অমিত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মালেও নামের পাশে আক্ষেপ ছাড়া শেষ পর্যন্ত কিছুই রাখতে পারেনি। গোল্ডেন বুট জয়ী এই ব্রাজিলিয়ান হতে পারতেন ফুটবল সম্রাট।
তিনি আদ্রিয়ানো লেইটে রিবেরিও; সংক্ষেপে আদ্রিয়ানো।
অসামান্য প্রতিভা থাকলেও বাবার মৃত্যুতে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেন নিজের জীবন। মদের নেশায় ডুবে থাকতে থাকতে ডুবিয়ে দেন নিজের ক্যারিয়ারও। বিলাসী জীবন যাপন করা এই ব্রাজিলিয়ান তারকা নিজের কর্মদোষে বস্তিবাসীও হয়েছিলেন। তাঁর ক্যারিয়ার ঘাটলে সুখস্মৃতির চেয়ে দু:খভরা আক্ষেপের গল্পই পাওয়া যাবে। তার স্কিল আর প্রতিভার সবটুকু দেখাতে পারলে হয়তো তিনি হতেন সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবল সম্রাট!
১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অপার সম্ভবনা আর প্রতিভা নিয়ে জন্ম নেয় আদ্রিয়ানো লেইটে রিবেরিও। ছেলেবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ঝোঁক ছিল তার। ফুটবল এতটাই পছন্দ করতেন যে ময়লা, কংকরভরা মাঠে খালি পায়েই ফুটবল খেলতে নেমে যেতেন তিনি। তার স্বপ্ন ছিল একদিন তিনি ইউরোপের সেরা ক্লাবে খেলবেন।
এরপর ব্রাজিলের একটি লোকাল ক্লাবে তিনি খেলা শুরু করেন ৷ ফুটবল খেলেই তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় পার করতেন। ছোটবেলার সব বাচ্চাদের মত আদ্রিয়ানোরও স্বপ্ন ছিল বড় গাড়ির মালিক এবং ধনী হওয়া।
১৯৯৯ সালে তরুন এই ব্রাজিলিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গোর একটি যুব স্কোয়াডের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। দারুন প্রতিভা আর স্কিল দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করার পর দলের প্রায় নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন আদ্রিয়ানো। সে সময় যুব দলের কোচ তাকে মূলত লেফট ডিফেন্ডার হিসেবে খেলাতেন।
কিন্তু, খুব বেশিদিন নয়, কোচ দেখলেন সেন্ট্রাল স্ট্রাইকার হিসেবেই আদ্রিয়ানোর দারুন সম্ভাবনা আছে এবং তার জন্য সেটিই হবে উপযুক্ত জায়গা। তার আরেকটা মূল কারণ ছিল আদ্রিয়ানো বেশ দ্রুত বল নিয়ে সামনে এগোতে পারতেন।
যুব দলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখানোর পর ২০০০ সালে সেখানকার সিনিয়রদের স্কোয়াডে এক ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় আদ্রিয়ানো। ২রা ফেব্রুয়ারিতে রিও’র একটি লোকাল টুর্নামেন্টে তার অভিষেক হয় বোটাফগোর বিপক্ষে। যথেষ্ট ভালো খেলায় চারদিন পর সাও পাওলোর বিপক্ষে আরেকটি ম্যাচে সুযোগ পান তিনি। ঠিক ১৮তম জন্মদিনের একদিন আগে আদ্রিয়ানো নিজের প্রথম গোলের দেখা পান সিনিয়র দলের হয়ে!
তার পারফরম্যান্সে দেখে বেশ খুশি হন দলের টিম ম্যানেজার। তারপর থেকেই দলের নিয়মিত মুখ হিসেবে খেলতে থাকেন তিনি ৷ ২০০০ সালের জুনে ফ্ল্যামিঙ্গোর সাথে ২ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। সেখানে ২৪ ম্যাচে ১০ গোল করার পর, ২০০১-০২ সিরিয়া এ সেশনের আগে ইতালিয়ান জায়ান্টস দল ইন্টার মিলানে যোগ দেন তিনি। ৯.৭৫ মিলিয়ন ইউরোতে ফ্লামিঙ্গো থেকে ইন্টার মিলানে আসেন তিনি।
ইতালিয়ান কোনো শব্দ বা ভাষা না জানা আদ্রিয়ানোর জন্য এই মুভটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল! যে কিনা ছোটবেলা থেকেই ইউরোপ লিগে খেলার স্বপ্ন দেখতো। তখনকার সময়ে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদো ডি লিমাও ইন্টার মিলানের খেলোয়াড় ছিলেন। রোনালদোর সাহায্যেই পরবর্তীতে আদ্রিয়ানো সেখানে সেটেল হয়ে খেলার প্রতি মনোনিবেশ করেন।
ইন্টার মিলানের হয়ে ১৪ নম্বর জার্সি গায়ে জড়িয়ে মাঠে নামেন তিনি। ৮ ম্যাচে মাত্র এক গোল করেন আদ্রিয়ানো! সেটিও রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। এরপর লোনে আরেক ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্টিনায় আসেন তিনি। ১৫ ম্যাচে সেখানে ৬ গোল করেন তিনি। সেখান থেকে আবার লোনে ট্রান্সফার হন আরেক ইতালিয়ান ক্লাব পার্মায়।
সেখানে অবশ্য দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখাতে সক্ষম হন তিনি। তার প্রতিভার নিদর্শনটা মূলত পার্মাতেই দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ২০০২-০৪ মৌসুমে পার্মায় ৩৭ ম্যাচে ২৩ গোল করেন আদ্রিয়ানো! এরপর ইন্টার মিলান তাদের ভুলটা বুঝতে পারে যে, তারা তাঁদের ‘গোল মেশিন’ কেই লোনে দিয়ে দিয়েছে!
