২০১৫ সালে বাংলাদেশ যখন অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে ব্যস্ত তখন খুলনার মাঠে ঘাম ঝড়াচ্ছেন এক তরুণ ক্রিকেটার। সবেমাত্র খুলনা দলে ডাক পেয়েছেন। তবে তিনিই বছর ছয়েক পরে সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই নিজেকে বাংলাদেশ দলের অপরিহার্য অংশ বলে প্রমাণ করেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের অন্যতম নায়কও তিনি। যদিও ব্যাটে-বলে পারফর্ম করা শেখ মাহেদী হাসানকে নিয়ে আলোচনার পারদটা ঠিক আকাশচুম্বী হচ্ছেনা।
সাকিব, মুস্তাফিজ কিংবা আফিফদের ভিড়ে অনেকটাই চাপা পড়ে যাচ্ছেন শেখ মেহেদী হাসান। অথচ তিনিই তো আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন যে অস্ট্রেলিয়ার সাথেও আমরা জিততে পারি। একটু পিছনে ফিরে যাই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে মাত্র ১৩১ রান করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এই পুঁজি নিয়েও অস্ট্রেলিয়াকে হারানো যায় সেটা তখন ক’জনই বা বিশ্বাস করতো।
তবে শেখ মেহেদী বিশ্বাসটা করেছিলেন। তিনিই প্রথম সাহসটা দেখিয়েছিলেন। বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের তিনিই প্রথম বার্তাটা দিলেন, ‘আমরা লড়াই করতে এসেছি।’ ইনিংসের প্রথম বলেই অজি ওপেনার অ্যালেক্স ক্যারিকে রীতিমত বোল্ড করে দিলেন। এটাকে শুধু একটা উইকেট হিসেবে বিবেচনা করলেই ভুলটা হবে। মেহেদীর গুঁড়িয়ে দেয়াটা স্টাম্পটা ছিল তখন পুরো অস্ট্রেলিয়া দলের প্রতিচ্ছবি। ওই একটা উইকেট পুরো বাংলাদেশ দলকে সাহস জুগিয়েছে। ইনিংসের শুরুতেই এমন একটা উইকেট দলকে চাঙা করেছে। অন্যান্য বোলারদের মনেও বিশ্বাস এসেছেন তাঁরাও পারবেন।
মেহেদীর এই বোলিং যাত্রাটা শুরু হয়েছিল শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামের একজন নেট বোলার হিসেবে। মেহেদীদের বাড়ির ঠিক পাশেই খুলনার এই স্টেডিয়াম। প্রায়ই বিকাল বেলা সেখানে ক্রিকেট খেলতে যেতেন তিনি। তবে প্রথম নজরে আসেন ২০০৬ সালে আরব আমিরাত ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলের একটা সিরিজের সময়। খুলনায় অনুষ্টিত সেই সিরিজের নেটে মাত্র ১২ বছর বয়সী এক স্পিনারের বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন আরব আমিরাতের সেই সময়ের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। সিরিজের পর মেহেদীকে একটা ব্যাট ও উপহার দিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে।
উপহার পাওয়া ব্যাটের জন্যই বোধহয় ব্যাটিং এর প্রতি ভালবাসাটা তৈরি হয়েছিল মেহেদীর। তখন থেকেই বোলিং এর পাশাপাশি নিয়মিত ব্যাটিংটাও করেন। ২০১৫ সালে খুলনা দলে যখন ডাক পেলেন তখন জাতীয় লিগে নিজের অভিষেক ম্যাচেই নিজের ব্যাটের ধারটা দেখালেন মেহেদী। প্রথম ম্যাচেই দুই ইনিংসেই করেছিলেন হাফ সেঞ্চুরি। পরের ম্যাচের প্রথম ইনিংসে খেললেন ১৪০ রানের ইনিংস। এরপর থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটে এক টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানের নাম শেখ মেহেদী।
