। ১৯৯৯ সালে ইতিহাসের ‘প্রথম’ ও ‘একমাত্র’ বোলার হিসেবে টেস্ট এবং ওয়ানডে উভয় ফরম্যাটেই ৫০টির বেশি উইকেট লাভের অনন্য কীর্তি গড়েন ম্যাকগ্রা।
২০০০ সালে প্রথমবারের মত কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন ম্যাকগ্রা। উস্টারশায়ারের হয়ে সেবারের ফার্স্ট ক্লাস মৌসুমে ১৪টি ম্যাচ খেলেন তিনি। উইকেট পেয়েছিলেন ৮০টা, গড় মাত্র ১৩.২১!
উস্টারের হয়ে খেলার সময়কার একটি ঘটনা। সতীর্থ শেন ওয়ার্নের সাথে একবার হাজার ডলার বাজি ধরেছিলেন ম্যাকগ্রা। বলেছিলেন এবারের কাউন্টি সিজনে একটা ফিফটি নাকি করেই ছাড়বেন! এবং সেটা তিনি করেও দেখিয়েছিলেন। নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ক্যারিয়ারের প্রথম পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের (৫৫ রান) ইনিংস খেলার পর বল হাতে ৪১ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন আট উইকেট।
১২৪ টেস্টে ২১.৬৪ গড়ে ৫৬৩ উইকেট। টেস্টে কমপক্ষে ৪০০ উইকেট পেয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে বোলিং গড়ে (২১.৬৪) ম্যাকগ্রার চাইতে এগিয়ে আছেন কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান গ্রেট স্যার কার্টলি অ্যাম্ব্রোস (২০.৯৯)।
ব্যাট হাতে ম্যাকগ্রা ছিলেন রীতিমতো ‘হাসির পাত্র’। টেস্ট এবং ওয়ানডে – দু’বারের অভিষেকেই উপহার পেয়েছেন ‘গোল্ডেন ডাক’! অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে টেস্টে সর্বাধিক ৩৫টা ডাকের রেকর্ডটাও ম্যাকগ্রার কৃতিত্ব। নিজে বারবার ০ রানে আউট হতেন বলে সেই ঝালটা তিনি মিটিয়েছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ওপর। টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ ‘১০৪ বার’ প্রতিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের ০ রানে আউট করেছেন ম্যাকগ্রা!
টেস্টে সবচেয়ে কম রান খরচায় ম্যাচে ১০ উইকেট শিকারের রেকর্ডটি গ্লেন ম্যাকগ্রার। ২০০৪ সালে পার্থে পাকিস্তানের বিপক্ষে দু’ইনিংস মিলিয়ে মাত্র ২৭ রানে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন ম্যাকগ্রা। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৪৯১ রানের বিশাল ব্যবধানে।
ওই ম্যাচেরই প্রথম ইনিংসে মাত্র ২৪ রানে ৮ উইকেট পেয়েছিলেন ম্যাকগ্রা; যা টেস্ট ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার।
২০০৪-০৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাকগ্রা পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের একমাত্র টেস্ট ফিফটি। তাঁর ৬১ রানের ইনিংসটা টেস্ট ইতিহাসে ১১ নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর।
‘এগারো নম্বর’ ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও একসময় ছিল ম্যাকগ্রার দখলে। ৬০৩ রানের রেকর্ডটা পরে ভেঙে দেন শ্রীলংকার মুত্তিয়া মুরালিধরন (৬২৩)।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব ফরম্যাট মিলিয়ে ম্যাকগ্রার শিকার ৯৭৯ উইকেট যা ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। টেস্টে ৫৬৩ উইকেট নিয়ে হয়েছেন ইতিহাসের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি এবং সফলতম ফাস্ট বোলার।
২০০০ সালের ১লা ডিসেম্বর, ম্যাকগ্রা তার টেস্ট ক্যারিয়ারের একমাত্র হ্যাটট্রিকটা পেয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, পার্থের ওয়াকায়। পরপর ৩ বলে ম্যাকগ্রার শিকার হওয়া তিন ব্যাটসম্যান ছিলেন যথাক্রমে শেরউইন ক্যাম্পবেল, ব্রায়ান লারা ও জিমি অ্যাডামস।
মজার ব্যাপার হল, ব্রায়ান লারার উইকেটটা ছিল ম্যাকগ্রার ৩০০ তম টেস্ট শিকার। এবং সেটা তিনি নিয়েছিলেন রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে।
টেস্টে ম্যাকগ্রার ‘বানি’ ছিলেন মাইক আথারটন। সাবেক এই বাঁহাতি ইংলিশ ওপেনারকে মোট ১৯ বার আউট করেছেন ম্যাকগ্রা। নির্দিষ্ট কোন ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে টেস্টে কোন বোলারের এটাই সর্বোচ্চ সাফল্যের রেকর্ড।
যেকোন অজি কিংবা ইংলিশ ক্রিকেটারের গ্রেটনেসের মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় অ্যাশেজকে। গ্লেন ম্যাকগ্রা সেখানেও রেখেছেন তাঁর দৃপ্ত পদচারণা। ক্যারিয়ারে মোট ২৯ বার ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছেন তিনি; যার ১০ বারই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