এরপর ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে ২৩.৪ মিলিয়ন ইউরোতে আবারো তারা সাইন করে আদ্রিয়ানোকে। এরপর ২১ ম্যাচ খেলে সেখানে ১৩ গোল করেন তিনি! তার পারফরম্যান্সে সেবার উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে কোয়ালিফাই করে ইন্টার মিলান। তারপর তাকে ‘এম্পেরর অব মিলান’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়।
৪ আগস্ট ২০০৪; উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ালিফায়ারে সুইস চ্যাম্পিয়নসদের বিপক্ষে সেবারের মৌসুমের প্রথম খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আদ্রিয়ানো। হঠাত খবর পেলেন তার বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন! তার বাবা আলমির লেইটে রিবেইর হঠাত করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ৪৪ বছর বয়সেই পরপারে পাড়ি জমান।
বাবা-ছেলের সম্পর্ক ছিল একেবারে বন্ধুর মত। বাবার মৃত্যুর খবরে অনেক ভেঙে পড়েন আদ্রিয়ানো!
সাবেক ইন্টার মিলানের সতীর্থ খেলোয়াড় জাভির যানেতি আন্দ্রিয়ানোর তখনকার অবস্থা (বাবা মারা যাওয়ার খবরে) নিয়ে পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আদ্রিয়ানো তার বাবার সাথে বন্ধুর মতই ছিল। ওই সময় আমরা টিআইএম ট্রফেওতে অনুশীলন করছিলাম। হঠাত আকস্মিক কিছু হল। আমরা খবর শুনেই রুমে দৌড়ে গেলাম।’
‘সে (আদ্রিয়ানো) একটা ফোন পেল ব্রাজিল থেকে; ওপাশ থেকে তাকে বলছে আদি, বাবা মারা গেছে… এটা শুনেই সে ফোন টা ছুঁড়ে মারলো এবং চিৎকার করা শুরু করলো! আপনি ভাবতেও পারবেন না সেই ভয়ানক চিৎকার! আমার লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, এখনো আমার সেই কথা মনে হলে এমন হয়! সেদিন থেকে আমি তাকে ছোট ভাইর মত দেখি।’ যোগ করেন তিনি।
তার বাবার মৃত্যুর পর তার পরিবর্তনটা তার ক্যারিয়ারে এতটাই প্রভাব ফেলে যে তিনি আর উঠে দাঁড়াতেই পারেননি! বাবার মৃত্যুর পর বেশ কিছু ম্যাচেই গোলের পর গোল করে যাচ্ছিল আদ্রিয়ানো। কিন্তু তা বেশি দীর্ঘায়িত হতে পারেনি বেশ দুঃখজনক ভাবেই। হঠাত করেই আদ্রিয়ানো ভয়ানক নেশার ফাঁদে জড়িয়ে যায়!
বাবার মৃত্যুর পর হতাশার সাথে সাথে আদ্রিয়ানো অ্যালকোহলে এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যে ক্রমাগত তার পারফরম্যান্স নিন্মগামী হতে থাকে। রাতভর পার্টি আর মদের বোতল নিয়ে নেশায় ডুবে থাকতে থাকতে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটাই তিনি করে ফেলেছিলেন।
তাঁর ক্রমাগত খারাপ পারফরম্যান্স আর অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ ইন্টার মিলানেরও নজর এড়ায়নি। ২০০৭ সালে ইন্টার মিলান তাকে সাও পাওলোতে ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠায়। ২০০৭-০৮ সেশনের জন্য ব্রাজিলিয়ান একটি ক্লাবে আদ্রিয়ানোকে লোনে দেওয়া হয়, যাতে করে সে তার পুরোনো ফর্মে ফিরতে পারে।
কিন্তু, সেখানেও তিনি অনুশীলন মিস সহ নানা কার্যকলাপ করেন যা ছিল অখেলোয়াড়সুলভ! ১০ ম্যাচে ৬ গোল করার পর তার পারফরম্যান্স আর কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়ে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব থেকে তাকে পুনরায় ইন্টার মিলানে ফেরত পাঠিয়ে দেয় হয়!
