কথা হচ্ছিল ১৯৮৩ সালের ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট সিরিজ নিয়ে। ম্যালকম মার্শাল আর গর্ডন গ্রিনিজের দাপটে ধরাশায়ী হওয়ার পড় দ্বিতীয় টেস্ট দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলায়। বেশ ভয়ে ভয়েই ছিলাম সবাই। খবরের কাগজে পড়লাম ভারতের নেট প্র্যাকটিসের সময় নাকি কয়েকজন ছোকরা সানিকে দেখে ‘ওই মার্শাল আসছে!’ বলে বিদ্রুপ করেছে।
সানির খুব বড় সমর্থকও বোধহয় পরবর্তী ঘটনার জন্যে তৈরি ছিল না। এমন নয় যে গাভাস্কার এর আগে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেন নি কিন্তু এই মেজাজ সম্পূর্ণ আলাদা। ধীর, স্থির, টুক টুক করে ইনিংসের ভীত তৈরি করা সুনীল গাভাস্করের বদলে যেন বিপক্ষ দলের ভিভ রিচার্ডসের আত্মা ভর করেছে তাঁর শরীরে। বহুদিন পর স্বজত্নে তুলে রাখা হুক আর পুল শট দুটো নিজের তূণীর থেকে আবার বের করে সানি প্রতি আক্রমণ করলেন মার্শাল – হোল্ডিংকে।
মাত্র ৩৭ বলে সেদিন হাফ সেঞ্চুরি আর ৯৪ বলে করা সেঞ্চুরি এলো সেদিন সানির ব্যাট থেকে। সেই সঙ্গে স্যার ডনের পাশে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করার রেকর্ডের যুগ্ম অংশীদার হলেন। আমরাও আবার নিজের আত্মসম্মান ফিরে পেলাম (পরবর্তী কালে মার্শালকে কেউ ‘ওই গাভাস্কার আসছে’ বলে খেপিয়েছিলেন কিনা সেটা জানা নেই)।
শেষ পর্যন্ত আমরা টেস্ট সিরিজ হারলাম ৩-০ ব্যাবধানে, ওয়ান ডে তে হাল আরও খারাপ, ৫-০। বিশ্বজয়ীদের সম্মান গড়াগড়ি খাচ্ছে। তবে তার মধ্যেও সুনীল আর কপিল স্বমহিমায় উজ্জ্বল – শেষ টেস্টে সুনীলের 236 তাকে স্যার ডনেরও এক ধাপ ওপরে নিয়ে বসাল, অন্যদিকে অক্লান্ত কপিল প্রায় একাই লড়ে গেল বিশ্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটিং লাইন আপের বিরুদ্ধে।
সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটিং নিয়ে আজ আর নতুন করে বলার কিছু নেই। উনি যে সময়ে ক্রিকেট খেলেন তখন পৃথিবীতে ফাস্ট বোলারদের ছড়াছড়ি – শুধুমাত্র স্কাল ক্যাপ আর নিখুঁত টেকনিকের জোরে (সঙ্গে অবশ্যই একবুক সাহসও ছিল) উনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সেই যুগে নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমান করেন।
ভিভ রিচার্ডস, গ্রেগ চ্যাপেল আর জাভেদ মিয়াদাদের মতো ব্যাটসম্যানের সঙ্গে একই নি:শ্বাসে উচ্চারিত হতো ওনার নাম। তবে যেহেতু সানি ছিলেন ওপেনার, তাঁর কাজ অন্যদের তুলনায় অনেকটাই কঠিন ছিল। আর ভিভ আর গ্রেগকে তাঁদের নিজেদের দেশের খুনে বোলারদের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে হত না – এটাও কম বড় এডভান্টেজ নয়।
পেস – স্পিন দুই ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন সানি। মার্শাল, ইমরান, লিলি, রবার্টসের মতো বোলারদের সামলানোর সাথে সাথে কাদির – আন্ডারউড – এডমন্ডসের বিরুদ্ধেও বিশেষ অসুবিধেতে পড়তে দেখা যায় নি তাঁকে। তবে যারা ওনার ব্যাটিং খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাদের মতে সুনীল গাভাস্কারের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল ওনার মন:সংযোগ করার ক্ষমতা। অস্ট্রেলিয়া আর পাকিস্তানের প্লেয়াররা তখনও উল্টোপাল্টা কথা বলে বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের মন:সংযোগ নষ্ট করে দেওয়ার জন্যে বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) ছিলেন। তবে তাতে সানির ব্যাটিঙে কোন প্রভাব পড়ে নি কোনদিন। উনি নাকি ওদের কথা শুনতেই পেতেন না ব্যাট করার সময়।
