দক্ষিণ বঙ্গের মানুষেরা এই আবহাওয়ার সঙ্গে বেশ পরিচিত। আকাশের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বুঝে যায় তাদের করণীয় কী? এরকম অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ তাদের অচেনা নয়। ঝড়-জলের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য হুটহাট এমন ঝড় আসা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ম্যানচেস্টার আর লিভারপুলের অবস্থাও আজ অনেকটা এরকমই। পরিবেশোটা আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা, রাত সাড়ে দশটা বাজলেই যে ঝড় উঠবে অ্যানফিল্ডে।
ফুটবল ইতিহাসে দ্বৈরথ কম নেই। দেশ ঘুরলেই দেখা যায় দ্বৈরথের একেকরূপ। তবে সবজায়গাতেই একটা জিনিস কমন, ম্যাচের এক-দেড় সপ্তাহ আগে থেকে দুই দলের সমর্থকদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথাবার্তা বন্ধ। মানিকজোড় দুই বন্ধু হলেও সে কয়দিন যেন কাছে মেশা মহাপাপ। যার সাথে জীবনে কখনও কথাও হয়নি, একই ক্লাব সমর্থন করতে দেখে সেও পরম আপনজন। হালের আবাহনী-মোহামেডান থেকে বার্সা-রিয়াল সবজায়গাতেই একই চিত্র, একই ঘটনা কপি-পেস্ট করে বসিয়ে দেওয়া শুধু। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর লিভারপুল তো সেরের উপর সোয়া সের।
দ্বৈরথ মূলত দুই দলের শত্রুতা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতার গল্প। তবে প্রতিটি দলের এই গল্পের পেছনে মূলত হাত থাকে পারিপার্শ্বিক অবস্থানের। রাইভাল হিসেব করা হয় দুইভাবে, নিজ শহরের ‘সিটি রাইভালরি’ আর দুই শহরের মধ্যে ‘ডার্বি রাইভালরি’। ওল্ড ফার্ম ডার্বি, ডার্বি ডি’ইতালিয়া, জার্মানির ডার ক্লাসিকো কিংবা স্প্যানিশ এল ক্লাসিকো, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একই শহরের না হওয়ার কারণে তাদের দ্বন্দ্ব মূলত হয় রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর। ইংলিশ ফুটবলের রেড ডার্বির সূচনা দ্বিতীয়টা থেকে।
ইংল্যান্ডে তখন ভদ্রলোকের খেলা বলে ক্রিকেটের পরিচিতি বেশ উপরে। বিত্তশালী-ধনবান ব্যাক্তিরা সময় পেলেই সাদা-শুভ্র কাপড়ে মাঠে নেমে পরতেন ব্যাট বল নিয়ে। সারাদিনব্যাপী খেলা চলতো, মাঠের মাঝে সার্ভ করা হতো চা-নাস্তা, এমনকি লাঞ্চও। আর মূদ্রার ঠিক উলটো পিঠে ছিল ফুটবল। ফুটবল ছিল নিচু শ্রেণির মানুষের খেলা। ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল রেনেসাঁ। রেনেসাঁর কারণে ইউরোপে শুরু হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশন।
আর যার প্রভাব পরেছিল সম্পূর্ণ ইউরোপের নিম্নশ্রেণির লোকেদের উপর। আর সেখানকার শ্রমিকদের হাত ধরেই ইংলিশদের ফুটবলের অগ্রযাত্রা। শ্রমিকেরা তাদফের অবসর সময়ে যে বল নিয়ে খেলে কাটাতো, তাই বড় হয়ে হয় প্রফেশনাল ফুটবল। তখনও প্রফেশনাল ফুটবলের যাত্রা ওভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলুশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই শহর ছিল ম্যানচেস্টার আর লিভারপুল।
আইরিশ সাগরের পাড়ে হওয়ায় লিভারপুল ছিল ইংল্যান্ডের অন্যতম বড় ডক। সবকিছু ভিড়তো সেই ঘাটেই। আর সেখান থেকে চলে যেত অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরে। সে কারণে লিভারপুল শহরের বিজনেস ফুলে ফেপে উঠেছিল। সে সময় ম্যানচেস্টার নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে তৈরি করে ‘দ্যা ম্যানচেস্টার শিপ ক্যানেল’। যাতে করে শহরে মালামাল লিভারপুল থেকে ঘুরে নয়, বরং সরাসরি ম্যানচেস্টারে প্রবেশ করতে পারে। এতে করে ম্যানচেস্টারের লাভ হলেও ক্ষতি হয় লিভারপুলের। ডকের কাজে নিয়োজিত অনেক শ্রমিকই চাকরি হারায়, লোকসানে চলে যায় অনেক ডকিং কোম্পানি। অন্যদিকে ম্যানচেস্টারে বাড়তে থাকে চাকরি, বাড়তে থাকে ডকিং ব্যবসা। আর তার কয়েক মাস পরেই ছিল লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারের দল নিউটন হিথের মধ্যকার খেলা। যে কারণে ব্যবসায়িক দ্বৈরথ ফুটবল মাঠে গড়াতে বেশি সময় লাগেনি।