ক্রমাগত খারাপ পারফরম্যান্স আর নেশায় ডুবে থাকায় আদ্রিয়ানোর প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না মিলান কর্তৃপক্ষ। কাউকে না জানিয়ে নিজ দেশে অবস্থান সহ, বোর্ডের সাথে যোগাযোগ না করা, খামখেয়ালীপনা সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নাখোশ হয়ে মিলান শেষ পর্যন্ত আদ্রিয়ানোর চুক্তি বাতিল করে তাঁকে রিলিজ করে দেয় ক্লাব থেকে।
৮ বছর ক্লাবে থাকার পর তাকে ছেড়ে দেয় ইন্টার! মিলানের হয়ে ১৭৭ ম্যাচে ৭৪ গোল করেন তিনি। ইন্টার মিলান থেকে রিলিজ দেওয়ার পর আদ্রিয়ানো আবার ব্রাজিলে ফিরে যান, যেখান থেকে তিনি ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন! ফ্লেমিংঙ্গোর সাথে আবারো এক বছরের চুক্তি করেন তিনি।
এরপর পুরো সেশন টাই সেই পুরোনো আদ্রিয়ানোর মত চমক দেখান তিনি। অসাধারণ টেকনিক, আর দূর্দান্ত স্কিল দেখিয়ে বেশ কয়েকটি হ্যাটট্রিকও করেন সেবার। তার অসাধারণ পারফরম্যান্সেই ফ্ল্যামিঙ্গো তাঁদের ইতিহাসে প্রথমবার ব্রাজিলিয়ান সিরি ‘এ’র ট্রফি জেতে!
এরপর তাঁর অসাধারণ পারফরম্যান্স আবারো নজর কাড়ে ইতালিয়ান ক্লাব রোমার। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় সাবেক এই বিস্ময় বালকের জন্য আরেকবার বিড করার। অবশ্য তাঁরা সফলও হয়! তিন বছরের চুক্তিতে ২০১০ সালের জুনে আবারো ইতালিতে ফেরেন আদ্রিয়ানো।
পূর্বে রোমায় খেলা ৮ নম্বর জার্সিটাই তাকে তুলে দেওয়া হয়! সেখানে ৭ মাসে মাত্র ৫ ম্যাচ খেলেন তিনি! এবং বোর্ডকে ইমপ্রেস করতে চরম ব্যর্থ হওয়ার পর তার সিদ্ধান্ত নেয় তার চুক্তি বাতিল করার। এরপর ২০১১ সালের মার্চে আরেক ব্রাজিলিয়ান ক্লাবে চুক্তিবদ্ধ হন তিনি।
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অনুশীলনের সময় ইনজুরিতে পড়ে ৬ মাস মাঠের বাইরে থাকেন তিনি। এরপর ইনজুরি থেকে ফিরে সেই ক্লাবে অভিষেক করলেও, পারফরম্যান্স বিচারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেখানেও তার চুক্তি বাতিল হয়।
৫ বছর পর শেষ বারের মত তিনি মিয়ামি ইউনাইটেডে চুক্তিবদ্ধ হন আদ্রিয়ানো। চুক্তিবদ্ধ হলেও সেখানে তিনি কখনোই সেভাবে সুযোগ পাননি। বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে তিনি ব্রাজিলেই অবস্থান করছেন। এবং নিজের অবস্থানের জন্য কর্মদোষ আর ভাগ্যকে দোষারোপ করছেন।
মাঝে খবর উড়েছিল যে আদ্রিয়ানো অবস্থান করছেন ব্রাজিলের ফ্যাভেলায় (বস্তি)! এবং ড্রাগ স্ক্যান্ডালে জড়িত এক অপরাধ সংস্থা ‘কমান্ড ভেরমেলহো’র সঙ্গে তিনি হাত মিলিয়েছেন বলেও জানা যায়! এছাড়াও বেশ কিছু অপরাধেও তার নাম জড়িত থাকার খবরও বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।
অসাধারণ টেকনিক আর দুর্দান্ত স্কিল নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা সেই বিস্ময়কর আদ্রিয়ানো হতে পারতেন ফুটবলের সেরা সম্রাট! কিন্তু কর্মদোষ আর ভুল পথে পা বাড়িয়ে শেষ করেছেন নিজের ক্যারিয়ার।
তার জীবন থেকে শিক্ষা নেবার আছে অনেক কিছুই ; জীবনে যত ঝড়-ঝাপটাই আসুক ভুল পথ কিংবা অন্ধকার পথের দিকে পা বাড়াতে নেই। গোল্ডেন বুট জয়ী সেই বিস্ময়কর বালক এখন হয়তো কোনো এক সন্ত্রাসী কাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে সব খুইয়ে আফসোস করছেন!
আফসোস করছে ফুটবল বিশ্বও। অথচ, আদ্রিয়ানো হতে পারতেন আলোর জগতের সেরা, সেই তিনিই কিনা বেছে নিলেন অন্ধকার জগৎ।