সানিকে আমরা ‘লিটল মাস্টার’ বলতাম। আরও একটু আগের ক্রিকেট প্রেমীরা অবশ্য তাতে একটু আধটু ক্ষুব্ধ হতেন কারণ তাঁদের মতে আমাদের অরিজিন্যাল লিটল মাস্টার হচ্ছেন গুন্ডাপ্পা রঙনাথ বিশ্বনাথ। রেকর্ড বই ঘাঁটলে আজ আর বিশ্বনাথকে আর যাই হোক ‘গ্রেট’ ব্যাটসম্যান বলে মনে হয় না। তবে যারা তাঁর খেলা চাক্ষুস দেখেছেন তাঁদের অনেকেরই মতে ভিশি সানির চেয়েও উঁচুমানের ব্যাটসম্যান ছিলেন (এবং এই গুণমুগ্ধের দলে স্বয়ং সানি নিজেই রয়েছেন।
যদিও তাতে কিছু প্রমান হয় না কারণ ভিশিও সানির ব্যাটিংয়ের বেশ বড় ভক্ত)। তাঁর স্ট্রোক প্লে যারাই দেখেছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন ভিশির শ্রেষ্ঠত্ব। দুরন্ত রবার্টসের মোকাবিলা করে ওনার অপরাজিত ৯৭ বা অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে লিলির আগুনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১১৪ রানের ইনিংস (এই টেস্ট আমাদের কাছে বিখ্যাত কপিলের ২৮ রানের বিনিময়ে ম্যাচ জেতানো স্পেলের জন্যে যদিও সেই টেস্টে ম্যান অব দ্য ম্যাচ ভিশিই হয়েছিলেন) ভারতের ব্যাটসম্যানের খেলা দুটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে যে খোদ লিলি এবং রবার্টস দু’জনেই ভিশিকে সানির চেয়ে উঁচু আসনে রাখতেন।
তবে সানির স্বপক্ষে দুটো পয়েন্ট রয়েছে। এক, ওনার দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতা না থাকলে একজন ব্যাটসম্যানের ওপর নির্ভর করতে পারে না তার দেশ। দুই, সানির রানের খিদে। সানির নিজের কথায় একশোর কমে কোন আত্মসম্মানেই ব্যাটসম্যানেরই সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয়। সানি নিজে তো একশোতেও সন্তুষ্ট হতেন না সবসময়। অন্যদিকে ভিশি গুরুত্বহীন ম্যাচে শুধু রেকর্ড ভালো করার লক্ষ্যে ব্যাটিং করে যাওয়ায় তেমন আগ্রহী ছিলেন না। তখন বরং তিনি দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার কাজে মন দিতেন।
এ সেই চিরাচারিত বিবাদ – একদলের নেতৃত্বে রয়েছেন ডন ব্র্যাডম্যানের মতো ব্যাটসম্যান – সেই দল যে কোন পরিস্থিতিতে, যে কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যত বেশি সম্ভব নিয়মিত রান করার নীতিতে বিশ্বাস করেন। অন্যদলের ব্যাটসম্যানেরা, এই দলে আবার রয়েছেন ভিক্টর ট্রাম্পার, ভিভ রিচার্ডস বা বিশ্বনাথের মতো প্রাতস্মরণীয় ক্রিকেটাররা, চ্যালেঞ্জ না থাকলে নিজের সেরা খেলাটাকে সবসময় বের করতে পারেন না বা চান না। এমন কি অনেকসময় উইকেট ছুঁড়ে আসতেও দেখা গেছে তাদের (কিথ মিলার একবার ইচ্ছাকৃত উইকেট বিসর্জন দিয়ে নাকি স্যার ডনের বিরাভাজন হন)। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম দলের ব্যাটসম্যানদের রেকর্ড দ্বিতীয় দলের চেয়ে অনেকটাই ভালো হয় তবে ক্রিকেট রোম্যান্টিকরা দ্বিতীয় দলের ব্যাটসম্যানদের খেলা দেখতে বেশি পছন্দ করেন।
আধুনিক ক্রিকেটপ্রেমীরা অবশ্য ‘লিটল মাস্টার’ বলতে শচীন টেন্ডুলকার নামের আরও এক জিনিয়াসকে বোঝেন। ষোল বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে পদার্পণ করার পর থেকেই ছেলেটি ক্রিকেট জগতের বিস্ময় বালক। তার ব্যাটিং দেখে স্বয়ং ডনের নিজের ব্যাটিংয়ের কথা মনে পড়ে গেছিল। সম্মতি জানিয়েছিলেন ওনার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হারল্ড লারউডও। একসময় ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডই এই ছোটখাটো মানুষটি দখল করে ফেলেন (শুধু টেস্ট বা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ড দুটি সচিনের সময়েরই আরও এক গ্রেট ব্যাটসম্যান ব্রায়ান চার্লস লারার দখলে)।