দ্বৈরথের শুরু আজ থেকে প্রায় ১২৬ বছর আগে, নিউটন হিথ আর লিভারপুলের মধ্যে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আগে নিউটন হিথ নামেই পরিচিত ছিল। ইংলিশ লিগে প্রথমবারের দেখাতেই জয় ছিল অল রেডদের। তাও কোনো যে সে জয় নয়। একেবারে ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত করা জয়। ব্যবসার সাথে সাথে ফুটবলের মাঠেও যে কে রাজা তা দেখিয়ে দিয়েছিল লিভারপুল। যদিও পরের বারের দেখায় লিভারপুলকে পালটা জবাব দিয়ে বসেছিল তারা। ৫-২ গোলের জয় অবশয় সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারেনি।
প্রতিবারের মত এবারও রেড ডার্বি জুড়ে রয়েছে পুরোনো ক্ষত আর স্মৃতি। লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারের রাইভালরি একেবারে তুঙ্গে ছিল ষাট থেকে নব্বইয়ের দশক প্ররযন্ত। যখন দুই দল ছিল তাদের ক্লাব ইতিহাসের তুঙ্গে। ইউনাইটেড এর মিউনিখ ট্র্যাজেডি’র পর লিভারপুল সমর্থকদের মকারি বেশ বড় প্রভাব রেখেছিল এই ডার্বির পেছনে। যেখানে সবাই সহানুভূতি দেখিয়েছিল, সেখানে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি লিভারপুল সমর্থকেরা। যার প্রতিদান ইউনাইটেড দিয়েছিল ’৯৬ ট্র্যাজেডির পর।
তবে এবারের গল্প আর প্রেক্ষাপট দুটোই আলাদা। ইংলিশ লিগে সেই ৯০ দশক থেকেই খেই হারাতে শুরু করে লিভারপুল। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন যখন নতুন করে ম্যানচেস্টারকে গড়ছিলেন, তখন লিভারপুল ঘুরপাক খাচ্ছিল তাদের ছায়ায়। ইংলিশ লিগে যখন লিভারপুলের শিরোপা ১৮ তখন ম্যানচেস্টারের ৭। এরপর ১৯৯২ সালে ভোল পালটে ইংলিশ লিগ হয় প্রিমিয়ার লিগ, আর দৃশ্যপট থেকে আস্তে আস্তে ম্লান হতে থাকে অল রেডরা।
উঠে আসে রেড ডেভিল। স্যার অ্যালেক্সের ৩৮ বছরের ইউনাইটেড ক্যারিয়ারে অর্জন কম নেই। ১৩ প্রিমিয়ার লিগ, ৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেও নিজের সেরা অর্জন ছিল লিভারপুলকে তাদের পথ থেকে ছিটকে ফেলে দেওয়া। লিভারপুলের দূর্দিন আর স্যার অ্যালেক্সের স্বর্ণযুগ এখন অতীত। এই শতাব্দীতে কখনই ইংলিশ লিগে সমান প্রভাব বিস্তার করে খেলতে পারেনি দুই দল। অ্যার অ্যালেক্সের অধীনে যখন রেড ডেভিলরা ছিল নিজেদের ইতিহাসের সেরা অবস্থানে, তখন ম্যানচেস্টারের প্রতিপক্ষ হয়ে এসেছেন আর্সেন ওয়েঙ্গার।
রোমান আব্রামোভিচ কিনেছেন চেলসি, জোসে মরিনহো তাঁদেরকে করেছেন ইংলিশ লিগের লিডার। আরব মানি পেয়েছে অ্যার অ্যালেক্সের ভাষায় ‘নয়জি নেইবর’ সিটি, হয়েছে ইউনাইটেডের যোগ্য প্রতিপক্ষ। এর মাঝে যেন একটু একটু করে ‘নর্থ ওয়েস্ট ডার্বি’ তার জৌলুস হারাচ্ছিল। লিভারপুল ঠিক দাড়াতে পারছিল না, অন্যদিকে ইউনাইটেডের একচ্ছত্র আধিপত্য।
গত দশকে যেন সব ভোজবাজির মতন পাল্টাতে শুরু করল, স্যার অ্যালেক্স বিদায় নিলেন, ইউনাইটেড ঢুকে পরল ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ডে। লিভারপুল নিয়োগ দিলো জার্মান টিচার ইয়ুর্গেন ক্লপকে। দশকের শুরু আর শেষের গল্প যেন পুরোপুরি উলটো। ইউনাইটেড যেখানে খাবি খেয়ে নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে, সেখানে লিভারপুল জিতে নিয়েছে তাদের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ।
ইংলিশ লিগের শিরোপা নম্বর ১৯। আর ইউনাইটেডও নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে তাদের একসময়ের তারকার হাত ধরে। আজকের মুখোমুখি হওয়া তাই শুধু দুই জায়ান্টের লড়াই নয়, বরং পুরোনো স্মৃতি পোলিশ করার লড়াই।
লিগ টেবিলের শীর্ষে ইউনাইটেড। আর তার থেকে মাত্র ৩ পয়েন্ট কম নিয়ে দ্বিতীয়তে লিভারপুল। অ্যানফিল্ডে তাই আজকের গল্প টপ অব দ্য টেবিলের। শুধু কী তাই? ২০১৭ সালের মে মাস থেকে নিজেদের মাটিতে অপরাজিত লিভারপুল। ৬৭ ম্যাচ পার হয়ে গিয়েছে, লিভারপুলের দূর্গ কেউ ভাঙ্গতে পারেনি। অন্যদিকে ওলে গুনার শুলসারের এখনও লিভারপুলের বিপক্ষে নিজের প্রথম জয়ের স্বাদ পাওয়া বাকি। যদিও ঠিকই হেলতে দুলতে নিজের ক্লাবকে লিগ টেবিলের শীর্ষে রেখেছেন, কিন্তু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মুখে চুনকালি মাখাতে না পারলে সব জিতেও কী শান্তি?