১৯৯৭ সালের অ্যাশেজে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট খেলেন ম্যাকগ্রা। প্রথম ম্যাচেই ৩৮ রানে ৮ উইকেট নিয়ে নাম ওঠান লর্ডসের অনার্স বোর্ডে।
ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত ২০০৫ সালের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অ্যাশেজ সিরিজে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দুটো ম্যাচে (ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ও ট্রেন্টব্রিজ) ইনজুরির কারণে খেলতে পারেন নি ম্যাকগ্রা। ফলশ্রুতিতে দুটো ম্যাচেই হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে ১৯ বছর পর অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করেছিল ইংলিশরা।
ম্যাকগ্রার অনুপস্থিতিকেই সেবার অস্ট্রেলিয়ার হারের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করেছিলেন অনেকে। সেই সিরিজেই টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন ম্যাকগ্রা। লর্ডসের মাটিতে ম্যাকগ্রার ৫০০ তম শিকারে পরিণত হয়েছিলেন সাবেক ইংলিশ ওপেনার মার্কাস ট্রেসকোথিক।
২০০৫ সালের অক্টোবরে ‘আইসিসি সুপার সিরিজে’ অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে কোর্টনি ওয়ালশকে (৫১৯ উইকেট) টপকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকের কীর্তি গড়েন ম্য্যকগ্রা। টেস্ট ক্যারিয়ারের ৫২০ তম শিকার হিসেবে ম্যাকগ্রার আরও একটি মাইলফলকের অংশীদার হয়েছিলেন ব্রায়ান লারা।
২০০৬-০৭ সালের ফিরতি অ্যাশেজেই ইংলিশদের ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে ‘মধুর প্রতিশোধ’ নেয় অস্ট্রেলিয়া। তাতে বড় অবদান ছিল ম্যাকগ্রারও, মাত্র ২৩.৯০ গড়ে নিয়েছিলেন ২১ উইকেট। ব্রিসবেনের গ্যাবায় অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচটা ছিল ম্যাকগ্রার ‘কামব্যাক’ টেস্ট। ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য প্রায় আটটি মাস ক্রিকেট থেকে পুরোপুরি দূরে ছিলেন ম্যাকগ্রা। ফিরেই দুর্দান্ত বোলিং করে নেন ৬ উইকেট।
২০০৭ সালের ২-৫ জানুয়ারি, সিডনিতে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা খেলেছিলেন ম্যাকগ্রা। ওই ম্যাচের মধ্য দিয়েই টেস্ট ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানান তিনি। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বলটিতেও উইকেট নিয়েছিলেন ম্যাকগ্রা।
বড় সিরিজ বা টুর্নামেন্টের আগে প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যানটিকে টার্গেট করা এবং তাকে আউটের ঘোষণা দেয়াটা ম্যাকগ্রার পুরনো অভ্যাস। এবং তাতে প্রায়ই সফলও হতেন তিনি।
টার্গেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্যারিয়ারে মাত্র দু’বার ব্যর্থ হতে দেখা গেছে তাঁকে। ২০০২-০৩ অ্যাশেজে মাইকেল ভন (সিরিজে তিনটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন ভন) এবং ২০০৫ অ্যাশেজে অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসকে (দুটি সেঞ্চুরি) আউট করতে ব্যর্থ হন ম্যাকগ্রা।
ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলারদের তালিকায় ম্যাকগ্রার অবস্থান ৭ম। ২৫০টি ওয়ানডে খেলে মাত্র ২২.০২ গড়ে তাঁর অর্জন ৩৮১ উইকেট। ম্যাচে ৫ উইকেট দখল করেছেন ৭ বার, ৪ উইকেট ৯ বার।
ওয়ানডেতে কমপক্ষে ৩০০ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং গড় (২২.০২) ম্যাকগ্রার। শন পোলকের (৩.৬৭) পর ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সেরা ইকোনমি রেটও (৩.৮৮) গ্লেন ম্যাকগ্রার দখলে।
বিশ্বকাপের সবচাইতে সফল বোলার কে? এই প্রশ্নের কেবল একটাই উত্তর হতে পারে গ্লেন ম্যাকগ্রা! ওয়ানডেতে যে ১৫ বার ম্যাচসেরা হয়েছেন, তার ৬ বারই বিশ্বকাপে!
১৯৯৬ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ৪টি বিশ্বকাপ খেলেন ম্যাকগ্রা। ৪ বারই ফাইনালে উঠেছিল অস্ট্রেলিয়া এবং একমাত্র ‘৯৬ বিশ্বকাপ বাদে ৩ বারই হয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপটাই ছিল তাঁর শেষ টুর্নামেন্ট। ২৬ উইকেট নিয়ে ম্যাকগ্রা হয়েছিলেন ‘ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট’, অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল টানা তৃতীয় শিরোপা।
বিশ্বকাপ শেষে দেখা গেল, ম্যাকগ্রা হচ্ছেন বোলিংয়ের ‘শচীন টেন্ডুলকার’! বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে বোলিং রেকর্ডের প্রায় সবই ম্যাকগ্রার দখলে!