ব্যাট-বলে নজর কেড়ে দ্রুতই চলে আসেন জাতীয় দলের আওতায়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে সর্বপ্রথম জাতীয় দলে ডান পান এই অলরাউন্ডার। তবে জাতীয় দলে নিজের শুরুটা খুব ভালো করতে পারেননি। ফলে নিয়মিত সুযোগও মেলেনি। অবশ্য এই বছর নিউজিল্যান্ড সফর থেকেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মেহেদীর উপর নিয়মিত আস্থা রেখেছে নির্বাচকরা। সেই আস্থার প্রতিদানও দিলেন ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে।
আবার একটু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ গুলোতে ফেরা যাক। মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে আসলেও এই সিরিজের পর তাঁর বোলিং নিয়ে কারো মনেই আর প্রশ্ন থাকার কথা না। অস্ট্রেলিয়ায়র বিপক্ষে প্রতি ম্যাচেই করেছেন বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং। সাকিব, নাসুমদের সাথে তাল মিলিয়ে বোলিং করে গেছেন। মেহেদীর সবচেয়ে বড় গুন লাইন-লেন্থের উপর তাঁর কট্রোল।
তিনি হয়তো খুব নজরকারা রিস্ট স্পিনার নন। কিংবা বল প্রচণ্ড টার্ন করাতে পারেন তাও না। তবে মেহেদী খুব সহজে ব্যাটসম্যানদের রান করতে দিবেন না। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও একেরপর এক ডট বল করে ব্যাটসম্যানদের চাপে ফেলে দেন। ফলে অন্য প্রান্তের বোলারদের জন্য উইকেট পাওয়ার কাজটা সহজ হয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রতিটি ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে বল করেও তাঁর ইকোনমি রেট মাত্র ৬.০২। পাশাপাশি প্রতি ম্যাচেই প্রয়োজনের সময়ে দলকে উইকেট এনে দিয়েছেন।
মেহেদীর আরেকটা বড় গুন হলো তিনি একজন টিম ম্যান। দল থেকে তাঁকে যে দায়িত্বটা দেয়া হয় তিনি সেটাই করেন। বাংলাদেশ দল মূলত তাঁকে স্পিনার হিসাবেই খেলাচ্ছে। তবুও ব্যাট হাতে যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেটুকুকেই কাজে লাগিয়েছেন। এই লো স্কোরিং সিরিজেও তাঁর ঝুলিতে আছে ৬২ রান। এর মধ্যে একটি অপরাজিত ইনিংসও আছে। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে ৫ ম্যাচের তিনটিতেই তিনি ব্যাট করেছেন আট নম্বর পজিশনে।
তিনি এমন একজন ব্যাটসম্যান যাকে দল যেজোন পজিশনেই নামিয়ে দিতে পারে। ফলে প্রতিপক্ষ দলের জন্যও তিনি এক চিন্তার বিষয়। যেমন সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তাঁকে নামিয়ে দেয়া হলো চার নম্বরে। সেখানে নেমেও নিজের দায়িত্বটা পালন করেছেন। আবার শেষ ম্যাচে তাঁকে দিয়ে ওপেন করানো হলো। নাঈমের সাথে মিলে দারুণ একটা শুরু এনে দিয়েছিলেন সেই ম্যাচে। বিশেষ করে অজি স্পিনারদের খেলেছেন নির্ভয়ে।
মোদ্দাকথা মেহেদীকে যখন যা করতে বলা হয়েছে তিনি সেটাই করার চেষ্টা করেছেন। দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। সবমিলিয়ে সিরিজের ৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ৫ উইকেটের পাশাপাশি তাঁর ঝুলিতে যে ৬২ টি রান আছে সেটিও মনে রাখা দরকার। মেহেদীর স্বপ্ন ছিলেন তিনি অলরাউন্ডার হবেন। সেই স্বপ্ন বুঝি তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়।