নিজের ক্রিকেট জীবনের প্রথম ১২-১৩ বছর সচিন খুবই আকর্ষণীয় স্ট্রোকপ্লেয়ার ছিলেন। ওনার সেই সময়ের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হন নি এমন ক্রিকেটপ্রেমী বিরল। তারপর ধীরে ধীরে রিফ্লেক্স কমে আসার ফলে (সেই সময় ‘টেনিস এলবো’তে ভুগতেও আরম্ভ করেন তিনি) নিজের ব্যাটিংয়ের ধরণ বদলে রান একুমুলেটর হয়ে ওঠেন টেন্ডুলকার। তাতে ওনার রেকর্ডে তেমন প্রভাব না পড়লেও অনেকের মতে এই পরিবর্তনের ফলে ওনার ব্যাটিঙের আকর্ষণ অনেকটাই কমে যায়। তবে তখন আর ভারত শুধু ওনার ওপরই নির্ভরশীল নয় – দলে এসে গেছে, বা বলা ভালো নিজের জায়গা পোক্ত করে ফেলেছেন আরও চারজন দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান – শেবাগ, দ্রাবিড়, সৌরভ আর লক্ষণ। তবে এটা ঠিক যে শচীনের মতো কি টেস্ট, কি একদিনের ম্যাচে দলকে একা আর কেও টানেন নি।
তবে লিটল মাস্টারদের নিয়ে লেখায় আরও একজনের উল্লেখ না করলে খুব না ইন্সাফি হবে। তাঁর নাম পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদ। আর যেহেতু উনি ভিশি – সানির চেয়েও আগের জমানার ক্রিকেটার, অরিজিন্যাল লিটল মাস্টারের তকমাটা ওনারই প্রাপ্য। বিশাল ইনিংস গড়ার ব্যাপারে ওনার দক্ষতা লিজেন্ডারি। দিন দুয়েক আগে সেই প্রেক্ষিতে একটা ঘটনা জানতে পারলাম যেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৪৭৩ রানে পেছিয়ে পাকিস্তান যখন ফলো অন করে আবার ব্যাট করতে নামল তখনও ম্যাচের প্রায় তিন দিন বাকি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এই পরিস্থিতিতে ম্যাচ বাঁচানো যায় না কিন্তু তবুও হানিফ মোহাম্মদ কোমর বেঁধে সেই অসাধ্য সাধনে নেমে পড়লেন। বেশ কয়েকটা ছেলে তাল গাছে চেপে ম্যাচটার দিকে নজর রাখছিল। চতুর্থ দিনের খেলার মধ্যে সূর্য যখন মধ্য গগনে তখন রোদ্দুরের তেজেই হোক বা হানিফের টুক টুক ব্যাটিঙের প্রভাবে ঘুম এসে যাওয়ার কারনেই হোক, একটি ছেলে গাছ থেকে দুম করে মাটিতে পড়ল – প্রায় চল্লিশ ফুট নিচে। জ্ঞানহীন অবস্থায় হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল ছেলেটিকে।
চব্বিশ ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফেরা মাত্রই ছেলেটির প্রথম প্রশ্ন ছিল – ‘হানিফ আছে এখনও?’
আজ্ঞে হ্যাঁ, হানিফ তখনও ব্যাট করছিলেন।
৯৭০ মিনিট ধরে হানিফের সেই ৩৩৭ রানের অত্যাশ্চর্য ইনিংস আজও সময়ের বিচারে টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে লম্বা ইনিংস। তারই কাঁধে ভর করে ম্যাচ ড্র করে পাকিস্তান।
সম্ভবত এই ইংসেরই অনুপ্রেরনায় একবার বিশ্বকাপে সানি পুরো ৬০ ওভার ব্যাট করে ৩৬ রানের এক অত্যাশ্চর্য ইনিংস খেলেন। উনিও বোধহয় ম্যাচটা জেতা সম্ভব নয় (ইংল্যান্ড সম্ভবত ৩৩৪ রান করেছিল আগে ব্যাট করে) মনে করে ড্র করার চেষ্টা করছিলেন।
কিছুদিন পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে স্যার ডনের ৪৫২ রানের ইনিংসের রেকর্ড ভেঙ্গে ৪৯৯ রান করেন হানিফ। পাকিস্তানের ড্রেসিংরুমে ঢুকে সেই মানুষটিকে দেখতে চান ডন যে তাঁর রেকর্ড ভেঙ্গেছে।
‘আরে, এ তো নেহাতই ছোট্ট একটা মানুষ! আমি ভেবেছিলাম যে আমার রেকর্ড ভাঙল সে অন্তত ছয় ফুট দুই ইঞ্চির উচ্চতার কেও হবে।‘
ক্রিকেট দেবতা অবশ্য ছোটখাটো মানুষদের প্রতি অহেতুক স্নেহ প্রদর্শন করে এসেছেন চিরকালই। স্বয়ং ডনও খুব একটা লম্বা ছিলেন না। আর আধুনিক কালেও মোটামুটি খর্বকায় লারা – পন্টিং – জয়বর্ধনের মতো ব্যাটসম্যানেরাও বেশ দাপটের সঙ্গেই রাজত্ব করেছেন ক্রিজের ওপর। উচ্চতার দিক দিয়ে এরা ‘লিটল মাস্টার’ হওয়ার দাবীদার না হলেও ব্যাটিংয়ের যে মাস্টার ছিলেন সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।