শুলসার যদিও এমনিতে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, দলকে সমস্যায় পরতে দেখলে এক পয়েন্ট নিয়েই মাঠ ছাড়তে বলবেন, কিন্তু ইয়ুর্গেন ক্লপ মোটেও তেমন লোক নন। বরং ক্লপের ইচ্ছে নিজেদের মাটি থেকে সবটা নিয়ে যাওয়ার। যদিও ক্লপএর দলের অবস্থা তেমন সুবিধার নয়, তবুও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিপক্ষে তো আর মাথা হেঁট করে থাকা যায় না।
ফুটবল ক্যারিয়ারের মতন কোচিংয়েও চুপিসারে কাজ সেরে ফেলার লোক নরওয়েইয়ান কোচ। বড় বড় কোচেদের বিপক্ষে তার বাজির দর বেশ কমই থাকে। কিন্তু দিনশেষে ঠিকই ম্যাচ জিতে বের হয়ে এসে দেখিয়ে দেন তার শোক্তিমত্তাটা আসলে কোথায়। লিভারপুলের বিপক্ষে আগের সব ম্যাচেই ৫ ডিফেন্স নামিয়েছেন তিনি। আজকেও আশা করা যায় সে পথেই হাঁটবেন। যদিও তার মূলশক্তিমত্তা হলো ব্রুনো ফার্নান্দেস। দিনশেষে দলকে ঠিক সময়মতো ব্রেক এনে দেওয়ার বেলায় তার জুড়ি মেলা ভার।
অন্যদিকে ক্লপ বরাবরই তার ফিলোসফিতে বিশ্বাসী। যদিও এবছর তার দলের একের পর এক চোট তাকে কিছুটা ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে, তবুও তার অ্যটাক ঠিকই পার করে দিচ্ছে। সামনে সালাহ, মানে, ফিরমিনো- তার তুরুপের তাস। মাঝমাঠ থেকে বল পেলে ইউনাইটেডের ডিফেন্স ব্রেক করা তাদের জন্য কঠিন হবে না। দুই পাশ থেকে আর্নল্ড আর রবার্টসন তো আছেই। যদিও মেইক-শিফট ডিফেন্স অভেদ্য করাই এখন ক্লপের জন্য মূল লক্ষ্য, কিন্তু এই ম্যাচে বিন্দুমাত্র রিস্ক নিতে চাইবেন না তিনি।
ক্লপ-ওলে এরায় রেড ডার্বির উত্তেজনা ঠিক জিততেই হবে পর্যায়ে ছিল না কখনোই। মূলত হার এড়িয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেই বাঁচি অবস্থানে ছিল এতদিন। কারণটা ছিল লিগ টেবিলে দুই দলের অবস্থান। কিন্তু এবারের অবস্থান শুধু জয় নয়, রেকর্ড ভাঙার। লিভারপুলের সামনে ২০তম ইংলিশ লিগ জেতার সুযোগ, আর ইউনাইটেডের সামনে ২১ তম, লিভারপুলকে ছাড়িয়ে আরো সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
যে রেকর্ড স্যার অ্যালেক্স নিজে ভেঙে-গুঁড়িয়ে ইউনাইটেডকে তৈরি করে গিয়েছেন, তাতে প্রলেপ লাগতে দিবেন না তার যোগ্য শিষ্য। আর সেই রেকর্ডে ভাগ বসাতে ব্যতিব্যস্ত ক্লপ। তাই দুদলের লড়াইটা গত ১০-১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাকর লড়াই-ই হতে চলেছে। যার মূল লক্ষ্য একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়া। আর সেখানে সে যুদ্ধে সুচাগ্র মেদিনী না ছাড়ার লক্ষ্য নিয়েই নামবেন দু’জনে।