- বিশ্বকাপের সব আসর মিলিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট – ৭১টি
- বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট – ২৬টি, ২০০৭ বিশ্বকাপে।
- বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগার – ১৫ রানে ৭ উইকেট, নামিবিয়ার বিপক্ষে, ২০০৩ বিশ্বকাপে।
- বিশ্বকাপের সর্বাধিক মেডেন ওভার – ৪২টি।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মটা এসেছিল নব্বই দশকের মধ্যভাগে, একঝাঁক বিশ্বসেরা ‘চ্যাম্পিয়ন’ ক্রিকেটারের হাত ধরে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা।
শুধু গতি দিয়ে নয়, নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেংথের সাথে হালকা সিম মুভমেন্ট, বুদ্ধিমত্তা আর কনসিস্টেন্সি দিয়েও যে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ওপর ছড়ি ঘোরানো যায়, ক্যারিয়ার জুড়ে সেটাই দেখিয়েছেন কিংবদন্তী এই পেসার।
নিখুঁত সিম প্রেজেন্টেশন আর রিস্ট একশনের কারনে বলকে মুভ করাতে পারতেন উইকেটের দুদিকেই। হাই আর্ম একশন আর ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার শারীরিক সুবিধা কাজে লাগিয়ে আদায় করে নিতেন এক্সট্রা বাউন্স ও ক্যারি।
মূলত লেংথ ও একুরেসি নির্ভর বোলার হলেও ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে আয়ত্ত করেছিলেন বাতাসে বলকে সুইং করানোর বিভিন্ন কলাকৌশল। তাছাড়া অফ কাটার, স্লোয়ার বাউন্সার কিংবা ইয়র্কারের মত বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন থাকায় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ম্যাকগ্রা ছিলেন অত্যন্ত কার্যকরী একজন বোলার।
অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরে, গুড লেন্থ বরাবর একটার পর একটা, ওভারের পর ওভার বল করে যেতে পারতেন ম্যাকগ্রা। অবিশ্বাস্য একুরেসির সাথে দুর্দান্ত কন্ট্রোলের জন্য একসময় ম্যাকগ্রার নামই হয়ে যায় ‘বোলিং মেশিন’।
ব্যাটসম্যানের টেকনিক ও টেম্পারমেন্টের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিতে পারত এই বোলিং মেশিন! মাথা খাটিয়ে যেকোন ব্যাটসম্যানের দুর্বলতাও পড়ে ফেলতে পারত মুহূর্তের মধ্যেই।
ব্যাটসম্যানকে অফ স্টাম্পের বাইরে একটা লুপের মধ্যে আটকে রাখতেন ম্যাকগ্রা। ফলে বেশিরভাগ সময় ব্যাটসম্যান নিজেই উইকেট বিলিয়ে আসত অধৈর্য হয়ে।
ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে একটি স্পেশাল ডেলিভারি শিখেছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা। ‘স্প্লিট ফিঙ্গার বল’ যার আরেক নাম ‘স্পাইডার’।
স্প্লিট ফিঙ্গার বলটি করার নিয়ম হল, এর সিম পজিশন থাকবে নরমাল ‘সিম আপ’ ডেলিভারির মতই স্ট্রেট; কিন্তু তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে যথেষ্ট ফাঁক থাকবে। তার মানে দুই আঙুল সিমের দু’দিকে ‘স্প্লিট’ অর্থাৎ দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় থাকবে। ফলে একই আর্ম স্পিডে বলটার রিলিজ হবে কিছুটা দেরিতে যা ব্যাটসম্যানের পক্ষে খালি চোখে পিক করা এককথায় অসম্ভব।
২০০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ারে মনোনীত হন গ্লেন ম্যাকগ্রা। ২০০৮ সালের ২৬ জানুয়ারি, ক্রিকেটে অবদানের জন্য ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’র সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে জায়গা করে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ‘হল অব ফেম’-এ। ২০১২ সালের ১ নভেম্বর, সিডনিতে সপ্তম ‘বার্ষিক ব্র্যাডম্যান অ্যাওয়ার্ড’ অনুষ্ঠানে বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয় তাঁকে। ২০১৩ সালে আইসিসির ‘হল অফ ফেম’-এর গর্বিত সদস্যপদ লাভ করেন।
ম্যাকগ্রার বর্তমান স্ত্রী সারা লিওনার্দি। ম্যাকগ্রার প্রথম স্ত্রী জেন ম্যাকগ্রা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২০০৮ সালে। বর্তমানে ‘ম্যাকগ্রা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থার প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন ম্যাকগ্রা। এই সংগঠনের প্রাপ্ত অর্থ স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়।
ভারতের চেন্নাইতে অবস্থিত বিখ্যাত এম.আর.এফ পেস ফাউন্ডেশনের পরিচালক হিসেবে ডেনিস লিলির স্থলাভিষিক্ত হন ম্যাকগ্রা। প্রায় ২৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন লিলি।