জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল
এই প্রবাদ শোনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে না, লুকাস পোডলস্কি কোন অংশেই বাঙালি না। তিনি পোলিশ। অর্থ্যাৎ পোল্যান্ডে জন্ম তাঁর। তবে তিনি এই পৃথিবীর বুকে আলো ছড়িয়েছেন একজন জার্মান হিসেবে। তার গল্পের শুরুতেই তাই বাংলা প্রবাদের আগমন।
লুকাস পোডলস্কির জন্ম ৪ জুন ১৯৮৫ সালে। জন্মটা হয়েছিল গ্লিউইস শহরে। সে শহরটা অবশ্য পোল্যান্ডের। তবে তার বাবা-মা পাড়ি জমান জার্মানিতে। পোল্যান্ড থেকে এসে তার ফুটবলার বাবা ও আন্তর্জাতিক হ্যান্ডবল খেলোয়াড় চলে যান তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে। সেখনে বেড়ে ওঠা পোডলস্কির। আর সেখান থেকেই পরবর্তীতে তিনি হয়েছেন ফুটবলের বিস্তৃত আকাশের এক উদীয়মান তারকা।
মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফুটবল প্রশিক্ষণের জন্যে ভর্তি হয়ে যান স্থানীয় এক ক্লাবে। বার্গেইম শহরের আনাচে-কানাচে খেলে বেড়ান তখন তিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি যেন খুঁজে পেলেন নিজের প্রথম ভালবাসা, নিজের প্রথম ক্লাব এফসি কোলেনে। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই ক্লাবটির বয়সভিত্তিক দলগুলোর ক্রমাগত সিড়ি বেয়ে তিনি উঠতে থাকেন ফুটবল ক্যারিয়ারের উপরের দিকে।
ক্লাবটি অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে খেলার সময়ই সদ্য সে সময় সদ্য নিযুক্ত হওয়া কোচ মার্সেল কোলারের নজরে পড়ে যান তিনি। কারও নজর কেড়ে নেওয়ার মত যথেষ্ঠ পারফর্মও করেছিলেন পোডলস্কি। তিনি যুব দলের হয়ে খেলা আট ম্যাচে করে ফেলেন আটটি গোল। এই ছেলের দিকে নজর না দিয়ে উপায় আছে? নেই নিশ্চয়ই। সেটা ছিলও না কোলারের কাছে।
আর এই ছেলেকে সুযোগ দেওয়াটাও বেশ প্রয়োজনীয়। তবে সে জন্যে তাকে নিয়ে রীতিমত জুয়া খেলত হত। কোলার খেলে ফেললেন। আর সে জন্যে অবশ্য পোডলস্কির চির কৃতজ্ঞ। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই তিনি চলে আসেন এফসি কোলনের মূল দলে। আর এসেই যেন তিনি নিজের চমক দেখাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। প্রথম মৌসুমেই তিনি ক্লাবটির হয়ে করে ফেলেন ৫৫ খানা।
তবে ক্লাবটির হয়ে আর বেশিদিন খেলা হয়নি তাঁর। তিন মৌসুম শেষ করেই তিনি চলে যান নতুন ঘরের সন্ধ্যানে। তার প্রিয় ক্লাবটা তখন যেন পেন্ডুলাম। প্রথম বিভাগ আর দ্বিতীয় বিভাগের মধ্যে দোদুল্যমান। আর তাই নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি চলে যান বায়ার্ন মিউনিখ শিবিরে।
জার্মান পরাশক্তিদের হয়ে এরপর তিনি কাটান তিন মৌসুম। এই তিন মৌসুমে নিজের সম্ভাবনা বা প্রতিভার প্রতিফলন ঠিক মত দেখাতে পারেননি লুকাস পোডলস্কি। অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারেনা যেন তার জন্যে বিপরীত এক অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হয় তার জীবনে। ক্লাবটির হয়ে তিনি ৭১টি লিগ ম্যাচে খেলতে নেমেছিলেন। তবে সেই ৭১টির মধ্যে তিনি কেবলমাত্র ১৩টি ম্যাচ খেলতে পেরেছেন পুরো নব্বই মিনিট।
তার থেকেও ভয়ংকর বিষয় তিনি লিগে বাভারিয়ানদের হয়ে মাত্র ১৩টি গোল করতে পেরেছিলেন। অথচ ২০০৬ বিশ্বকাপে লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মত খেলোয়াড়দের পেছনে ফেলে তিনি হয়েছিলেন বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়। কিন্তু সে যেন হয়ে গেলেন পথভ্রষ্ট। জার্মান জায়ান্টরা কোনো রকমের জুয়া খেলতে নারাজ। তাই ২০০৮-০৯ মৌসুমের পর দল ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।
এর আগে অবশ্য অনেকটা আশ্চর্য্যের জন্ম দিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন জার্মানির ২০০৪ ইউরো দলে। পোল্যান্ড কিংবা জার্মানি এই দুই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ থাকলেও পোল্যান্ড আগ্রহ দেখায়নি পোডলস্কিকে নিয়ে।
তবে ভিন্ন চিত্র ছিল জার্মান শিবিরে। তাঁকে ঘিরেই যেন দল পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা সাজায় জার্মানি। ঠিক কতটা সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় ছিলেন তিনি তা আন্দাজ করে নিতে নিশ্চয়ই খুব একটা বেগ পোহাতে হয় না।
তবে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের সাথে সাথে পোডলস্কি হয়েছেন কক্ষচ্যুত। ক্লাবের পর ক্লাব ঘুরেছেন তবুও যেন শুরুতে দেখানো সম্ভাবনার দেখা মেলেনি কখনোই। কখনো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ও কখনো ইতালিয়ান সিরি-আ। আবার তুর্কি হয়ে, জাপান। শেষে এখন পোল্যান্ডেরই এক ক্লাবে খেলছেন পুডলস্কি। এত ঘুরেও পুডলস্কির প্রতিভার প্রদীপ শিখা যেন আর জ্বলেনি দপদপ করে।
অমিত এক সম্ভাবনা হারিয়ে গেল। অথচ তার বা-পায়ের শটের শক্তির কতই না প্রশংসা হত এক সময়। তার গোল করার দক্ষতার কত সুনাম ছিল একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। সে সব ক্রমশ ফিকে হয়ে লুকাস পোডলস্কি যেন হারিয়েই গেলেন ফুটবলের মহাকাশ থেকে। তবুও তিনি তার ফুটবলীয় দক্ষতার প্রমাণ রেখেই জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসে।